ভনদের ‘যোগ্যতা’ নিয়ে প্রশ্নের জবাব মাঠেই দিলেন বাভুমারা

২৯ ডিসেম্বর ২০২৪। এই দিনে ২০২৫ সালের আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে যাওয়া নিশ্চিত করে ফেলে দক্ষিণ আফ্রিকা। পাঁচ মাসের বেশি সময় পর যখন সেই ম্যাচে খেলার প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত প্রোটিয়ারা, তখন ম্যাচপূর্ব আলোচনায় তাদের যোগ্যতা নিয়ে উঠেছিলো আলাপ।
টেম্বা বাভুমার দল কি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের তৃতীয় চক্রের যোগ্য ফাইনালিস্ট? সাবেক ক্রিকেটারদের তোলা এই প্রশ্ন কানে গেছে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটারদের। তাইতো যারা বলেছেন ফাইনালের পথে শক্তিশালী প্রতিপক্ষদের মুখোমুখি হয়নি দক্ষিণ আফ্রিকা, তাদের উদ্দেশ্যে সাদা পোশাকের বিশ্ব শিরোপা জিতে কাগিসো রাবাদা বলেছেন- রাবিশ!
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে মাইকেল ভনের কাছে হয়তো ইতোমধ্যেই রাবাদার ভিডিও পৌঁছে গিয়েছে। ইংল্যান্ডের সাবেক এই অধিনায়ক যে বেশ তীর্যক মন্তব্যই করেছিলেন, 'তারা ফাইনালে আসার পথে বলতে গেলে কোন দলকেই হারায়নি।'
ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডকে বলা হয় বিগ থ্রি। এর মধ্যে ইংলিশ ও অজিদের বিপক্ষে ২০২৩-২৫ চক্রে কোন টেস্ট খেলেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। বড় দলের বিপক্ষে না খেলে তাদের ফাইনালিস্ট হয়ে যাওয়া নিয়ে আলোচনা থামেনি ফাইনাল শুরু হওয়ার পরও।
আরেক ফাইনালিস্ট অস্ট্রেলিয়া ১৯ ম্যাচ খেলে পা রেখেছে লর্ডসে। দক্ষিণ আফ্রিকা মাঠে নেমেছে ১২ টেস্টে। প্রোটিয়ারা দুই ম্যাচের বেশি খেলেনি কোন সিরিজে। এমনি এমনি কি আর দক্ষিণ আফ্রিকার সাংবাদিক ও ধারাভাষ্যকার নিল মানথর্প টুর্নামেন্টটিকে বিশ্বের যেকোন খেলার মধ্যে সবচেয়ে ত্রুটিপূর্ণ বলেন?
একটা টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণকারী সব দল একে অপরের বিপক্ষে খেলে না। এর মধ্যে দুটি দলের (ভারত ও পাকিস্তান) আবার নিকট ভবিষ্যতে কোন আসরেই ফাইনাল ব্যতীত মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
সব দলের ম্যাচ সংখ্যা সমান নয়। ম্যাচ সংখ্যা আবার নিজেদের ইচ্ছেমতো নির্ধারণ করা যায়। এজন্য শতকরা পয়েন্টের হিসেবে ঠিক হয় পয়েন্টস টেবিলে অবস্থান। ক্রিকেটের নিয়মিত অনুসারী নন, এমন একজনকে বোঝানোর চেষ্টা করে দেখুন তো! এ কেমন বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা- এমনটাই যদি না বলেন, তবেই বিস্মিত হতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকার যোগ্যতার আগে তাই উঠে যায় টুর্নামেন্টের গঠন নিয়ে প্রশ্ন।
তবে দুই ম্যাচ অনেকটা 'স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেওয়ার' মতন করে খেলেও প্রোটিয়াদের ফাইনালে আসার যাত্রাটাকে অসাধারণ বলতে হয়। মূল দলের সবাইকে বাদ দিয়ে যখন ২০২৪ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে দল পাঠিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, তখন সেটিকে স্বেচ্ছায় হাল ছেড়ে দেওয়া বললে কি ভুল হবে? শেষমেশ নিল ব্রান্ডের দলের নিয়তিতে অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কিছু থাকেনি৷
