রাখাইনে আবার সংঘর্ষ, নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে নতুন করে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে। এর জেরে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে আবারও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
শুক্রবার গভীর রাত থেকে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের বিপরীতে মিয়ানমারের গ্রামগুলোতে ব্যাপক গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, গত কয়েক মাসের মধ্যে এটিই ছিল সবচেয়ে তীব্র গোলাগুলির ঘটনা।
টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর মাঝি (রোহিঙ্গা নেতা) রাখাইনে থাকা তাদের স্বজনদের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, শুক্রবার রাত থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত হোয়াইক্যং সীমান্তের ওপারে আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর সংঘর্ষ হয়। তারা জানান, রাখাইনের বিভিন্ন অংশ পুনরুদ্ধারে মিয়ানমারের সেনারা প্রস্তুতি নিচ্ছে—এমন খবরের মধ্যেই গত এক মাসে এ নিয়ে চতুর্থবারের মতো এমন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল।
তাদের মতে, টেকনাফের জালিয়া দ্বীপের বিপরীতে মিয়ানমারের লালদিয়া এলাকায় ইতোমধ্যে ৪০০ থেকে ৭০০ রোহিঙ্গা তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন। তবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কড়া টহলের কারণে তারা ঢুকতে পারছেন না।
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সিরাজুল মোস্তফা বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত সীমান্তের ওপার থেকে তিনি গোলাগুলির শব্দ শুনেছেন। বিশেষ করে রাত ১১টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত ভারী অস্ত্রের গোলাবর্ষণে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুবাইর বলেন, 'মংডুতে মিয়ানমারের সেনা ও আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষের আশঙ্কায় বহু রোহিঙ্গা লালদিয়া এলাকায় জড়ো হয়েছে।' তিনি বলেন, এর আগের সংঘর্ষের সময় রোহিঙ্গা গ্রামগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। গোলাবর্ষণ ও বিমান হামলায় তখন বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে।
তিনি আরও বলেন, 'সেরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তির আগেই মানুষ পালাচ্ছে। যদি আবার লড়াই শুরু হয়, তাহলে বাংলাদেশে আবারও বড় আকারের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে।' জুবাইর আরও বলেন, সামরিক সংঘাতের পাশাপাশি আরাকান আর্মির চাঁদাবাজি ও হয়রানিও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করছে।
ক্যাম্প-২৭-এর কমিউনিটি লিডার মোহাম্মদ কামাল সীমান্তের ওপারে থাকা তার নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, শুক্রবার সকালে নৌবাহিনীর জাহাজে করে প্রায় ৩০০ সেনা দক্ষিণ মংডুতে এসে পৌঁছেছে। দুপুর ২টার দিকে তারা 'বিজিপি ক্যাম্প-৮' নামে পরিচিত আরাকান আর্মির একটি ঘাঁটিতে ড্রোন হামলা চালায়। এতে বেশ কয়েকজন নিহত হয় এবং বাকিরা কাছের পাহাড়ে পালিয়ে যায়।
কামাল বলেন, 'এই সংঘর্ষের পর স্থানীয় রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। লালদিয়ায় প্রায় ৭০০ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে এখন বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে।' টেকনাফের আরও তিনজন রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতাও দক্ষিণ মংডুতে সেনাদের উপস্থিতির কথা জানিয়েছেন। তবে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গার সংখ্যা ৪০০ থেকে ৭০০-এর মধ্যে হতে পারে বলে তারা ধারণা দেন।
তবে এসব দাবির সত্যতা স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, তিনি এ ধরনের কোনো খবর পাননি। তবে তার কার্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, বৃহস্পতিবার থেকে টেকনাফ সীমান্তে বিজিবির টহল বাড়ানো হয়েছে।
বিজিবি-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান হোয়াইক্যং সীমান্তের ওপারে শুক্রবার রাতে গোলাগুলির শব্দ শোনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মিয়ানমারের সেনাদের আনাগোনার বিষয়ে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'যতদূর জানি, তারা এখনও মংডু শহর থেকে দূরে আছে। তবে আরাকান আর্মির অবস্থানে বিমান হামলার খবর পাওয়া গেছে।'
তবে তিনি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কাকে 'দালালদের ছড়ানো গুজব' বলে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, 'আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি দালাল চক্র পরিস্থিতিকে অতিরঞ্জিত করে টাকা আদায় করতে চাইছে। আমরা ইতোমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছি।' তিনি আরও জানান, সীমান্তে কঠোর পাহারা রাখা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত বছরের থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমারের বাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। ডিসেম্বরের মধ্যে আরাকান আর্মি মংডু শহরতলীর নিয়ন্ত্রণ নেয়। বর্তমানে রাখাইনের ১৭টি শহরতলীর মধ্যে ১৪টি তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এসব এলাকার নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারে সামরিক বাহিনী সম্প্রতি নতুন করে অভিযান শুরু করেছে।
Comments