স্থিতিশীলতা থাকলে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়ানো সম্ভব, প্রত্যাশা রপ্তানিকারকদের

বাংলাদেশ এ অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। প্রথম দেখায় ৬৩.৫ বিলিয়ন ডলারের এই লক্ষ্যটা বেশ উচ্চাভিলাষী মনে হলেও রপ্তানিকারকরা বলছেন, চ্যালেঞ্জটা বিদেশে নয়, বরং দেশের ভেতরেই।
তাদের দাবি, বিদেশি চাহিদা বা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা নিয়ে দুশ্চিন্তার চেয়ে আসল চ্যালেঞ্জ দেশের ভেতরেই।
ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, ব্যাংকগুলো যদি সহজে এলসি ছাড়ে, কারখানাগুলোতে গ্যাস-বিদ্যুতের নির্বিঘ্ন সরবরাহ থাকে এবং শুল্ক কর্তৃপক্ষ দ্রুত পণ্য ছাড়পত্র দেয়, তাহলে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব।
ব্যবসায়ীদের এই দাবি এতটাই জরুরি যে, লক্ষ্য ঘোষণার পরপরই সরকার অংশীজনদের সঙ্গে যৌথ বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছে।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানান, এ সপ্তাহে ২২টি খাতের রপ্তনিকারক, জ্বালানি খাত ও ব্যাংক খাতের কর্মকর্তাদের নিয়ে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা আছে।
৬৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যের মধ্যে ৫৫ বিলিয়ন ডলার পণ্য রপ্তানি থেকে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা গত বছরের তুলনায় ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। আর ৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার আসবে সেবা খাত থেকে, যা আগের বছরের চেয়ে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি।
মার্কিন শুল্কনীতির সাম্প্রতিক পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য বিশেষ করে পোশাক খাতে বাড়তি সুযোগ তৈরি করেছে। বাংলাদেশি পণ্যের ওপর এখন গড় শুল্ক হার ৩৬.৫ শতাংশ, যা প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় কম। ফলে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের জন্য একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে।
তবে হা-মিম গ্রুপের চেয়ারম্যান একে আজাদ বলেন, এই সুবিধার সঙ্গে কিছু জটিলতাও যুক্ত আছে।
তার ভাষ্য, 'হ্যাঁ, আমাদের সামনে সুযোগ আছে, তবে আমরা মূল্যচাপে পড়েছি। ক্রেতারা দরকষাকষি করছেন এবং শুল্কের বোঝা ভাগাভাগি করার প্রস্তাব দিচ্ছেন।'
এদিকে অন্য শীর্ষ রপ্তানিকারকরা একটি দেশের বাজারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার বিষয়ে সতর্ক করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রামের একজন রপ্তানিকারক বলেন, 'আগে আমরা নিয়মের হঠাৎ পরিবর্তনে হতাশ হয়েছি। আবারও নতুন কোনো সরকার মুহূর্তে শুল্ক সুবিধা বাতিল করতে পারে।'
অবশ্য দেশের বাইরে এসব সুবিধার পরও রপ্তানিকারকরা জোর দিয়ে বলেন, অভ্যন্তরীণ সমস্যা এখনও সবচেয়ে বড় হুমকি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, 'বিশ্ববাজারে চাহিদা আছে, আবার প্রতিযোগিতাও আছে। কিন্তু গ্যাসের অনিয়মিত সরবরাহ, হঠাৎ বিদ্যুৎ বিভ্রাট আর ভেঙে পড়া ব্যাংকিং ব্যবস্থার কারণে এলসি খোলা বিলম্বিত হলে, কীভাবে বাড়তি অর্ডার সামলাব?'
তবুও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি পণ্য সরবরাহের সক্ষমতা আছে বলে জানান তিনি।
শিল্পোদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, জ্বালানি সংকটে উৎপাদনে বাড়তি সময় লাগছে, খরচও বাড়ছে। টেক্সটাইল ও চামড়ার মতো বিদ্যুৎনির্ভর শিল্পের জন্য স্থিতিশীল জ্বালানি সরবরাহ না থাকলে লক্ষ্য পূরণ কঠিন হবে।
অন্যদিকে, ব্যাংক খাতের সংকট ও উচ্চ সুদের হার রপ্তানিকারকদের চাপে ফেলছে। তারা বলছেন, ব্যাংক ব্যবস্থায় সংস্কার ও সহজে সুলভ ঋণপ্রাপ্তির পথ খুলে দিতে হবে।
রপ্তানিকারকরা অনেকদিন ধরেই ব্যাংক ব্যবস্থায় সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছেন। তারা বলেছেন, ম্যূলস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি সংকোচনমূলক নীতি কেবল ব্যবসার খরচই বাড়িয়েছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাতকে ৪৪ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন আয়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে বোনা পোশাক থেকে ২০ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন এবং নিটওয়্যার থেকে ২৩ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্য।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের চাহিদা আছে। বিশেষ করে চীন ধীরে ধীরে নিম্নমানের পোশাক বাজার থেকে সরে যাচ্ছে। আমাদের দ্রুত সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং ডিজাইন বৈচিত্র্য আনতে হবে।'
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের লক্ষ্য ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার (৯ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি)। তবে এই খাতে মান নিয়ন্ত্রণ, কম দামের কাঁচা চামড়ার ওপর নির্ভরতা ও সাভার ট্যানারি শিল্পনগরীর দুর্বল অবকাঠামোকে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
জেনিস শুর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির খান বলেন, 'কাস্টমস যদি কেবল তাদের দায়িত্বটা পালন করে, অতিরিক্ত নজরদারি বা ঘুষের মাধ্যমে ব্যবসা ধ্বংস না করে, তাহলে আমি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারব।'
পাট রপ্তানি ৯ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে ৯০০ মিলিয়ন ডলার হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। এই খাতের উদ্যোগীরা ল্যাব টেস্টিং, গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু তারা ধীর অগ্রগতি এবং ভারতীয় বাজারে কঠিন প্রবেশাধিকার নিয়ে অভিযোগ করেছেন, যেখানে বাণিজ্য নীতি এখনও অস্থির।
সম্প্রতি, ভারত বাংলাদেশের পাটজাত পণ্যের ভারতীয় বাজারে প্রবেশে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
কৃষি খাতের জন্য এ অর্থবছরে ২২ দশমিক ৪ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যা মোট ১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার হবে। তবে গত তিন বছরে এই খাতের রপ্তানি কমেছে।
একজন রপ্তানিকারক বলেন, রপ্তানি বৃদ্ধির বড় অংশ ভারতের স্থলবন্দর পুনরায় খোলার ওপর নির্ভরশীল।
বিকেএমইএ সভাপতি হাতেম বলেন, 'উচ্চ লক্ষ্য ঠিক আছে। তবে এবার কঠোর পরিশ্রম শুরু করতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'যদি আমরা গ্যাস সংকট সমাধান করি, ব্যাংকিং ব্যবস্থা স্থিতিশীল করি এবং বন্দরের লজিস্টিক উন্নত করি, দেখবেন আমরা কেবল লক্ষ্য পূরণ করব না, বরং তা ছাড়িয়ে যাব।'
Comments