ডাকসু নির্বাচন

বিরাজনীতিকরণ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি ও একাডেমির মধ্যে ভারসাম্য আনতে চাই: সাদিক কায়েম

আবু সাদিক কায়েম। ছবি: স্টার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থেকে একাডেমিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করে শিক্ষা ও রাজনীতির মধ্যে ভারসাম্য আনতে চান আসন্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের সহ-সভাপতি (ভিপি) পদপ্রার্থী আবু সাদিক কায়েম।

দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ছাত্রশিবিরের এই কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক বলেন, অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে।

তিনি বলেন, 'রাজনীতি ছাড়া আর কোনো অর্জন না থাকলে এটাকে বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় না। আমি চাই ঢাবিকে পলিটিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে একাডেমিক ইনস্টিটিউটে পরিণত করতে। তার মানে এই নয় যে বিরাজনীতিকরণ করতে হবে। অবশ্যই রাজনীতি লাগবে, কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে তার একটা ভারসাম্য থাকতে হবে।'

'আমি ডাকসু নির্বাচনে জয়ী হলে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রশাসনকে বাধ্য করব,' বলেন ছাত্রশিবির সমর্থিত 'ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট' প্যানেলের এই ভিপি প্রার্থী।

এই প্যানেলে নানা বৈচিত্র্যের শিক্ষার্থীদের বাছাই করে একটি ইনক্লুসিভ প্যানেল তৈরি করা হয়েছে বলে মনে করেন সাদিক কায়েম। প্রার্থীরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে যথেষ্ট দক্ষ ও যোগ্য বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, 'এখানে চাকমা শিক্ষার্থী, শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জড শিক্ষার্থী, হিজাবি ও নন-হিজাবি নারী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। সম্পাদক পদে নিজস্ব দক্ষতা ও পোর্টফোলিও অনুযায়ী প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। আছেন জাতীয় পর্যায়ের ক্রীড়াবিদ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যকর্মী, গবেষক।'

'শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া ও অংশগ্রহণ, বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের উৎসাহ আশাবাদ বাড়িয়েছে। জুলাই বিপ্লব যেমন ঐক্যের বার্তা দিয়েছে, ঠিক তেমনভাবেই আমাদের প্যানেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমন্বিত বার্তা দিতে চায়,' বলেন সাদিক কায়েম।

তবে, শিবিরনেতা সাদিক কায়েমের চেয়ে ব্যক্তি ও ঢাবি শিক্ষার্থী হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা তাকে এগিয়ে রাখবে বলে মনে করেন তিনি। 'একটা নির্দিষ্ট বর্গ বা আদর্শ আমার কাছে মুখ্য না। জুলাই আন্দোলনে ছাত্রশিবিরের পাশাপাশি আরও অসংখ্য সংগঠনের সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম। এখানে ডানপন্থী-বামপন্থী-মধ্যমপন্থী সব ধরনের মানুষ আছেন। ডাকসুতে কাজ করতেও সবাইকে ধারণ করে কাজ করতে হবে। আমার মূল পরিচয় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী এবং জুলাইয়ের একজন একটিভিস্ট,' বলেন সাদিক কায়েম।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও রাজনীতির ভারসাম্য আনতে বেশকিছু পরিকল্পনাও সাজিয়েছেন তিনি। বলেন, 'আমি একদম গোড়ায় হাত দিতে চাই। অর্থাৎ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ যেহেতু নতুন জ্ঞান উৎপাদন করা, তাই আমি জ্ঞানের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তুলব। এজন্য প্রয়োজন মেধা ও গবেষণার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি, শিক্ষকদের মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা, গবেষণার বাজেট বাড়ানো, লাইব্রেরি ও ল্যাবের আধুনিকায়ন, বন্ধ ই-লাইব্রেরি পুনরায় চালু, স্কলারশিপ চালু, নতুন হল নির্মাণ, খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা জোরদার, যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ সেল কার্যকর করা ইত্যাদি। আমি মনে করি শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলেই বাকি সমস্যাগুলো ধাপে ধাপে ঠিক হয়ে যাবে।'

