অর্থমন্ত্রীর ‘রাবিশ’ যুক্তি
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় গত মঙ্গলবার প্রকাশের পর আজ শনিবার পর্যন্ত আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক কোন মন্তব্য করেননি। তবে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আদালতের উপর নিজের ক্ষোভ চাপা রাখতে পারলেন না। শুক্রবার তার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তিনি যা বলেছেন তাতে কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। রাগের মাথায় বলা কথায় যে যুক্তির কমতি থাকে, অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, “ষোড়শ সংশোধনী জাতীয় সংসদে আবার পাস করা হবে। আদালত যতবার ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করবেন, ততবারই সংসদে পাস করা হবে।”
তার এ বক্তব্যে তীব্র অসন্তোষ আছে, কিন্তু যুক্তি আছে কতটা?
একটু পিছন ফিরে দেখা যাক। ২০১১ সালে আদালত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পর সরকার সেই রায় বাস্তবায়ন করতে তিন সপ্তাহের বেশি সময় নেয়নি। রায়ের পূর্ণ কপি প্রকাশের আগেই সরকার ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে চালু করা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। সরকার এত বেশি তাড়াহুড়া করে যে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ২০১১ সালের জুন মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়। সে সময় সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত সংসদীয় বিশেষ কমিটি অবশ্য দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে মতামত দিয়েছিল। আদালতের পূর্ণ রায়েও বলা হয় যে সংসদ চাইলে দশম এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখতে পারে।
তবে সে সময় সরকারের নীতি নির্ধারকেরা বার বার যুক্তি দেখান, যা আদালত কর্তৃক অবৈধ ঘোষিত হয়েছে, তা সংবিধানে বহাল রাখা যায় না। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাঁচিয়ে রাখার পক্ষে কোন যুক্তি হালে পানি পায়নি। এ ব্যবস্থা বাতিলের ফলে আওয়ামী লীগ গত নির্বাচনের সময় ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পায়। ফলাফল--রাজনৈতিক সংকট; বড় একটা জোটের নির্বাচন বর্জন; ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন।
এখন কি তবে অর্থমন্ত্রীর সরকার আদালত কর্তৃক অবৈধ ঘোষিত ষোড়শ সংশোধনী সংবিধানে আবার পুনর্বহাল করবেন? পক্ষে কী কী যুক্তি দেখাবে সরকার? ২০১১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাঁচিয়ে না রাখার পক্ষে যেসব যুক্তি দেওয়া হয়েছিল সেসব কি তার সরকার ভুলে যাবে?
আরও পড়ুন: বিচারপতি অপসারণে সংসদের ক্ষমতা ‘ইতিহাসের দুর্ঘটনা’!
অবশ্য অর্থমন্ত্রী নিজে কিছু যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলছেন, “জাতীয় সংসদ আইন সভা। সবার ঊর্ধ্বে তার অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধানে এ অধিকার জাতীয় সংসদকে দেওয়া হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “সামরিক সরকার এ অধিকার খর্ব করেছিল বিধায়, সংসদে পুনরায় তা ফিরিয়ে আনা হয়েছে।”
তিনি বলেছেন, “বিচারকরা জনগণের প্রতিনিধিদের ওপর খবরদারি করেন। আমরা তাদের নিয়োগ দেই। বিচারকদের এমন আচরণ ঠিক নয়।”
অর্থমন্ত্রীর দাবিগুলো একটা একটা করে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। জাতীয় সংসদ দেশের আইন সভা—এ বিষয়ে কেউ কোনদিন দ্বিমত করবে না। কিন্তু তিনি কোথায় পেলেন যে সংবিধান জাতীয় সংসদকে সবার ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছে? আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রয়োগে সংসদ সংবিধানের অধীন এবং দায়বদ্ধ। সংসদ যেকোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে না। সংসদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। সংসদ সংবিধানের কোনো বিধান বা জনগণের মৌলিক অধিকার পরিপন্থি আইন প্রণয়ন করতে পারে না। করলে সেটা বাতিল হবে। অতীতে কয়েকটি সংবিধান সংশোধনী আইন এবং সাধারণ আইন বাতিল হয়েছে, কারণ সেগুলো সংবিধান পরিপন্থি ছিল। সেগুলো কে বাতিল করেছে? অবশ্যই আদালত বাতিল ঘোষণা করেছেন। সংবিধান আদালতকে সে ক্ষমতা দিয়েছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, অর্থমন্ত্রীর দাবি মোতাবেক সংবিধান সংসদকে সবার ঊর্ধ্বে স্থান দেয়নি। আবার সংবিধান নিজেই বিচারকদের “জনগণের প্রতিনিধিদের ওপর খবরদারি” করার ক্ষমতা এবং দায়িত্ব দিয়েছে। কয়েকটি সংবিধান সংশোধনী এবং সাধারণ আইন আদালত কর্তৃক বাতিল হওয়াটা তার প্রমাণ। তাহলে বিচারকদের “এমন আচরণ ঠিক নয়” বলে অর্থমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্য সঠিক নয়। আর “আমরা তাদের নিয়োগ দেই” এমন বক্তব্যের মাধ্যমে অর্থমন্ত্রী বিচারপতিদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার চেষ্টা করেছেন বলেও কেউ মনে করতেই পারেন।