মূলত এসএটোয়েন্টিতে যাদের সুযোগ হয়নি, তাদেরই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল কিউইদের বিপক্ষে খেলতে। ক্রিকেট সাউথ আফ্রিকার জন্য এসএটোয়েন্টি হয়ে উঠেছিল এতটাই গুরুত্বপূর্ণ। ওই সময় আর্থিক অসঙ্গতির মধ্যে ছিল দেশটির ক্রিকেট বোর্ড। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের মাধ্যমে অর্জিত আয় টেস্ট ক্রিকেটকে বাঁচাতে সহায়তা করবে বলে ধারণা করা হয়েছিল।
তা সত্যি হয়েছে বটে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যেমন ৪৫.৬ মিলিয়ন ডলার লাভ করেছে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট বোর্ড। এর আগের তিন বছরে এই সংস্থাটি লাভের মুখ দেখেনি। আর টেস্টে ভারতকে আতিথেয়তা দিতে পারলে যা লাভের সম্ভাবনা। এর বাইরে লাল বলের ক্রিকেট মোটেও ভালো আয়ের উৎস নয়।
তাইতো মর্যাদার এই সংস্করণের আগে গুরুত্ব পেয়েছে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ। এমন পরিস্থিতি যে দেশে, সেখানে আইসিসি ইভেন্টে ১২টি সেমিফাইনাল ও ১টি ফাইনালের পর ২৭ বছরের আক্ষেপ কিনা ঘুচল লাল বলের ক্রিকেটের মাধ্যমেই! সেটিও তাদের প্রথম কালো অধিনায়ক বাভুমার নেতৃত্বে।
যিনি একবার বলেছিলেন, 'আমরা কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান খেলোয়াড়েরা মেনে নিয়েছে যে যদি দুই-তিন ম্যাচে রান না করি তাহলে নির্দিষ্ট নামে ডাকা হবে। আর এমনকি ভালো করলেও আপনি কেন দলে আছেন অথবা নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রশ্ন তোলা লোকজন থাকবেন, এটাও মেনে নিয়েছি।'
ভারতের বিপক্ষে ১-১ ড্রয়ের সিরিজ দিয়ে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের তৃতীয় চক্র শুরু করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। স্বেচ্ছায় হাল ছেড়ে দেওয়া সিরিজের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে বাভুমার দল ১-১ ব্যবধানে সিরিজ ড্র করে। এরপর একে একে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করা। টানা সাত জয়ে ফাইনালে পৌঁছে যাওয়া। তবুও যোগ্যতা নিয়ে যদি কোন সংশয় থেকে থাকত, তা মাটিচাপা দিয়ে ফেলার যে একটিমাত্র উপায় ছিল, সেই পারফরম্যান্সের মাধ্যমে জবাব দিয়েছেন প্রোটিয়ারা।
ফাইনালে ম্যাচসেরা হওয়া এইডেন মার্করামের সঙ্গে বিস্ময়চিহ্ন লেগেই ছিল। কীভাবে পারেন না তিনি! ১৩৬ রানের এক নিখুঁত ইনিংস খেলে ইতিহাস হয়ে গেলেন মার্করাম। ম্যাচসেরার পুরস্কার নেওয়ার পর সাক্ষাৎকার শেষে নাসের হুসেইন তাকে বললেন, 'পেয়ার পাওয়ার মুখে নেমেছিলেন ব্যাট করতে, ক্রিজ ছাড়লেন জাতীয় নায়ক হয়ে'।
চলতি বছরের আইপিএলের মাঝপথে হুট করে বাড়ি ফিরে যান কাগিসো রাবাদা। তখন ব্যক্তিগত কারণ দেখানো হয়। পরে খবর আসে- কোকেইন নেওয়ার অপরাধে তিনি পেয়েছেন এক মাসের নিষেধাজ্ঞা। এমন বিতর্ককে সঙ্গী করে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে জ্বলে উঠলেন ৯ উইকেট শিকার করে।
গ্রায়েম স্মিথের কাছে বিশ্বজয়ের আনন্দ মুখে নিয়ে এরপর রাবাদা বললেন, 'আমরা এটির যোগ্য। লোকেরা বলছিল আমরা যথেষ্ট শক্তিশালী প্রতিপক্ষদের মোকাবিলা করিনি। রাবিশ! আমরা এখানে এসে সেরা দলের বিপক্ষেই খেললাম। অস্ট্রেলিয়া পুরো মৌসুমে দুর্দান্ত খেলে এসেছে।'
ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পর যোগ্যতা নিয়ে কি থাকে আর কোন প্রশ্ন? এক্সে একজন টুইট করেছেন, 'কেউ কি মাইকেল ভনের খোঁজ নিয়েছেন এবং তিনি ঠিক আছেন কিনা দেখেছেন?' ভন উত্তর দিয়েছেন, 'এই বছরটা আন্ডারডগদের'!
Comments