তিনি বেঁচে থাকবেন চিন্তা ও আদর্শে

যতীন সরকার

যতীন সরকার কলাকৈবল্যবাদী নন, সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা করতেন। নিজে সৃষ্টিশীল সাহিত্য করার চেষ্টা করেননি। অন্যের সাহিত্য পড়েছেন। সে সাহিত্য পড়ে নিঙড়ে বের করে এনেছেন মানব-জীবন।  তিনি ছিলেন প্রান্তজন।

জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারে ডেইলি স্টারকে বলেছেন, "আমি মার্কসীয় ডায়ালেক্টিকসে বিশ্বাস করি। আমি মনে করি প্রত্যেকটি বিষয়েরই অনেকগুলো ডাইমেনশন আছে। সেই ডাইমেনশনগুলো ধরতে হবে। মার্কস বলেছিলেন, দুনিয়াকে এ পর্যন্ত বিশ্লেষণ করা হচ্ছে কেবল। আসল কাজ হচ্ছে দুনিয়াকে বদলানো। "

সে বদলানোর কাজটা আর হয় নি তার পরিণত বয়সের একজীবনে।  কিন্তু জীবনের শেষ পর্যন্ত সে বদলানো বিষয়ে তাঁর আস্থা ছিলো।

যতীন সরকার ছিলেন পাড়-পাঠক। লেখক হবেন এমন চিন্তাভাবনা তার ছিলো না। পাঠক থাকা অবস্থায় জেলে যান। জেলে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় বেশ কজন রাজনীতিবিদের, যারা পরবর্তীকালে জাতীয় রাজনীতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন। তুনি সে পথে যান নি। শিক্ষক হিসেবেই জীবন কাটিয়ে দেন। তাঁর জ্ঞান-প্রজ্ঞা বাক্যস্ফূর্তিতে এঁরা সবাই মুগ্ধ।  তাঁরা তাঁকে বলেন, লিখতে। জেল থেকে বেরিয়ে পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়সে যতীন সরকার লেখেন প্রথম বই। 'সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা'। 

এ-বইয়ের বারটা প্রবন্ধে যতীন সরকার যে জীবন আবিষ্কার করেন সেটা বাংলাদেশের 'মূলধারা'র সাহিত্যের জন্য নতুন।  সাহিত্য তাঁর জমিন। তিনি কৃষক মানুষ, চাষ করেন মানুষের।  কোন মানুষের? যে মানুষ সমাজের সবচেয়ে বড় অংশ। কিন্তু মূলধারার সাহিত্যে যার অধিকার নেই। এ-প্রান্তজনের সখা যতীন সরকার।  এরাই তার আলোচনার প্রধান বিষয়। 

যতীন সরকার বাংলাদেশের মধ্যবর্গ রচিত, মধ্যবর্গ পঠিত সাহিত্যের ভেতর থেকে নিম্নবর্গের মানুষের স্বর বের করে আনার এক অসম্ভব সংগ্রামী চেষ্টায় নিয়োজিত করেন নিজেকে। এভাবেই তাঁর লেখায়, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে উঠে আসে লোকায়ত জীবন।  তিনি এদের সাহিত্যকে লোকসাহিত্য বলেন না। মূলধারার সাহিত্যের সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে চেষ্টা করেন।  লোকায়ত বলে নতুন করে উপস্থাপন করেন। এদের জীবনের প্রয়োজনে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সাম্য খুঁজে বেড়ান। বরুণের 'ঋত' ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম ছিলো এটি। এ-ঋত আর ফিরে আসে না আর। বাস্তবতা হলো আসার কথাও নয়।

