জুলাই ৩২: জামায়াত নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন, ৬ সমন্বয়ক মুক্ত, বিক্ষোভে উত্তাল দেশ

শিক্ষার্থীদের ঘোষণা ছিল, রক্তিম এ জুলাইয়েই হাসিনার পতন নিশ্চিত করবে তারা। যে কারণে ৩১ জুলাইয়ের পর থেকে নতুনভাবে তারিখ গণনা শুরু করতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। সে হিসাবে পতন নিশ্চিত হওয়ার পর ফ্যাসিস্ট হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট ছিল '৩৬ জুলাই'; আজ ১ আগস্ট '৩২ জুলাই'।
এদিন ডিবি কার্যালয় থেকে মুক্তি পান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক। নিহতদের স্মরণে 'রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ' শিরোনামে কর্মসূচি পালন করা হয়। এর মধ্যেও কুমিল্লা, নারায়াণগঞ্জ ও বরিশালে সংঘাত আর রক্তপাত হয়।
এর পাশাপাশি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও বরিশালে শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের কর্মসূচি পালনে বাধা দেয় পুলিশ। ঢাকার মিন্টো রোডে ডিবি অফিসের সামনে 'বিক্ষুদ্ধ নাগরিক সমাজ'- এর ব্যানারে বিক্ষোভ করেন সচেতন নাগরিকদের একাংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ ও দোয়েল চত্বর এলাকায় অবস্থান নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
সেইসঙ্গে ফার্মগেটে শিক্ষার্থীদের নয় দফা দাবির সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেন দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ। আন্দোলন ঘিরে সব হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেন তারা।
একই দিনে কোটা আন্দোলনের মধ্যে 'সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের' অভিযোগ এনে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র শিবির এবং সব অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে আওয়ামী লীগ সরকার।
এদিনও আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ছাড়া পেয়ে হাসনাত বললেন—আন্দোলন চলবে
চব্বিশের ১ আগস্ট ছিল বৃহস্পতিবার। এদিন দুপুরে ডিবি হেফাজত থেকে ছয় সমন্বয়ককে তাদের পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
ছাড়া পেয়ে বিকেলেই সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ এ ফেসবুক পোস্টে বলেন, 'এই আন্দোলনে গ্রেপ্তার হওয়া শেষ ব্যক্তিটি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেউই মুক্ত নই। এই গণগ্রেপ্তার গণ ঘৃণার নামান্তর।
'আমাদের মুক্তি তখনই সম্পূর্ণ হবে, যখন এই আন্দোলনে গ্রেপ্তার হওয়া শেষ ব্যক্তিটিও মুক্তি পাবেন। এই গণ গ্রেপ্তার কেবল নিরপরাধ মানুষের অধিকার হরণ নয়, বরং আমাদের সমগ্র সমাজের উপর চাপিয়ে দেয়া একটি নিষ্ঠুরতার প্রতিফলন।'
হাসনাত আরও লেখেন, 'এটি মুক্তচিন্তা ও মানবাধিকারের প্রতি এক ভয়ানক আঘাত। আমাদের এই আন্দোলন শুধুমাত্র ব্যক্তির মুক্তির জন্য নয়, বরং বৈষম্য, নিপীড়ন, গণগ্রেপ্তার এবং ছাত্র নির্যাতনের বিরুদ্ধে।'
এদিন হাসনাতদের মুক্তির পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, শিক্ষার্থীরা সরকারের কাছে নিজেদের নিরাপত্তা চেয়েছিল। আজকে তারা নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই জানালে যেতে বাধা দেওয়া হয়নি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আটকের চেষ্টা, ছাড়িয়ে নিলেন শিক্ষকরা
'৩২ জুলাই' রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কোটা সংস্কারের আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে থেকে শিক্ষার্থীদের আটক করে নিয়ে যাওয়ার সময় শিক্ষকেরা তাদের ছাড়িয়ে নিতে গেলে এ ঘটনা ঘটে।
