ঢাকায় বাড়বে আকাশচুম্বী ভবন, নগর পরিকল্পনাবিদদের উদ্বেগ

আবাসন ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবিতে সরকার রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায় ভবন নির্মাণে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে জনবহুল ঢাকা শহরে উঁচু ভবনের সংখ্যা বাড়বে। নির্মাতারা এখন আরও উঁচু টাওয়ার তৈরি করতে পারবেন।
বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) সংশোধনী অনুযায়ী, ঢাকার ৬৮টি অঞ্চলের অধিকাংশতে এফএআর ২০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
এফএআর হলো কোনো ভবনের মোট মেঝে এলাকা ও সেই জমির আকারের অনুপাত। যেমন এফএআর ২.০ মানে ওই ভবনের মোট মেঝে এলাকা জমির আকারের দ্বিগুণ।
উচ্চ এফএআর মানে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বেশি মানুষ বাস বা কাজ করতে পারবে। এটি তখন ওই এলাকার ট্রাফিক ও অবকাঠামোর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে।
সংশোধনীর খসড়া অনুযায়ী, খিলক্ষেত আবাসিক এলাকার এফএআর ২ থেকে বাড়িয়ে ৪.৪, মিরপুর ডিওএইচএস ২.৫ থেকে ৪.৮, বাড্ডা ২ থেকে ৩.৩, ফরিদাবাদ ২ থেকে ৩.১, রামপুরা ২ থেকে ৩.৫, মিরপুর ২.৮ থেকে ৩.৪, এবং বাসাবো-খিলগাঁও এলাকা ২ থেকে বাড়িয়ে ৩.৩ করা হয়েছে।
তবে গুলশান-বানানী ও ধানমণ্ডির মতো অভিযাত এলাকার জন্য সামান্য কমেছে, যথাক্রমে ৫.৭ থেকে ৫.৫ এবং ৫.১ থেকে কমিয়ে ৫ করা হয়েছে।
গত ১০ আগস্ট শিল্প মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্টেকহোল্ডার্স মিটিংয়ে নীতিগতভাবে খসড়া সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে।
তবে খসড় সংশোধনী নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, পরিবেশবিদ ও আবাসন ব্যবসায়ীরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
নগর পরিকল্পনাবিদরা সতর্ক করেছেন, এটি ঢাকার টেকসই উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। কারণ ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটারের শহরটি ইতোমধ্যে দুই কোটির বেশি মানুষের চাপ সহ্য করছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, এফএআর বাড়ানো মানে একটি আবাসন কোম্পানি আগের নিয়মের চেয়ে অনেক উঁচু ভবন তৈরি করতে পারবে।
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এখন খিলক্ষেত আবাসিক এলাকায় পাঁচ কাঠার প্লটে একজন ডেভেলপার পাঁচ তলা ভবন তৈরি করতে পারে। কিন্তু নতুন নিয়ম কার্যকর হলে, একই প্লটে তিনি নয় তলা ভবন বানাতে পারবেন।
'এমনিতেই ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি। শহরে প্রায়ই তীব্র যানজট হয় এবং বর্ষার সময় জলাবদ্ধতার মতো সমস্যায় পড়তে হয়। এফএআর বাড়লে এই সমস্যাগুলো আরও বাড়াবে,' বলেন তিনি।
আদিল মোহাম্মদ খান খসড়া চূড়ান্ত করার প্রযুক্তিগত কমিটির একজন সদস্যও।
তার ভাষ্য, 'অতিরিক্ত তলা নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হলে ইউটিলিটি পরিষেবার ওপর চাপ বাড়বে এবং ভবনের ভিতরে আলো ও বাতাসের চলাচল কমে যাবে।'
তিনি আরও বলেন, নগর পরিকল্পনাবিদরা শুরুতে এফএআর বাড়ানোর ধারণার বিরোধিতা করেছিল, তবে অন্য স্টেকহোল্ডারদের নীরবতায় তারা শেষ পর্যন্ত এটি মেনে নেন। বিশেষ করে আবাসন ব্যবসায়ীরা এটার পক্ষে ছিলেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) প্রাক্তন সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, ২০০৮ সালের বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন রুলসের অধীনে এফএআর অনেক বেশি ছিল। তাই এই আইনে ঢাকার অযথা ও অপ্রণীত উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ করতে ড্যাপ-২০২২ তৈরি করা হয়েছিল।
তিনি জানান, ড্যাপ-২০২২ এর উদ্দেশ্য ছিল পূর্বাচলকে আরেকটি উত্তরা বানতে না দেওয়া এবং ঢাকার নতুন ওয়ার্ডগুলো (৪২, ৪৩, ৪৪, ৪৫) যেন বাড্ডা, সেনপাড়া পর্বতা ও মিরবাগের মতো না হয়, তা নিশ্চিত করা।
তিনি উল্লেখ করেন, রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) ও ইন্সটিটিউট অফ আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ (আইএবি) যেভাবে চেয়েছিল তার চেয়ে সংশোধিত এফএআর কিছুটা ভালো।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ২৪ আগস্ট গেজেট প্রকাশের পর ড্যাপ সংশোধনের প্রচেষ্টা শুরু হয়। তখন আবাসন ব্যবসায়ী ও জমির মালিকরা এফএআরের বিরোধীতা করেন।
গত বছরের শেষের দিকে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) আবাসন ব্যবসায়ীদের চাপ ও লবিংয়ের পর ড্যাপ সংশোধনের খসড়া তৈরি শুরু করে।
গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর সরকার রাজউকের অধীনে ড্যাপ সংশোধনের প্রক্রিয়া তদারকির জন্য সাত সদস্যের একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করে।
এ বছরের মার্চে প্রস্তাবটি একটি মূল্যায়ন কমিটি পর্যালোচনা করে, যেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের সাতজন উপদেষ্টা ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। গতকাল তার নম্বরে একটি টেক্সট মেসেজ পাঠানো হলেও কোনো উত্তর দেননি।
জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, কিছু অংশীদারের জন্য ড্যাপ-২০২২ মেনে নেওয়া বেশ কঠিন ছিল, যার ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, 'বর্তমান ড্যাপের এফএআর নিয়ে রিহ্যাব আপত্তি করেছিল। রাজউকের উদ্যোগে সর্বশেষ সভায় বিভিন্ন পেশাদার সংস্থা মিলে নতুন এফএআরে একমত হয়েছে।'
সরকারের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে রিহ্যাব বলেছে, ইতোমধ্যে ড্যাপের সংশোধনী আনার সময় চলে এসেছে।
রিহ্যাবের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেছেন, 'এফএআরে কড়া নিয়ম থাকার কারণে আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্রকল্পের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়া যায় না, ফলে অনেক প্রকল্প চালানো কঠিন হয়ে যায়। এটি বাড়তে থাকা আবাসনের চাহিদা পূরণে সমস্যা তৈরি করে।'
তার ভাষ্য, 'এফএআর বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু আমরা ড্যাপের কিছু বিষয়ে এখনো সন্তুষ্ট নই।'
রাজউকের চিফ টাউন প্ল্যানার মো. আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, খসড়া এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ড্যাপ পরামর্শক কাউন্সিলে পাঠানো হবে।
তিনি বলেন, 'সংশোধিত পরিকল্পনায় প্রতি পাঁচ বছরে ড্যাপ আপডেট করার ব্যবস্থা আছে।'
'এটি সহজ করতে এক বছরের মধ্যে একটি প্রযুক্তিগত কমিটি গঠন করা হবে, যা রাজউককে ড্যাপ উন্নত করতে সাহায্য করবে,' বলেন তিনি
Comments