ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আশঙ্কা

ডেঙ্গুতে মৃত্যু
ছবি: সংগৃহীত

সারাদেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। কীটতত্ত্ববিদরা সতর্ক করে বলেছেন গত জানুয়ারি মাস থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলায় এডিস মশার লার্ভার অস্বাভাবিক বেশি ঘনত্ব পাওয়া যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, যদি এখনই দ্রুত ও সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া না হয়, তাহলে বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু পরিস্থিতি বড় ধরনের স্বাস্থ্য সংকটে রূপ নিতে পারে।

ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখা গেলেও, কর্তৃপক্ষ বর্ষার আগে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নেওয়ায় শহর ও গ্রাম—দুই জায়গাতেই দ্রুত ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও গবেষকরা বলছেন, খুব দেরি হওয়ার আগেই মশা নিয়ন্ত্রণে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। নইলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, 'আমরা সারা দেশেই এডিস মশার লার্ভার উচ্চ ঘনত্ব দেখতে পাচ্ছি, যা এ বছর মারাত্মক ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের ইঙ্গিত দেয়।'

তিনি জানান, জানুয়ারির প্রথম দিকেই বরিশাল, বরগুনা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম এবং মানিকগঞ্জে উদ্বেগজনক হারে লার্ভার উচ্চ ঘনত্ব রেকর্ড করা হয়েছিল। এতে করেই বোঝা যাচ্ছিল যে বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

তিনি দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার ওপর জোর দিয়ে বলেন, 'সব ধরনের সরঞ্জাম ব্যবহার করে ডেঙ্গুর হটস্পটগুলোতে মশা নিধনে কাজ করতে হবে, একইসঙ্গে যেসব এলাকায় এখনো কোনো রোগী পাওয়া যায়নি, সেখানেও মশার প্রজনন উৎসগুলো ধ্বংস করতে হবে।'

তিনি ব্যক্তি উদ্যোগেও নিজ নিজ বাড়ি মশামুক্ত রাখার আহ্বান জানান।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এ পর্যন্ত ৭ হাজার ৭৭ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার বাইরেই আক্রান্তের সংখ্যা বেশি—৫ হাজার ৪৭১ জন। শুধু বরগুনা জেলাতেই ২ হাজার ৩৫টি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন।

এ বছর ডেঙ্গুতে মোট ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে ঢাকার বাইরেরই ১৩ জন।

রাজধানীর ডেঙ্গু পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক। সম্প্রতি প্রকাশিত এক সরকারি জরিপে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১৩টি ওয়ার্ডকে ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭টি এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৬টি ওয়ার্ড রয়েছে।

জরিপে মশার প্রজনন উৎস হিসেবে সিমেন্টের পানির ট্যাঙ্ককে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ (২২ শতাংশ) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, এরপরই রয়েছে পানি জমে থাকা মেঝে (২০ শতাংশ)।

অন্যান্য প্রজনন উৎসের মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিকের ড্রাম (১৩ শতাংশ), ওয়াটার মিটার চেম্বার (১১ শতাংশ), প্লাস্টিকের বালতি (১০ শতাংশ), ফুলের টব ও ট্রে/প্লাস্টিকের পাইপের গর্ত (৭ শতাংশ), পরিত্যক্ত টায়ার (৬ শতাংশ), বাড়ির ভেতরের পানির চ্যানেল (৫ শতাংশ) এবং সিমেন্টের প্লট (৪ শতাংশ)।

এই প্রাক-বর্ষা জরিপ অনুযায়ী, এডিস মশার লার্ভার সবচেয়ে বেশি ঘনত্ব (৫৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ) পাওয়া গেছে বহুতল ভবনগুলোতে।

ঘাটতি

কীটতত্ত্ববিদ জি এম সাইফুর রহমান ডেঙ্গুর ক্রমবর্ধমান সংকটের জন্য তিনটি প্রধান ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন। এগুলো হলো: বাধ্যতামূলক রিপোর্টিংয়ের অভাব, জাতীয় ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি না থাকা এবং মশা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনায় বিশেষজ্ঞদের না রাখা।

তিনি বলেন, 'ডেঙ্গু এখনো বাধ্যতামূলক রিপোর্ট করার মতো রোগ নয়, আর যেসব কেস নথিবদ্ধ করা হয় সেখানেও প্রায়ই সংক্রমণের উৎস উল্লেখ করা হয় না। এ ছাড়া কোথায় এডিস মশার সক্রিয় ঘনত্ব রয়েছে, তা শনাক্ত করার কোনো ব্যবস্থাও নেই—ফলে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।'

ঢাকায় আক্রান্তের সংখ্যা কম দেখা গেলেও, এটাকে বিভ্রান্তিকর মনে করছেন সাইফুর। তিনি বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক অনেকের ডেঙ্গুর লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে না। যাদের শরীরে ডেঙ্গুর লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে, তাদেরই তথ্য রিপোর্টে আসছে।

তিনি আরও বলেন, 'এই উপসর্গহীন, রিপোর্টবিহীন রোগীরাও নীরব বাহক হিসেবে কাজ করছেন, যা ভাইরাসকে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করছে।'

