কেন টি-টোয়েন্টিতে ফিরবেন মাশরাফি

দেশের ক্রিকেটে প্রসঙ্গটি আবার আলোচিত। কারণ নতুন করে বোর্ড সভাপতি মাশরাফিকে টি-টোয়েন্টিতে ফিরতে বলছেন। না ফিরলে অভিমান ঝরছে তার কণ্ঠে। যেন মাশরাফির নিজের কোন ইচ্ছে থাকতে নেই।
Mashrafee Mortaza
ছবি: ফিরোজ আহমেদ (ফাইল)

২০১৭ সালের ৪ এপ্রিল। কলম্বোর প্রেমেদাসা স্টেডিয়ামে হঠাৎ স্তম্ভিত বাংলাদেশ। হাজার মাইল দূরে টিভি পর্দায় দেশের লোকজনও তখন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে। কি দেখাচ্ছে টিভিতে? কি ভেসে উঠল ফেসবুকের পাতায়? মাশরাফি বিন মর্তুজা সত্যিই আর খেলবেন না টি-টোয়েন্টি! শ্রীলঙ্কা যাওয়ার আগেও তো তেমন কোন আভাস ছিল না।  ভেতরের খবরটা চাউর হতেও দেরি হয়নি। মাশরাফি নিজে সরেননি, তাকে যে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এ কথা এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। দেশের ক্রিকেটে প্রসঙ্গটি আবার আলোচিত। কারণ নতুন করে বোর্ড সভাপতি মাশরাফিকে টি-টোয়েন্টিতে ফিরতে বলছেন। না ফিরলে অভিমান ঝরছে তার কণ্ঠে। যেন মাশরাফির নিজের কোন ইচ্ছে থাকতে নেই।

শুক্রবার মিরপুর শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক ভলিবলের ফাইনাল শেষে নাজমুল হাসান পাপন ফের মাশরাফির টি-টোয়েন্টি নিয়ে কথা বলেন, ‘আমাদের ধারণা সে যদি ওয়ানডে খেলতে পারে টি-টোয়েন্টিও খেলা উচিত। ১০ ওভার যদি করতে পারে, ৪ ওভারও তার করা উচিত। এ কারণে তাকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল (আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলতে)। তখন সে আগ্রহ দেখায়নি। আমরা ধরে নিচ্ছি তার আগ্রহ নেই (টি-টোয়েন্টিতে ফিরতে)।’

বিসিবি প্রধান উচ্চারণ করেছেন ‘খেলা উচিত। একজন অবসর নেওয়া ক্রিকেটারের খেলা উচিত কেন হবে? যাকে কিনা অবসর নিতে বাধ্য করার গুঞ্জন আছে।  

কোচ চণ্ডিকা হাথুরুসিংহে দায়িত্ব ছাড়ার পরই মাশরাফিকে টি-টোয়েন্টিতে ফেরানোর চেষ্টা শুরু হয়। সে কথা স্পষ্ট হয়েছে বিসিবি প্রধানের কথাতেও। চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি নিদহাস কাপে যাওয়ার বলেছিলেন, 'এটা নিয়ে আজ আলাপ হয়েছে। এটা ত মাশরাফির উপর নির্ভর করে। আমাকে সবাই বলেছে আপনি বললে খেলবে। কিন্তু আমি ত চাপ দিতে পারি না। আমি বলতে পারি যদি সে রাজি হয়।'

আমি ওকে এই সিরিজেও (দেশের মাঠে শ্রীলঙ্কা সিরিজ) খেলতে বলেছিলাম। কিন্তু জোর দিয়ে না। ও তখন বলল টেস্ট খেলতে চায়, টি-টোয়েন্টি খেলবে না। তারপর আর এটা এগোয়নি। আমি ওকে বলেছিলাম এই সিরিজে খেলতে কারণ নতুন বলে সেই সেরা। এতে কোন সন্দেহ নাই। মোস্তাফিজ ছাড়া টি-টোয়েন্টির জন্য সবচেয়ে নির্ভর করার মত বোলার কিন্তু মাশরাফি।'

বোর্ড সভাপতি গণমাধ্যমে এমনভাবে বলার পর বিসিবি থেকে মাশরাফির কাছে প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছিল। মাশরাফি তাতে সাড়া দেননি।

