পেডোফিলিয়া: শিশুদের সুরক্ষায় যে ব্যাপারে সচেতনতা জরুরি

বছরের প্রথম চার মাসে বাংলাদেশে সংঘটিত প্রতি ১০ ধর্ষণের ঘটনার নয়টিই শিশুদের সঙ্গে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই শিশুদের অনেকেই নবজাতক। কারো কারো বয়স মাত্র কয়েক মাস।
এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, কত ভয়াবহ হুমকির মুখে আছে আমাদের শিশুরা।
এসব ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের খবরগুলো প্রকাশ হওয়ার পর অনলাইনে কয়েক ঘণ্টা বা কয়েকদিন তোলপাড় হলেও এর পেছনে 'পেডোফিলিয়া' নামের যে ভয়ংকর মানসিক বিকারগ্রস্ততা লুকিয়ে আছে, তা এখনো আমরা স্বীকারই করছি না।
পেডোফিলিয়া কেবল যৌন নিপীড়ন না, এটি চিকিৎসাবিজ্ঞান স্বীকৃত একটি মানসিক রোগ। বয়ঃসন্ধিকালে না পৌঁছানো শিশুদের প্রতি এই বিকারে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যৌন আকর্ষণ বোধ করে। এটি একরকম 'অসুস্থতা' হলেও এর জন্য কাউকে দায়মুক্তি দেওয়ার সুযোগ নেই।
তবে এই মানসিক বিকৃতি কীভাবে কাজ করে তা বোঝার প্রয়োজন আছে—যাতে আমরা কার্যকরভাবে এই বিকারকে শনাক্ত ও মোকাবিলা করতে পারি।
এছাড়া সামাজিকভাবে 'পেডোফিলিয়া' নামের এই বিকার সম্পর্কে যে আমরা ঠিকমতো জানি বা বুঝি না এবং বুঝলেও এর বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস করি না—এই বাস্তবতা লুকানোরও উপায় নেই।
পেডোফাইলরা আমাদের কল্পনাপ্রসূত রাক্ষস-খোক্কস না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই শ্রেণির লোকজন শিশুদের আশেপাশেই থাকে—আত্মীয়, শিক্ষক বা প্রতিবেশীর রূপে। যে কারণে এদের অপরাধ শনাক্ত করা যেমন কঠিন, তাদের বিচারের মুখোমুখি করা আরও কঠিন।
নিউ হ্যাম্পশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অনুযায়ী, যৌনতা সংক্রান্ত নীরবতা ও ট্যাবুর কারণে অনেক জায়গায়, বিশেষ করে রক্ষণশীল ও ধর্মীয় রীতিনীতির মধ্যে থাকা সমাজব্যবস্থায় এ ধরনের অপরাধের ঝুঁকি বেশি থাকে। অনেক সমাজেই যৌন নিপীড়নের ব্যাপারে শিশুদের মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়। নিজের সন্তানের ট্রমার চেয়েও সামাজিক গ্লানিকে বেশি ভয় পান অভিভাবকেরা। পুলিশ এসব ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল থাকে না, আদালতেরও থাকে না দ্রুত বিচারের সদিচ্ছা।
এই বিবরণ হয়তো আপনার কাছে পরিচিত মনে হবে।
এমন অপরাধের ক্ষেত্রে আমরা নীরব থাকলেও অনেক দেশই এই সংকটকে আমলে এনে অপরাধীদের কঠিন শাস্তি দিচ্ছে। একজন যেন বারবার এই অপরাধ করতে না পারে, সেজন্য অপরাধীদের রাসায়নিকভাবে খোজা করে দেওয়ার মতো বিতর্কিত শাস্তিও দেয় অনেক দেশ।
সমাজকে নিরাপদ রাখতে যৌন নিপীড়কদের জেল থেকে ছাড়ার পর নজরদারির মধ্যে রাখাও অনেক দেশের আইনি প্রক্রিয়ার অংশ। নাগরিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ না করে কীভাবে মুক্তির পর এমন অপরাধীদের কড়া নজরদারির মধ্যে রাখা যায়, তা নিয়ে বর্তমানে বিতর্ক চলছে সুইজারল্যান্ডে।
এদিকে কিছু বিক্ষিপ্ত আইনি সংস্কার ছাড়া এ ব্যাপারে কিছুই করেনি বাংলাদেশ। ২০২০ সালে বিক্ষোভের মুখে ধর্ষণের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, পদ্ধতিগত সংস্কার ছাড়া এমন শাস্তির বিধান অপরাধের সংখ্যা কমাতে সাহায্য করবে না।
বেখেয়ালি তদন্ত ও আদালতে মামলাজটের কারণে বিচার চাইতে যাওয়া ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে বারবার অপমানিত হয়েই ফিরতে হয়। এই আইনি ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় 'পেডোফিলিয়া' শব্দটা উচ্চারিতই হয় না।
অনলাইনে সারা বিশ্বের পেডোফাইলরা কীভাবে যোগাযোগ করে যৌন নিপীড়নের ছবি ও ভিডিও বিনিময় করে এবং কীভাবে ধরা না পড়ে অপরাধ চালিয়ে যাওয়ার পন্থা বাতলে দেয়, তা উঠে এসেছিল নিউইয়র্ক টাইমসের ২০১৯ সালের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।
বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকলেও সাইবার নিরাপত্তার প্রয়োগ সে অর্থে অপ্রতুল ও অনাধুনিক হওয়ায় এরকম আন্তর্জাতিক অপরাধচক্রের সহজ লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠছি আমরা। এর লক্ষণও ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে।
করণীয় কী?