তিনি ডেঙ্গু পরিস্থিতি বোঝার জন্য দেশজুড়ে সেরো-সার্ভেলেন্সের (সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডির মাত্রা পরিমাপ) আহ্বান জানিয়েছেন। এর মাধ্যমে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করা যাবে এবং ভাইরাসের বিস্তার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে বলে মনে করেন তিনি।

'কার্যকরভাবে ডেঙ্গু মোকাবিলা করতে হলে মশার ডেনসিটি বোঝা খুবই জরুরি, কিন্তু বর্তমানে কোনো সক্রিয় নিয়ন্ত্রণ বা ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি নেই,' তিনি বলেন।

'এছাড়া, ডেঙ্গুর ক্লাস্টারগুলো (একই জায়গায় অনেক রোগী) প্রথমে চিহ্নিত না করলে সব জায়গায় এই ধরনের কর্মসূচি চালানোও অসম্ভব।'

তিনি মনে করেন ডেঙ্গুকে নোটিফায়েবল রোগ (যার তথ্য সরকারিভাবে জানানো বাধ্যতামূলক) করা উচিত, সংক্রমণের উৎসগুলো রিপোর্ট করা উচিত এবং পরিকল্পনা ও কার্যক্রমে কীটতত্ত্ববিদদের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।

তিনি বলেন, 'অনেক রোগী বাড়িতে চিকিৎসা নেন বলে তাদের তথ্য রিপোর্টে আসে না। তাই শুধু হাসপাতালের তথ্যই যথেষ্ট নয়।'

সরকারি উদ্যোগ

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ আজাজ জানান, ডেঙ্গু মোকাবিলায় দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রস্তুতি চলছে। ডিএনসিসির আওতাধীন সব হাসপাতালে ডেঙ্গু ইউনিট চালু করা হয়েছে এবং চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট প্রটোকল মেনে চলা হচ্ছে।

তিনি বলেন, 'আমরা স্কুলগুলোতে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করেছি, কারণ অনেক সংক্রমণ সেখান থেকেই শুরু হয়।" তিনি আরও জানান, হাসপাতালগুলোও ভালোভাবে পরিষ্কার করা হচ্ছে।

মশা মারার ওষুধ ছিটানো দিনে দুই বারের বদলে তিন বার করা হয়েছে এবং বিশেষ টিম সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাচ্ছে।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মেডিকেল ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) থেকে পাওয়া ক্লাস্টার তথ্য ব্যবহার করে মশক নিধন অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়া, ওয়ার্ড পর্যায়ের স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

মশা নিয়ন্ত্রণে নিয়ম ভঙ্গকারীদের জরিমানা বা ব্যবস্থা নিতে মাঠে রয়েছে চারটি মোবাইল কোর্ট।

এদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) গত ১১ জুন ওয়াসা ভবনে একটি জরুরি বৈঠক করেছে। প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে ১৪ জুন থেকে মশা নিধনে স্প্রে দ্বিগুণ করার এবং জোনভিত্তিক মনিটরিং টিম গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে, গত ১৫ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয়কে যেসব এলাকায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, সেখানে মশা নিধন ও পরিচ্ছন্নতা অভিযান জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছে।

স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ থেকে পাঠানো এক চিঠিতে তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক প্রচারণা চালানোরও সুপারিশ করা হয়েছে।

কলকাতায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ

ঢাকার বিপরীতে, কলকাতা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় এবং ডেটা-ভিত্তিক পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। ২০৬ দশমিক ২ বর্গ কিলোমিটারের এই শহরটিকে ১৪৪টি ওয়ার্ড এবং ১৬টি বরোতে ভাগ করা হয়েছে, যা পাঁচজন ভেক্টর ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাদের মধ্যে তিনজন পিএইচডি ডিগ্রিধারী।

কলকাতায় ডেঙ্গু মোকাবিলায় ৩২টি র‍্যাপিড অ্যাকশন টিম এবং ১৭০০ মাঠকর্মী ও ১৪৪০ জন সহায়ক কর্মী নিয়োগ করেছে। এই দলগুলো ওয়ার্ড-ভিত্তিক ডেটাবেইস তৈরি, সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো এবং জ্বরের কেসগুলো পর্যবেক্ষণ করার কাজ করে।

জানুয়ারি মাস থেকেই তারা কাজ শুরু করে দেয়। পুকুর, ট্যাঙ্ক, খোলা জায়গা ও নির্মাণাধীন স্থানগুলো তাদের প্রধান লক্ষ্য। ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেলেই স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রক্তের নমুনা নেওয়া হয়। ফলাফল মোবাইলে এসএমএস করে জানানো হয় এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টিম রোগীর বাড়িতে যায়। তারা আশেপাশের অন্তত ৫০টি বাড়িতে মশার ডিম পাড়ার জায়গা আছে কিনা, তা পরীক্ষা করে।

Comments

The Daily Star  | English

US at war with Iran's nuclear programme, not Iran: JD Vance

Iran's top security body to decide on Hormuz closure after parliament approval

12h ago