আসলে কেন ফিরবেন মাশরাফি?  একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক।  ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কায় পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলতে যাওয়ার আগে গণমাধ্যমে সাক্ষাতকারে তখনকার বাংলাদেশের ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক বলেছিলেন, ‘আমি চাই, টি-টোয়েন্টিতেও একটা পর্যায়ে যেতে। সেটির জন্য আরেকটু সময় লাগবে আমাদের। এখনও খেলছি সেই কারণেই। টি-টোয়েন্টি দলটাকে আরেকটু দাঁড় করাতে চাই। দলটা আরেকটু শক্ত হোক। এখনও স্বপ্ন আছে, দলটাকে আরেকটু থিতু করতে চাই। সে জন্যই খেলছি, খেলে যেতে চাই।’

শ্রীলঙ্কায় গিয়ে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে নামার আগে মাশরাফি বললেন, ‘আমি মনে করি টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট থেকে অবসর নেয়ার জন্য এটাই আমার উপযুক্ত সময় যাতে অনেক তরুণ উদীয়মান ক্রিকেটার তাদের প্রতিভা তুলে ধরতে পারে এবং বিসিবি তাদেরকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারে। আমি টি-টোয়েন্টি দলের নতুন অধিনায়ক কে আগাম অভিনন্দন জানাই এবং আমি নিশ্চিত বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা সময় সামনে আসবে।’

সফরের আগে মাশরাফি স্পষ্ট করে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে কথা জানিয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কায় গিয়ে সেই ইচ্ছে হুট করে মরে গেল কেন? কি হয়েছিল এর মাঝে?

খেলোয়াড়রা কোড অব কন্ডাক্টের বেড়াজালে অনেক কিছু বলতে পারেন না।  গুঞ্জন আছে মাশরাফিকে টি-টোয়েন্টি ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন তখনকার কোচ চণ্ডিকা হাথুরুসিংহে। তাতে সায় ছিল বিসিবিরও।

সেই সিদ্ধান্ত যে ভুল মাঠের পারফরম্যান্স দিয়েই তা দেখিয়ে দেন মাশরাফি। গত বিপিএলে রংপুর রাইডার্সকে করেছেন চ্যাম্পিয়ন। তাতে অধিনায়কত্বের পাশাপাশি বল হাতে বড় ভূমিকা ছিল মাশরাফির। ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে এই মৌসুমে মাশরাফি যা করেছেন এর আগে কেউ কখনো তা করে দেখাতে পারেননি। লিস্ট-এ মর্যাদা পাওয়ার পর প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার রেকর্ড গড়েন তিনি। ১৬ ম্যাচেই নেন ৩৯ উইকেট। চলতি বছর প্রথম  শ্রেণিতে খেলেছেন ৩ ম্যাচ। তাতেও দেখা গেছে লাল বলের পুরনো ঝাঁজ।  

মাশরাফি যেখানে বল হাতে এখনো চনমনে। দলের বাকি পেসারদের অবস্থা তথৈবচ। মোস্তাফিজুর রহমানকে বাদ দিলে টি-টোয়েন্টিতে দ্বিতীয় আর কোন পেসারের উপর আস্থা রাখতে পারছে না টিম ম্যানেজমেন্ট। খেলতে নামলেই বেদম মার খান তাসকিন আহমেদ-রুবেল হোসেনরা। রুবেল হোসেন টিকে গেলেও চুক্তি থেকে এবছর বাদ পড়েছেন তাসকিন। নতুন কাউকে দলে নিলে তিনিও দেদারসে বিলান রান, ফেলতে পারেন না প্রভাব। টি-টোয়েন্টিতে পেসার সংকটের কারণেই ফের মাশরাফি শরণ। কিন্তু যাকে ‘বাতিল’ বলে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। নিজেদের দরকারে আবার তাকে ফেরাতে চাইলে তিনি সাড়া দেবেন কেন? তার কি ব্যক্তিত্ব থাকতে নেই?