অর্থমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধানে জাতীয় সংসদকে উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণের অধিকার দেওয়া হয়েছে এবং সামরিক সরকার এ অধিকার খর্ব করেছিল বিধায়, সংসদে পুনরায় তা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তার এ দাবিতে একটা মস্ত বড় তথ্যগত বিভ্রান্তি আছে। এটা ঠিক যে ১৯৭২ সালের সংবিধানে সংসদকে উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণের অধিকার দেওয়া হয়েছিল। তবে সে ক্ষমতা কোন সামরিক সরকার কেড়ে নেয়নি। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকার চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদের সে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল। রাষ্ট্রপতিকে সে ক্ষমতা দেয়া হয়। পরে ১৯৭৮ সালে সামরিক সরকার বিচারপতি অপসারণে রাষ্ট্রপতির সেই ক্ষমতা বাতিল করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে ক্ষমতা দেয়া হয়। ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানকে সংবিধানে পুনঃস্থাপন করেন। কিন্তু তিন বছর পরই সরকার তার মত পাল্টায়। ২০১৪ সালে সংবিধান ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান বাতিল করে, বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক এ সংশোধনী বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করা হয়। কেননা এ সংশোধনী সংবিধানের মৌলিক কাঠামো তথা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পরিপন্থি।
কোন আইনি তর্ক না করে যদি মেনে নেই যে, বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছেই থাকা উচিত, তাহলেই কী সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? মাননীয় অর্থমন্ত্রীর হাত অনেক শক্তিশালী হবে? তিনি কি সোনালি ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক থেকে লুটপাট হয়ে যাওয়া টাকা উদ্ধার করতে সংসদের অনেক সহযোগিতা পাবেন? ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারবেন? কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চুরি যাওয়া রিজার্ভ ফেরত আনতে পারবেন? বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে না থাকলে কি দেশের শাসন ব্যবস্থা উন্নত করা সম্ভব নয়? আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা দুরূহ?
ষোড়শ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে আদালতে রিটকারী আইনজীবীদের অন্যতম মনজিল মোরশেদ অবশ্য অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যর জবাব দিয়েছেন। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যর পরদিন শনিবার সিলেটের আদালতপাড়ায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, “অর্থমন্ত্রী যা বলেছেন, তা অন্তঃসারশূন্য, সংবিধান ও আদালত পরিপন্থি। সরকার চাইলেও এ বিষয়ে নতুন কোন আইন করতে পারবে না।” সংবিধান সম্পর্কে “ধারণা না থাকায়” অর্থমন্ত্রী এমন বক্তব্য দিয়েছেন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
ইংরেজি ‘রাবিশ’ শব্দটা অর্থমন্ত্রীর বোধ হয় অনেক প্রিয়। কারো কোনো দাবি, যুক্তি, বক্তব্য অপছন্দ হলে তিনি বলেন, রাবিশ। গত সাত আট বছরে অনেকবার তিনি শব্দটা ব্যবহার করেছেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পর আদালতের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করতে তিনি “ষোড়শ সংশোধনী জাতীয় সংসদে আবার পাস করা হবে; আদালত যতবার ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করবেন, ততবারই সংসদে পাস করা হবে”-যে অযৌক্তিক বক্তব্য দিয়েছেন, ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে যেসব বিভ্রান্তিকর যুক্তির কথা বলেছেন তার পরে কেউ অর্থমন্ত্রীর প্রিয় শব্দটি ধার করে বলতেই পারেন, রাবিশ!
Comments