আলাস্কায় আজ পুতিন-ট্রাম্পের বহুল প্রত্যাশিত বৈঠকে কার কী চাহিদা

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি: এএফপি
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি: এএফপি

দীর্ঘ প্রস্তুতির পর আজ যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঙ্গরাজ্যের অ্যাঙ্কারেজ শহরের এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসন যুগ্ম বিমানঘাঁটিতে ইউক্রেন যুদ্ধ অবসান নিয়ে বৈঠকে বসবেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

প্রায় চার বছর পর দুই দেশের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের মধ্যে বৈঠক হতে চলেছে। এই বৈঠককে ঘিরে রয়েছে পাহাড়সম প্রত্যাশার চাপ। তবে যুদ্ধ অবসান নিয়ে মস্কো, কিয়েভ ও ওয়াশিংটনের রয়েছে ভিন্ন চিন্তাধারা।

আজ শুক্রবার বার্তাসংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে এ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আগ্রাসন শুরুর পর এটাই কোনো পশ্চিমা দেশে পুতিনের প্রথম সফর। পাশাপাশি, গত ১০ বছরের মধ্যে এটা যুক্তরাষ্ট্রে পুতিনের প্রথম সফর। 

এই বৈঠক থেকে তিন দেশের তিন নেতার রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন প্রত্যাশা ও দাবি। 

পুতিনের চাহিদা

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই পশ্চিমে ব্রাত্য হয়ে পড়েন পুতিন। এই বৈঠক ও সম্মেলন তার জন্য একটি বিশেষ সুযোগ এনে দিয়েছে। সংঘাত বন্ধে রাশিয়ার কঠোর দাবিগুলোকে বৈধতা এনে দিতে পারে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক।

জুনে একটি খসড়া শান্তি চুক্তি প্রকাশ পায়। সেখানে ইউক্রেনকে খেরসন, লুহানস্ক, ঝাপোরিঝঝিয়া ও দনেৎস্ক অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছে। মস্কো এসব অঞ্চল অধিগ্রহণের দাবি করেছে।

রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। ছবি: এএফপি
রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। ছবি: এএফপি

তবে নিজেদের কোন ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে রাজি নিয় কিয়েভ।

রাশিয়ার অন্যান্য দাবির মধ্যে আছে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর ব্যারাকে ফিরে যাওয়া, ন্যাটো জোটে যোগ দেওয়ার আকাঙ্খা থেকে বের হয়ে আসা এবং পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করা। সমালোচকরা বলছেন, এসব দাবি ইউক্রেনকে নতজানু হয়ে 'আত্মসমর্পণ' করতে বলার সমতুল্য।

ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি, রাশিয়া ইউক্রেনে বসবাসরত রুশ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর 'অধিকার ও স্বাধীনতা' নিশ্চিত করা ও 'নাৎসিবাদকে গৌরবান্বিত' করার উদ্যোগ বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে। 

রাশিয়ার অপর দাবি, পশ্চিমা দেশগুলোর আরোপ করা সব ধরনের বিধিনিষেধ প্রত্যাহার।

আলাস্কার বিমানঘাঁটির সামনে সাংবাদিকদের আনাগোনা। ছবি: এএফপি
আলাস্কার বিমানঘাঁটির সামনে সাংবাদিকদের আনাগোনা। ছবি: এএফপি

ইউক্রেন বলেছে, নাৎসিবাদের চর্চার অভিযোগ অবাস্তব এবং দেশটি ইতোমধ্যেই রুশ ভাষাভাষীদের অধিকার নিশ্চিত করেছে।

জেলেনস্কির চাহিদা

মজার বিষয় হলো, 'ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার' এই বৈঠকে যোগ দেওয়ার দাওয়াত পাননি খোদ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। 'আমাকে ছাড়া কোনো শান্তি চুক্তি হতে পারে না', বলে হুঙ্কার দিয়েছেন জেলেনস্কি। পাশাপাশি, তিনি ওয়াশিংটন-মস্কোর বৈঠককে পুতিনের 'ব্যক্তিগত বিজয়' হিসেবে আখ্যা দেন।

ইউক্রেনের দাবি, যেকোনো শান্তি চুক্তির পূর্বশর্ত হলো অবিলম্বে স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথে যুদ্ধবিরতি চালু।

যুদ্ধের শুরু থেকেই কিয়েভ দাবি করে আসছে, মস্কো অবৈধভাবে ইউক্রেনের শিশুদের আটক করে নিজেদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ছবি: এএফপি
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ছবি: এএফপি

কিয়েভের দাবি, নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড থেকে হাজারো শিশুকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছে। তাদের অনেককে রুশ নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। অনেক রুশ পরিবার সেসব শিশুদের দত্তক নিয়েছে।

রাশিয়া এসব অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করলেও স্বীকার করেছে, তাদের ভূখণ্ডে হাজারো শিশু রয়েছে।