প্রথমত, সবার আগে অবশ্যই এই সংকটকে স্বীকার করতে হবে এবং এর একটি নাম দিতে হবে। 'পেডোফিলিয়া' শব্দটিকে আমাদের জাতীয় নীতিনির্ধারণী আলোচনায় আনতে হবে। এটি শুধু নৈতিক স্খলন না, একটি মনোরোগজনিত হুমকিও। এর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক হস্তক্ষেপ জরুরি।
এ নিয়ে প্রচারণা চালাতে হবে—যাতে অভিভাবক, শিক্ষক ও শিশুরা সহজে পেডোফাইলদের আচরণ চিহ্নিত করতে পারে। পেডোফাইলরা কীভাবে শিশুদের আকর্ষণ করে তা নিয়ে গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে। স্কুলগুলোতে প্রশিক্ষিত কাউন্সেলর রাখতে হবে। এমনভাবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে যাতে শিশুদের গোপনীয়তা রক্ষা হয়। জবাবদিহির ব্যবস্থাও রাখতে হবে, যেন কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলে পাল্টা আঘাত না আসে।
দ্বিতীয়ত, বিচারব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। শিশু যৌন নির্যাতন সংক্রান্ত মামলাগুলো সংবেদনশীলতার সঙ্গে এবং বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় কীভাবে পরিচালনা করতে হয়, সে সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে বিচারক ও তদন্ত কর্মকর্তাদের। আনতে হবে আইনি সংস্কার। শিশু যৌন অপরাধে দণ্ডিতদের জন্য নজরদারির ব্যবস্থা—যেমন, বাধ্যতামূলক থেরাপি ও অনলাইন কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
এমন অপরাধে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহৃত বিভিন্ন শাস্তির উপযোগিতা নিয়ে সংসদে আলোচনা হওয়া জরুরি। তাহলে হয়তো দ্রুত একটি কার্যকরী সমাধানে পৌঁছানো যাবে।
তৃতীয়ত, এ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। বাংলাদেশে পেডোফিলিয়ার প্রবণতা কতটা বিস্তৃত, তা আমরা ঠিকমতো জানিই না। কারণ এ নিয়ে এখনো জাতীয় পর্যায়ের কোনো গবেষণা হয়নি।
তথ্যের এই অপ্রতুলতা কাকতালীয় না। এটি সামাজিক লজ্জাবোধ ও অস্বস্তির কারণে হয়েছে। অন্যান্য অনেক দেশের মতো আমাদেরও উচিত শিশু যৌন নির্যাতনের অভিযোগে দণ্ডিতদের সাক্ষাৎকার নেওয়া, তাদের আচরণ ও প্রবণতা নিয়ে গবেষণা করা—যাতে সমস্যাটির প্রকৃত রূপ ও গভীরতা বোঝা যায়।
সবশেষে, নিপীড়নের শিকার শিশুদের গল্প শুনতে হবে। কেবল যারা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে বা খবরের কাগজে এসেছে, শুধু তাদের ঘটনা জানলেই চলবে না। যেসব শিশু কখনো ভয়ে কাউকে কিছু বলেনি, তাদের কাছেও পৌঁছতে হবে।
প্রতিটি শিশুর ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে, থেরাপি পাওয়ার অধিকার আছে। তার নিপীড়ক বের হয়ে আর কোনো শিশুকে আঘাত করবে না—এই নিশ্চয়তা পাওয়ারও অধিকার আছে।
পেডোফিলিয়া কোনো পশ্চিমা সমস্যা না। এটি কেবল একাডেমিক জার্নালে আলোচনার বিষয়ও নয়।
এটি একটি বাস্তব সমস্যা। পেডোফাইলরা আমাদের চারপাশেই ঘুরোঘুরি করছে এবং এই ঘৃণ্য অপরাধীরা আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা, মানসিক সুস্থতা এবং অনেক ক্ষেত্রে জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এ ব্যাপারে আমাদের আর চোখ বন্ধ করে রাখার সুযোগ নেই। এই সংকট নিরসনে আমরা প্রস্তুত কি না—এই প্রশ্ন করে লাভ নেই। আসল প্রশ্ন হচ্ছে—আর কতজন শিশু নিপীড়নের শিকার হলে এই সংকটের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাধ্য হবো আমরা?
নাজিবা বাশার: সাংবাদিক, দ্য ডেইলি স্টার
Comments