এ সময় এক সাংবাদিককে মারধর ও অপর এক সাংবাদিককে লাঞ্ছিত করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে এদিন মৌন মিছিল ছিল। মিছিলের ব্যানারে লেখা ছিল—'ছাত্র-জনতার খুনিদের প্রতিহত করুন'। মিছিলে শিক্ষকদের সঙ্গে কিছু শিক্ষার্থীও অংশ নেন। বেলা সোয়া ১১টার দিকে ক্যাম্পাসের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলকের সামনে থেকে মৌনমিছিল শুরু হয়ে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ শেষে আবার এসে সেখানে শেষ হয়। এ সময় বক্তব্য দিচ্ছিলেন শিক্ষকেরা।
এরই ফাঁকে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যরা তিন শিক্ষার্থীকে আটক করে নিয়ে যেতে থাকেন। পরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা তাদের বাঁচাতে পুলিশের কাছাকাছি আসেন। এ সময় শিক্ষকদের সঙ্গে পুলিশের পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মতো ধস্তাধস্তি হয়। পরে পুলিশের কাছ থেকে ওই শিক্ষার্থীদের ছিনিয়ে নেন শিক্ষকেরা। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরও উপস্থিত ছিলেন।
এই ঘটনার তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ–আল মামুন বলেন, 'আমাদের শিক্ষার্থীদের নিরাপদে যাওয়ার ব্যবস্থা আপনারা করবেন। যদি কোনো ছাত্রের গায়ে হাত পড়ে, আমরা কিন্তু এরপর আর কোনো দায়িত্ব নেব না। যদি আমাদের সহকর্মীদের গায়ে হাত পড়ে, এটা আমরা কিন্তু মেনে নেব না।'
একই বিভাগের আরেক অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন বলেন, 'এরা সাদা পোশাকের পুলিশ কি না, আমি জানি না। ... আমি তো চিনি না এদেরকে। ওরা তো বলেনি আমাকে, আমি ডিবি। ওরা তো বলেনি গোয়েন্দা, ওরা তো বলেনি আমি রাষ্ট্রের পুলিশ। তারা কারা, আমি তো চিনি না। আমি তো গুন্ডামি দেখলাম। আমি তো এখানে হাইজ্যাক করে ছেলেদের চ্যাংদোলা করে তুলে নিতে দেখলাম।'

আবু সাঈদের মৃত্যুর পুলিশি তদন্তের কোনো ভ্যালু নেই: সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী
রংপুরে নিহত শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যুর পুলিশি তদন্তের কোনো 'ভ্যালু' নেই বলে মন্তব্য করেন সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত।
সেদিন সচিবালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে আরাফাত বলেন, আবু সাঈদের মৃত্যুর তদন্তসহ কোনো তদন্তই রুটিন প্রসেসে হবে না। আমরা কোনো রুটিনে থাকব না। আমরা আন্তর্জাতিক তদন্ত করব। যা দেখছেন এগুলোর কোনো ভ্যালু নাই। সব কিছু আমরা নতুন করে তদন্ত করব।
আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করার কোনো পারমিশন পুলিশের ছিল না বলেও উল্লেখ করেন বর্তমানে পলাতক সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী। বলেন, 'তারা (পুলিশ) আইন ও সংবিধানের মধ্যে কাজ করে। তবে গ্রাউন্ডে ক্ষেত্র বিশেষে কেউ কেউ আইন ভেঙেছে। আমরা সেটি তদন্ত করে তাদেরও আইনের আওতায় আনব।'
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে 'দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ'- এর সংহতি
১ আগস্ট কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের নয় দফা দাবির সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ঢাকার ফার্মগেটে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করে দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ।
এদিন বৃষ্টির মধ্যেই জড়ো হন মঞ্চ, টিভি এবং চলচ্চিত্রের তারকা শিল্পীরা, যাদের মধ্যে ছিলেন আজমেরী হক বাঁধন, মোশাররফ করিম, সিয়াম আহমেদ।
অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন সমাবেশে বলেন, 'আমি এই দেশের বাসিন্দা। আমার বিদেশি কোন পাসপোর্ট নাই। আমি এই দেশেই থাকবো এবং এই দেশটা আমার। এই দেশটা আমরাই সংস্কার করব।
