আসকের তথ্য

৭ মাসে শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে প্রায় ৭৫ শতাংশ

২০২৫ সালের প্রথম সাত মাসে দেশে শিশু ধর্ষণের ঘটনা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৭৫ শতাংশ বেড়েছে বলে উঠে এসেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যে।

আসকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাসের মধ্যে ৩০৬ জন মেয়েশিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে, যা ২০২৪ সালের একই সময়ে ছিল ১৭৫। এ সংখ্যা ইতোমধ্যেই গত পুরো বছরে রিপোর্ট হওয়া মোট ২৩৪টি ঘটনার তুলনায়ও অনেক বেশি।

ভুক্তভোগীদের বয়সের পরিসংখ্যান আরও ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। তাদের মধ্যে ৪৯ জনের বয়স ০ থেকে ৬ বছরের মধ্যে, ৯৪ জনের বয়স ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে এবং ১০৩ জন কিশোরী। ৬০টি ঘটনায় ভুক্তভোগীর বয়স উল্লেখ করা হয়নি।

এই বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। মার্চে ১০৬টি এবং এপ্রিলে ৬৪টি। গতবছর এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২৯ ও ২৪।

২৫১টি ঘটনার ক্ষেত্রে মামলা দায়ের করা হয়েছে, ফলে ৫৫টি শিশু সুবিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। একই সময়ে, ১২৯টি মেয় শিশু ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ জনের বয়স ০ থেকে ৬ বছরের মধ্যে, ৫৩ জনের বয়স ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে এবং ১২ জন কিশোরী। ২৯টি ক্ষেত্রে বয়স জানা যায়নি। এর মধ্যে মাত্র ৮৫টি ঘটনায় মামলা হয়েছে।

এ বছরের প্রথম সাত মাসে ৩০ জন ছেলে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১ জনের বয়স ০ থেকে ৬ বছর, ১৭ জনের ৭ থেকে ১২ বছর, এবং ১ জনের ১৩ থেকে ১৮ বছর। ১১টি ক্ষেত্রে বয়স প্রকাশ করা হয়নি।

এসব ঘটনার মাত্র ২০টিতে মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং তিনজন ছেলে শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। সাত মাসে ছেলে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা ২০২৪ সালে রিপোর্ট করা মোট ৩৬টি ঘটনার প্রায় কাছাকাছি।

শিশুরা অন্যান্য যৌন হয়রানিরও শিকার হয়েছে। ৪৯ জন মেয়েশিশু পথেঘাটে বখাটেদের দ্বারা উত্ত্যক্ত হয়েছে এবং ২২ জনকে শিক্ষকেরা যৌন হয়রানি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে, যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)-এর আইনি বিশেষজ্ঞ আয়েশা আক্তার বলেন সামাজিক কুসংস্কার, পারিবারিক চাপ এবং দুর্বল আইনি প্রক্রিয়ার কারণে অনেক ঘটনা রিপোর্ট হয় না বা অমীমাংসিত রয়ে যায়।

তদন্তে বিলম্ব এবং পারিবারিক প্রভাব ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করছে বলেও জানান তিনি।

নতুন অধ্যাদেশে শিশু ধর্ষণ অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল এবং তদন্ত ও মামলা নিষ্পত্তির জন্য সময়সীমা বাধ্যতামূলক করা হলেও, আইনি অস্পষ্টতা, মামলার অমিল এবং বয়স-সম্পর্কিত জটিলতার কারণে যথাযথ পদক্ষেপ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের সুরক্ষায় পূর্ণাঙ্গ আইন না থাকায় অনেকেই অভিযোগ করতে ভয় পান। পাশাপাশি তিনি ভুক্তভোগীদের উপর পুনরায় মানসিক আঘাত এড়াতে হাই কোর্টের 'টু-ফিঙ্গার টেস্ট' নিষিদ্ধকরণ সঠিকভাবে কার্যকর করার আহ্বান জানান।

তিনি বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সুশীল সমাজের সমন্বিত ও সামগ্রিক পদ্ধতির ওপর জোর দেন, যাতে দ্রুত ও আরও ধারাবাহিক আইনি ব্যবস্থা এবং শিশুদের জন্য উন্নত সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, দুর্বল আইনশৃঙ্খলা এবং জবাবদিহিতার অভাব অপরাধীদের আরও বেপরোয়া করে তুলছে।

তিনি বলেন, 'যখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দুর্বল থাকে এবং শাস্তির সম্ভাবনা কম থাকে, তখন অপরাধীরা আরও সাহসী হয়ে ওঠে।'

তিনি সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা, চরমপন্থী প্রভাব এবং মানসিক বিকৃতিকে এসব অপরাধ বৃদ্ধির পেছনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।

মাগুরায় আট বছর বয়সী শিশুকে ধর্ষণ ও হত্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, মূল অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হলেও, সহযোগীদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে, যা বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতাকে প্রকাশ করে।

তিনি কার্যকর নজরদারি ও দ্রুত বিচারের ওপর জোর দেন। 

'আমরা ভিকটিমদের নিয়ে কথা বলি কিন্তু আমাদের অপরাধীদের মনস্তত্ত্বও বোঝার চেষ্টা করতে হবে।'

তিনি ছেলেশিশু ধর্ষণের মামলার কম রিপোর্টিং এবং নীরবতার সংস্কৃতি ভাঙার প্রয়োজনীয়তার উপরও জোর দেন।

তিনি বলেন, 'পরিবার থেকে শুরু করে স্কুল-মাদ্রাসায় খোলামেলা আলোচনা জরুরি। সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের এগিয়ে আসা উচিত। এক্ষেত্রে মহল্লাভিত্তিক শিশু সুরক্ষা কমিটি কার্যকর হতে পারে।'

পরিবারের ভূমিকা সম্পর্কে ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা বলেন, নির্যাতন প্রতিরোধে পরিবারের শক্তিশালী নির্দেশনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, 'বাড়িতে শিশুদের ব্যক্তিগত সীমারেখা ও অন্যের প্রতি সম্মান শেখানো হলে তাদের ওপর নির্যাতনের ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়। সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপের আগে পরিবারের সঠিক দিকনির্দেশনাই হলো প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।'

তিনি আরও বলেন, শিশু সুরক্ষায় স্কুলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই পাঠ্যক্রমে সেফটি এডুকেশন অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

তিনি যোগ করেন, শিক্ষকদের যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে যেন তারা শিশুদের সুরক্ষায় সচেতন ভূমিকা রাখতে পারেন। পাশাপাশি সচেতনতামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে এসব বার্তা পরিবার ও সমাজে আরও জোরালোভাবে পৌঁছে দিতে হবে।

Comments