চামড়া শিল্প এগিয়ে যাচ্ছে তরুণ উদ্যোক্তাদের হাত ধরে

নবম বাংলাদেশ লেদার অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপো। ছবি: স্টার

রাজধানীর হাজারীবাগের ছোট কারখানা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া পর্যন্ত দেশের চামড়া শিল্প এগিয়ে যাচ্ছে তরুণ উদ্যোক্তাদের হাত ধরে। তারা এই খাতে জোগাচ্ছেন নতুন শক্তি।

প্রযুক্তিগত দক্ষতা, ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা চামড়া শিল্পে নতুন যুগের সূচনা করছেন।

এক সময় এই শিল্পকে পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে গণ্য করা হতো। ছিল কমপ্লায়েন্স সংকট। এখন তারা এই শিল্পকে নতুন সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।

সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) নবম বাংলাদেশ লেদার অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোতে সেই চিত্রই চোখে পড়ল।

তরুণ উদ্যোক্তাদের দৃঢ় সংকল্প ও উদ্ভাবনের অনুপ্রেরণামূলক গল্প হয়ে উঠেছিল আয়োজনটি।

তাদের একজন ডিয়ার লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী ফরিদা ইয়াসমিন বীথি।

লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক এই উদ্যোক্তা ২০২০ সালে তিন লাখ টাকা, দুটি মেশিন ও এক সহকারী নিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

আজ তিনি নয়জনের এক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বেল্ট, মানিব্যাগ, অফিস ব্যাগ, হ্যান্ডব্যাগ, জুতা ও স্যান্ডেল তৈরি হয় তার প্রতিষ্ঠানে। এসব পণ্য একসময় স্থানীয়রা কিনতেন। এখন মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে সেগুলো পৌঁছে যাচ্ছে মালয়েশিয়া ও ইতালিতে।

তার প্রতিষ্ঠান এখন প্রতি মাসে প্রায় ১২ লাখ টাকার চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন করছে। এই ব্যবসায় সম্ভাবনা দেখছেন তিনি। তার বিশ্বাস, এটি আরও বাড়তে থাকবে।

এ বছর প্রদর্শনীতে তিনি যোগ দিলেন তৃতীয়বারের মতো। ফরিদা ইয়াসমিন বীথি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই আয়োজন আমাদের মতো ছোট উদ্যোক্তাদের বড় বাজারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে সহায়তা করছে।'

অপর উদ্যোক্তা হলেন থ্রি টেকের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মো. তাসনিম আলম শাহীন।

এই শিল্পে প্রায় দুই দশক ধরে কাজ করছেন তিনি। চেয়েছিলেন চামড়া প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা করতে। কিন্তু, পারিবারিক দায়বদ্ধতা তাকে ব্যবসার দিকে ঠেলে দেয়।

২০০৭ সালে পরিবারের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন থ্রি টেক।

নোভার্টিস থেকে আসা জ্যাকেটের অর্ডার তার সাফল্য এনে দেয়। এরপর কাজ করেন বাটার সঙ্গে।

প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ৩৫ জন কাজ করছেন। করোনার আগে বছরে রপ্তানি হতো দুই কোটি টাকার পণ্য।

মহামারির কারণে ব্যবসা কমে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে তাসনিম আলম শাহীন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তবে সঠিক নীতি ও মানের মাধ্যমে বাংলাদেশের চামড়া পণ্য বিশ্বব্যাপী সুনাম অর্জন করতে পারে।'

এ দিকে, আরলেন্স লেদারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাহমিনা আক্তার শাম্মীর অভিজ্ঞতা অন্যরকম।

তিনি ছিলেন বিশ্বব্যাংকের তৈরি পোশাকের বাইরে অন্যান্য পণ্যের দিকে মনোযোগ দেওয়া এক প্রকল্পের কর্মী। বৈশ্বিক সম্ভাবনা দেখে এখন তিনি চামড়া পণ্যের দিকে ঝুঁকেছেন।

তিনি ২০২৪ সালের গোড়ার দিকে ন্যূনতম বিনিয়োগ নিয়ে আরলেন্স লেদার চালু করেন। হাজারীবাগে তার ছোট কারখানা আছে। সেই কারখানার ব্যাকপ্যাক, ওয়ালেট ও অন্যান্য পণ্য পাইকারি ও খুচরা বিক্রি হয়। বায়িং হাউসের মাধ্যমে রপ্তানিও হয় সীমিত আকারে। এখন প্রতি মাসে পণ্য উৎপাদিত হয় প্রায় চার লাখ টাকার।

তাহমিনা আক্তার শাম্মী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মুনাফার টাকা আবার কারখানায় বিনিয়োগ করি। এই খাতে আমার সৃষ্টির স্বাধীনতা আছে। নিজের কিছু করার সুযোগ দিচ্ছে।'

লেদার টেকনোলজিতে পড়ালেখা করা গোলাম মুরসালিন কোলাজেন বাংলাদেশের ম্যানেজিং পার্টনার।

এই বিষয়ে বিএসসি ও এমএসসি ডিগ্রি লাভের পর মুরসালিন চীনা প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্সে চাকরি শুরু করেন। পরে তিনি একটি চীনা বায়িং হাউজে যোগ দেন।

২০১৭ সালে রপ্তানির জন্য চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবসা শুরু করেন তিনি। সেসব দিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার মূলধন ছিল আমার জ্ঞান ও শ্রম।'

কোলাজেন বাংলাদেশে এখন চারজন পার্টনার আছে। তারা সবাই লেদার টেকনোলজি নিয়ে পড়ালেখা করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানের পণ্য দেশি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিক্রির পাশাপাশি পোল্যান্ডেও রপ্তানি হয়।

২০২৩ সালে তারা বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চামড়াজাত পণ্য তৈরি করছেন। গোলাম মুরসালিন মনে করেন, 'মূল্য সংযোজনই ভবিষ্যৎ।'

তবে সংকটও আছে সঙ্গে—কাঁচা চামড়ার পচনশীলতা, দামের প্রতিযোগিতা ও রাসায়নিক পণ্য আমদানির কারণে উত্পাদন খরচ বেড়ে যায়।

তার ভাষ্য, 'আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া ও বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার অভাবের কারণে পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কঠিন হয়ে উঠেছে।'

সব মিলিয়ে চামড়াজাত পণ্য, জুতা, যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল রপ্তানিকারকসহ দেশি-বিদেশি ১৩০টির বেশি প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশ নিয়েছিল।

গত অর্থবছরে এই খাতে রপ্তানি হয়েছিল ৩৪৫ মিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরে ছিল ৩৫৩ মিলিয়ন ডলার।

বিটিএ'র সাধারণ সম্পাদক মো. মিজানুর রহমান চামড়াশিল্পে তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে আশাবাদী।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তরুণরা সুশিক্ষিত ও উদ্ভাবনী। তারা গুণমান, বৈশ্বিক প্রবণতা ও বাজারের চাহিদা বোঝেন। আমরা তাদের প্রবৃদ্ধি এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। তারা ভবিষ্যতে এই খাতের নেতৃত্ব দেবেন।'

Comments

The Daily Star  | English

‘Former anti-fascist allies now using autocratic tactics to block BNP’

Tarique says rivals fear party’s win, urges politics to be settled through votes

Now