কিয়েভ ওই শিশুদেরসহ সকল যুদ্ধবন্দির মুক্তির দাবি জানিয়েছে।

রাশিয়া যাতে ভবিষ্যতে আর হামলা চালাতে না পারে, সে বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে হবে—এমন দাবি জানিয়েছে ইউক্রেন। শান্তি চুক্তিতেও বিষয়টির উল্লেখ থাকতে হবে। পাশাপাশি, ইউক্রেনের সেনাবাহিনীতে সদস্য কত হবে, সে বিষয়ে যাতে চুক্তিতে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা না হয়, সে দাবিও জানিয়েছেন জেলেনস্কি।

জেলেনস্কির মতে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে এক দফায় সব ধরনের বিধিনিষেধ উঠিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। ক্রমান্বয়ে এই উদ্যোগ নিতে হবে এবং প্রয়োজনে, যাতে আবারও তা আরোপ করা যায়, সে ব্যবস্থাও রাখতে হবে।

ট্রাম্পের চাহিদা

জানুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দেন, তিনি '২৪ ঘণ্টার' মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করবেন। কিন্তু সে সময় থেকে আট মাস চলে যাওয়ার পরও তার সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের পথে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়নি।

এই সময়টুকুতে ট্রাম্প বেশ কয়েকবার পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। পাশাপাশি, একাধিকবার ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ রাশিয়া সফরও করেছেন। কিন্তু ক্রেমলিনকে তাদের অনড় অবস্থান থেকে এক বিন্দুও সরাতে পারেননি ট্রাম্প বা তার প্রতিনিধিরা।

হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

তবে এই সম্মেলনে পুতিনের সঙ্গে সরাসরি আলাপ করে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর সুযোগ পাবেন ট্রাম্প।

সাবেক আবাসন ব্যবসায়ী ও নিজেকে 'চুক্তি বিশেষজ্ঞ' (ডিলমেকার) দাবি করা ট্রাম্প বুধবার বলেন, রাশিয়া যদি আগ্রাসন বন্ধ না করে, তাহলে তারা 'ভয়াবহ পরিণামের' মুখোমুখি হবে।

শুরুতে ট্রাম্প 'ইউক্রেনকে কিছুটা ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে হতে পারে' বলে দাবি করলেও পরবর্তীতে ইউরোপের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর সেই দাবি থেকে সরে আসেন তিনি। 

ট্রাম্প জানান, 'তিনি শিগগির যুদ্ধবিরতি দেখতে চান।'

আলাস্কায় ইউক্রেনের পক্ষে বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি
আলাস্কায় ইউক্রেনের পক্ষে বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি

তবে এই বৈঠক থেকে বড় কোনো সিদ্ধান্ত বের হয়ে আসবে অথবা যুগান্তকারী কোনো অর্জন পাবেন ট্রাম্প, এমনটা ভাবছে না হোয়াইট হাউস।

ট্রাম্পের জন্য এই বৈঠককে 'মনোযোগ দিয়ে শোনার' চর্চা হিসেবে অভিহিত করেছে হোয়াইট হাউস।

ট্রাম্প আভাস দিয়েছেন, একটি নয়, দুইটি বৈঠক হতে পারে, এবং দ্বিতীয়টিতে যোগ দিতে পারেন ইউক্রেনের সাবেক কমেডি তারকা থেকে প্রেসিডেন্ট পদে নিয়োগ পাওয়া নেতা জেলেনস্কি।

'যদি প্রথমটা ঠিকঠাকমতো শেষ হয়, তাহলে দ্রুত আমরা আরেকটি বৈঠকে যোগ দেব', বলেন ট্রাম্প।

ইউরোপের অবস্থান

ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেওয়া ও লাখো ইউক্রেনীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া সত্ত্বেও ইউরোপের নেতারা শান্তি আলোচনায় যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পাননি। এই বৈঠক ও পরবর্তী বৈঠকগুলো থেকে এমন একটি শান্তি চুক্তি উঠে আসতে পারে, যা এ অঞ্চলের ভবিষ্যত নিরাপত্তা অবকাঠামোকে প্রভাবিত করতে পারে।

ইস্তাম্বুলে রাশিয়া-ইউক্রেনের বৈঠক বা রিয়াদে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র বৈঠকেও আসন পাননি ইউরোপের কোনো নেতা। 

গত সপ্তাহে দেওয়া বিবৃতিতে ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ডের নেতারা এবং ইউরোপীয় কমিশন হুশিয়ারি দেয়, ইউক্রেনের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো অর্থপূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।

পুতিন, জেলেনস্কি ও ট্রাম্পের কোলাজ। ছবি: এএফপি
পুতিন, জেলেনস্কি ও ট্রাম্পের কোলাজ। ছবি: এএফপি

'ইউক্রেনের ভূখণ্ড নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে দরকষাকষির এখতিয়ার শুধু ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টেরই আছে', বলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ।

এর আগে মাখোঁ ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রয়োজনে ইউক্রেনকে সুরক্ষিত রাখতে শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েনের ইঙ্গিত দেন।

রাশিয়া এ বিষয়টিতে কড়া আপত্তি জানিয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English
LDC graduation

Graduation or deferral: Is Bangladesh ready for the post-LDC era?

It now needs to be decided whether Bangladesh should actively pursue a deferral of LDC graduation.

6h ago