টি-টোয়েন্টি কখনই মাশরাফির প্রিয় ফরম্যাট নয়। বিভিন্ন আলাপে টেস্ট খেলার ইচ্ছের কথাও জানিয়ে আসছেন। ২০০৯ সালে চোটের পর ক্যারিয়ার লম্বা করতেই আর টেস্ট খেলেননি। কিন্তু সাদা পোশাক একেবারে তোলেও রাখেননি।  মনের গহিনে ফের নামার ইচ্ছা পুষিয়ে রেখেছেন তবে সেটা মোটেও যেন তেন ভাবে নয়। তার জন্য প্রস্তুত হতে চান পুরোটা। গত সপ্তাহে বিসিএলের ম্যাচে খুলনায় মাশরাফি বলেন, ‘বয়স ৩৫ এর কাছে গেলেও যে ফিটনেস আছে তাতে আরও দুই বছর টেস্ট খেলার সামর্থ্য আছে আমার। এটা আমি বুঝতে পারি। বিশেষ করে ফিটনেস যে অবস্থায় আছে তাতে পারব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে, পারফর্ম তো করে খেলতে হবে। এর জন্য তো আমার একটা উপায় বের করতে হবে।’

‘শুধু তো নতুন বলে বোলিং করলে হবে না। ওয়ানডের মতো টেস্টে আপনাকে আক্রমণ করবে না। এখানে উইকেট বের করতে আপনাকে উপায় বের করতে হবে। আর নতুন বলের পর পুরান বলে আরও লম্বা সময় খেলা হয়। সেই সময়ে বোলিং করার উপায় বের করতে হবে। সেই পর্যায় না গিয়ে টেস্টে ফেরার ব্যাপারে বলা বা মন্তব্য করা কঠিন।’

মাশরাফির নিজের মুখে টেস্ট খেলার সামর্থ্যের কথা শোনে বোর্ড সভাপতির সংশয়,  ‘জানি না, সে টেস্টে ফিট কি না। কোথায় কোন দেশে টেস্ট খেলবে সে? দেশের বাইরে? তাহলে প্রতিদিন ওকে অন্তত ২০ থেকে ২৫ ওভার বোলিং করতে হবে।’

‘ও বলছে, পারবে? তাহলে তো আমাদের কিছু বলার নেই। ফিজিও যদি অনুমতি দেয় আর সে যদি বলে পারে তাহলে অবশ্যই স্বাগত জানাব। তবে আমাদের এ নিয়ে ধারণা নেই। যদি মনে করেন আমাদের দেশে খেলা, তাকে দিয়ে মাত্র ২ বা ৩ ওভার করাব, সেটা ভিন্ন বিষয়।’

এমনকি টেস্টে বাংলাদেশের সফলতম পেসার মাশরাফির ভূমিকা কি হবে তা নিয়েও সংশয় তার কণ্ঠে, ‘সে কী হিসেবে আসতে চায়, ব্যাটসম্যান না বোলার? এটা বড় প্রশ্ন। আমি মনে করি সে যদি ফিট থাকে যেকোনো সংস্করণেই তার খেলা উচিত। তার মতো খেলোয়াড় পাওয়া কঠিন। বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটে খেলাটা তার এবং ফিজিওর ওপর নির্ভর করছে।’

বোর্ড সভাপতি চান মাশরাফি টি-টোয়েন্টিতে ফিরুন। যেটা ছেড়ে দিয়েছেন বা ছাড়তে হয়েছে সেখানে আর ফেরার ইচ্ছা নেই মাশরাফির। নিজেকে আরেকটু তৈরি করে মাশরাফি ফিরতে চান টেস্টে। এখানেও মাশরাফির নিজের ইচ্ছের দাম দিনশেষে কতটুকু, সে প্রশ্ন এখন প্রকাণ্ড। দেশের সফলতম অধিনায়ক। কেবল পরিসংখ্যান হিসাবে নিলেই সব ফরম্যাটেই দেশের সেরা পেসার। মাঠে ও মাঠের বাইরে দলকে চাঙ্গা করা যার চিরায়ত গুণ।  তার নিজের ইচ্ছে বলে কি কিছু থাকতে নেই?  

Comments

The Daily Star  | English
Cox’s Bazar Rail Station

Cox’s Bazar Rail Station: A modern marvel awaits travellers

The recently constructed Cox’s Bazar rail station aims to attract more tourists to the country’s renowned destination, the Cox’s Bazar sea beach.

17h ago