হলভিত্তিক রাজনীতি প্রসঙ্গে সাদিক কায়েম বলেন, 'জুলাই আন্দোলনের পর শিক্ষার্থীরা যে বার্তা দিয়েছে, তা হলো তারা আর প্রচলিত সংগঠনভিত্তিক ও কমিটিনির্ভর ছাত্ররাজনীতি চায় না। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মতামত নেওয়া যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক মেইল ব্যবহার করে সার্ভে করা যেতে পারে—সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীর মতোই হবে রাজনীতির ভিত্তি।'

'আমি মনে করি যেহেতু মাত্র ১০–১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, তাই সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে রাজনীতি চর্চা চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষার্থীদের স্বার্থবিরোধী হবে। বিরাজনীতিকরণ বা একক দলীয় আধিপত্য নয়, বরং কনসেন্সাসের ভিত্তিতে এটার সমাধান হওয়া উচিত,' যোগ করেন তিনি।

নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশ প্রসঙ্গে এই ভিপি প্রার্থী বলেন, 'শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে আমি আশাবাদী। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের অপেশাদার আচরণ আমাদের উদ্বিগ্ন করছে। অভিযোগ রয়েছে, কমিশন, প্রক্টর ও প্রভোস্টরা একটি নির্দিষ্ট দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং সেই দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহায়তা করছেন। আমি মনে করি সারাদেশের মানুষ ডাকসু নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছেন। শিক্ষকরা দলীয় অবস্থান নয়, পেশাদারত্ব বজায় রেখে নির্বাচনকে মুক্ত, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য করতে দায়িত্ব পালন করলে তা সারাদেশের জন্য গণতন্ত্রের স্থায়ী উদাহরণ হতে পারে।'

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে প্রতিপক্ষের ঘায়েলের চেষ্টাকে 'অবান্তর ও বিভাজনমূলক আচরণ' বলে মন্তব্য করেন ছাত্রশিবিরের এই কেন্দ্রীয় নেতা। তিনি বলেন, '১৯৭১ আমাদের অস্তিত্ব, ১৯৭১ এ আমরা বাংলাদেশ ভূখণ্ড পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের শহীদরা আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তান। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রশ্নে আমরা কখনো আপস করিনি। বরং সাম্প্রতিক জুলাই আন্দোলনের মতো সবচেয়ে ক্রুশিয়াল সময়ে আমরা আমাদের অবস্থান প্রমাণ করেছি। সুতরাং একাত্তরকে ঘিরে আমাদের ওপর প্রশ্ন তোলা আসলে একটি বিভাজনমূলক আচরণ ছাড়া আর কিছু নয়।'

'আমি কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করি না। আমি মনে করি আমরা যারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি, সবাই সহযোদ্ধা, আমরা নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে চাই। আর এই বাংলাদেশের সূচনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই হবে,' যোগ করেন তিনি।

নির্বাচনী প্রচারণার বাজেট সম্পর্কে জানতে চাইলে ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম বলেন, 'আমরা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করছি প্রচারণা চালাতে। এর বাইরে ছাত্রশিবিরের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আয়ের কিছু উৎস আছে, সেই আয়, অ্যালামনাইদের সহযোগিতা নিয়ে যতটুকু পারছি চেষ্টা করছি।'

'ভোটারদের উদ্দেশে বলতে চাই গত ১০০ বছরে আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যাশিত একাডেমিক এনভায়রনমেন্ট তৈরি করতে পারিনি আমাদের সামষ্টিক ব্যর্থতার কারণে। জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী আমাদের ঐতিহাসিক একটা সুযোগ এসেছে। সময় এসেছে সঠিক নেতৃত্ব বাছাইয়ের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পলিটিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে একাডেমিক ইনস্টিটিউটে রূপান্তর করে স্বপ্নের ক্যাম্পাস বিনির্মাণের,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
Election in Bangladesh

Why are we trying to make the election uncertain?

Those who are working to prevent the election should question themselves as to how the people will be empowered without one.

6h ago