অভিনেতা মোশারফ করিম বলেন, 'যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তাতে আসলে ঘরে বসে থাকার মতো অবস্থা নাই। মোবাইলে এইসব জিনিস দেখতে দেখতে আমি অসুস্থ বোধ করছি।'
ছাত্রদের দাবিকে 'ন্যায্য' অভিহিত করে চিত্রনায়ক সিয়াম আহমেদ বলেন, 'ডেফিনিটলি আই অ্যাম উইথ দ্য স্টুডেন্টস (অবশ্যই আমি ছাত্রদের পাশে)। তারা তো অনৈতিক দাবি রাখে নাই যে, তাদেরকে এভাবে প্রান হারাইতে হবে।'
দুপুরে জনপ্রিয় ব্যান্ড নেমেসিসের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে বলা হয়, 'গত দুই সপ্তাহের প্রেক্ষাপটে এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমরা আর কখনোই জয় বাংলা কনসার্টে পারফর্ম করব না।'
বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগে জড়িতদের শাস্তি দাবি চলচ্চিত্র–নাটকের শিল্পীদের
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এদিন আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) পরিদর্শন করেন চলচ্চিত্র, নাটক ও সংগীতাঙ্গনের শিল্পী-পরিচালকরা। সকালে 'সকল সহিংসতার বিরুদ্ধে আমরা'—ব্যানারে তারা বিটিভি পরিদর্শন করেন।
এ সময় বিটিভিতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান শিল্পীরা। তারা বলেন, শিক্ষার্থীদের ঘরে ফিরে যাওয়া উচিত।
পরিদর্শনে যাওয়া শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান, সংসদ সদস্য ও অভিনেতা ফেরদৌস আহমেদ, অভিনয়শিল্পী সুজাতা আজিম, রিয়াজ আহমেদ, অরুণা বিশ্বাস, আজিজুল হাকিম, নিপুণ, শমী কায়সার, রোকেয়া প্রাচী, সুইটি, হৃদি হক, সোহানা সাবা, জ্যোতিকা জ্যোতি, সাজু খাদেম, চন্দন রেজা, সংগীতশিল্পী শুভ্র দেব, পরিচালক মুশফিকুর রহমান গুলজার, এস এ হক অলিক, খোরশেদ আলম খসরু প্রমুখ।
আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন হাসিনার
এদিনও ছাত্র-জনতার আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ঢাকায় আয়োজিত কৃষক লীগের এক সভায় হাসিনা বলেন, 'তাদের (ছাত্রদের) দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে, তারপরেও তারা সাধারণ মানুষের সেবা দেয়ার জায়গাগুলোয় আঘাত হেনেছে, অগ্নিসংযোগ করেছে। এটা কোন ধরনের আন্দোলন?'
হাসিনা আরও বলেন, 'যেখানে তাদের দাবির চেয়েও বেশি মেনে নেওয়া হয়েছে, সেখানে এ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার যৌক্তিকতা কী? কার স্বার্থে? কেন?'
জামায়াত নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপনে যা বলা হয়েছিল
এদিন জামায়াতে ইসলামী এবং এর অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা শাখা থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, 'আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া কয়েকটি মামলার রায়ে জামায়াতে ইসলামী এবং এর অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।'
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, 'যেহেতু সরকারের নিকট যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ রহিয়াছে যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং এর অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিককালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল।
'সেহেতু, সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ এর ধারা ১৮ (১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরসহ উহার সকল অঙ্গসংগঠনকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং উক্ত আইনের তফসিল-২ এ বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গসংগঠন নিষিদ্ধ সত্ত্বা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।'
Comments