দুই

যতীন সরকার রামপ্রসাদের 'এমন মানব জমিন রইলো পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা' — গানে নিঃস্বতার যে হাহাকার ও আর্তি খুঁজে পান তার প্রতিকারও বের করে আনেন। এ-গানের 'অপ্রাপ্তির দীর্ণতার' জন্য  'অন্যায় বিধির জোয়াল'কে দায়ী করেন। এ-বেদনা, এ-আর্তি আদতে সবার। তাই যতীন সরকার মনে করেন 'সমাজের অ-শিল্পী সদস্যরা, কৃষক, শ্রমিক, কারিগর, বিজ্ঞানী সবাই শিল্পীর চেতনার অংশদারত্ব নিয়ে একই দায়িত্বের বোঝা তুলে নিতে এগিয়ে আসতে পারে।' তিনি বাংলাদেশের উপন্যাসে খুঁজে বের করেছেন সাধারণ মানুষের তথা লোকায়ত কৃষক-চৈতন্য। 

সাতচল্লিশের দ্বিতীয় দেশভাগের কালে রচিত আবুল মনসুর আহমেদের 'জীবন ক্ষুধা' উপন্যাস থেকে তিনি খুঁজে বের করেন কৃষকের শ্রেণি-সচেতনতা।  এটা মালিক-শ্রমিকের ধ্রুপদী দ্বন্দ্বের মধ্যে নয়, যতীন সরকার উপন্যাসের উদ্ধৃতি ব্যবহার করে দেখান জমির মালিকানা, খাজনা, জমিদারের অত্যাচারের সঙ্গে সম্পর্কিত। হিন্দু-মুসলমান সঙ্কটটা দরিদ্র কৃষক কাসেমের প্রশ্ন নয়, মুসলিম লীগের নেতাদের ভোটের শ্লোগান মাত্র। 

হিন্দু-জমিদার মুসলমান-প্রজার সঙ্কটের চেয়ে কৃষকদের বেশি উদ্বেগ  জমির অধিকার, জমিদারের হাত থেকে নিষ্কৃতি কিংবা খাজনা মাফ পাওয়া। নতুন দেশ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, নতুন দেশ তাদের কি দিয়েছে — সেটা আলোচনার বিষয় নয় কিন্তু কৃষকরা নতুন পাকিস্তান কেন চেয়েছে সেটা তিনি বের করে দেখান। হিন্দু জমিদার সুরেন মিত্রের সংলাপ উদ্ধার করে যতীন সরকার দেখান শোষক-মনস্তত্ত্বের আরেক দিক। এভাবে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার সাহিত্যের দৃষ্টান্ত ব্যাখ্যা করেন তিনি। এর সঙ্গে আলোচনা করেন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার গ্রামীণ কবি ইউনুস আলীর হাটুরে কবিতা 'পাকিস্তানের কবিতা'। সে কবিতায় 'কৃষক সমাজের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি' 'ঢাকায় রাজধানী হবে উন্নতি হবে বাংলাদেশের ভাই/ হিন্দু মুসলিম মিলেমিশে থাকতে যেন পাই' — জাতীয় উচ্চারণে প্রকাশিত বলে মনে করেন।

যতীন সরকারের একটা সংকট ছিলো। তিনি মার্কসবাদী ছিলেন। তাই দেশের সমগ্র মানুষকে তিনি ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এর  সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বাংলাদেশের সাহিত্যের মূলধারা দেশের সমগ্র মানুষের নয়। এটা মধ্যবর্গের রচিত, মধ্যবর্গের পাঠ্য-সাহিত্য। 

তার দৃষ্টিভঙ্গি তাত্ত্বিক, দেখার চোখ সরল নয় সমালোচনামূলক। স্বাভাবিকভাবে তাতে তার দৃষ্টিকোণ, মার্কসবাদী পঠনপাঠন প্রভাববিস্তার করেছে। মহত্তম মানুষ তিনি। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, 'জীবিত আছি, বেঁচে নেই'। এসব রচনা আমাদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হবে আগামীতে। তাই তিনি বেঁচেও থাকবেন আগামীতে।

এ-সাহিত্য সরাসরি প্রধানত ইউরোপের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। এ-সাহিত্য অংশগ্রহণে,  উপস্থাপনে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না। আদতে এর মধ্যে ওদের প্রবেশাধিকারই নেই। তাই এদের সাহিত্যকে মূল সাহিত্যের সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ কৃত্রিম আরোপিত বলে মনে হতে পারে। একই ভাবের সম্প্রসারণ তিনি পরেও করেছেন। দেখা যাচ্ছে লালনকে যুক্ত করতে চেষ্টা করছেন কলকাতায় উনিশ শতকের আধুনিকতার সঙ্গে,  রেনেসাঁর সঙ্গে। দুটোর চৈতন্যগত, প্রকাশগত ফারাক এতো বেশি যে এ-সংযোগ আরোপিত হয়ে পড়েছে।

তিন
যতীন সরকার কথক ও লেখক। দুটো গুণের যুগলবন্দী একজনের মধ্যে সাধারণত ঘটে না। তিনি শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন।  তাই হয়েছেন। সেটা শুধু পেশা হিসেবে নয়। কিংবদন্তি তুল্য প্রসারতা লাভ করেছিলেন বাগ্মিতায়। তিনি বলেছেন, 'মাস্টারি ছাড়া যদি অন্য কিছু করতাম তাহলে আমার জীবিকার মধ্য দিয়ে জীবনের স্বস্তি ও তৃপ্তি আমি পেতে পারতাম বলে মনে করি না।' বেসরকারি কলেজের সামান্য চাকরিতে কমিটমেন্ট ছিলো তাঁর। 

মাস্টারিকে জীবিকা হিসেবে নেয়া খুবই কঠিন। এক 'ধরনের ধোঁয়াটে সম্মান' মানুষ দেখায়, তাতে 'আহা বেচারা' জাতীয় করুণাবোধ তিনি উপলব্ধি করেন। গ্রাজুয়েশনের পর তিনি মাস্টারি করছেন শুনে একজন তাঁকে বলেছে, 'একটা কাজ পেলে না বুঝি! ' আক্ষেপ করে বলছেন, মাস্টারিকে মানুষ কাজ বলেই মনে করে না। তিনি লক্ষ করেছেন, শিক্ষকদের সংগঠনগুলো শিক্ষার উন্নয়নের জন্য কোন কিছু ভাবে না। তারা  কেবল বেতন-ভাতা নিজেদের প্রাপ্তির আন্দোলনেই ব্যস্ত।  সে জন্য শিক্ষক-আন্দোলন থেকে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন।

দীর্ঘজীবী মানুষ ছিলেন যতীন সরকার। ২০১৮সালের পর থেকে আর তেমন কিছু লিখতে পারেন নি। এ নিয়ে মর্মপীড়া ছিলো তার। 'পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন,', 'ভুত দর্শন ' 'আদর্শ শিক্ষকের জন্য প্রত্যাশা', 'আমার শহর ময়মনসিংহ শ্রুতিতে স্মৃতিতে সত্তায়' জাতীয় স্মৃতিচারণামূলক রচনাগুলো আমাদের সামাজিক ইতিহাসের জন্য মূল্যবান দলিল হবে আগামীতে। তার দৃষ্টিভঙ্গি তাত্ত্বিক, দেখার চোখ সরল নয় সমালোচনামূলক। স্বাভাবিকভাবে তাতে তার দৃষ্টিকোণ, মার্কসবাদী পঠনপাঠন প্রভাববিস্তার করেছে। মহত্তম মানুষ তিনি। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, 'জীবিত আছি, বেঁচে নেই'। এসব রচনা আমাদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হবে আগামীতে। তাই তিনি বেঁচেও থাকবেন আগামীতে।

Comments

The Daily Star  | English

‘Comments of some parties raising questions in people’s mind’

Tarique calls for solidarity at Swechchhasebak Dal anniversary event

1h ago