‘ওয়াকম্যান সিনড্রোমে’ আক্রান্ত সরকার ও আওয়ামী লীগ
জাপানি প্রতিষ্ঠান সনি ১৯৭৯ সালের জুলাইয়ে 'ওয়াকম্যান' নামে ব্যাটারিচালিত স্টেরিও ক্যাসেট প্লেয়ার তৈরি করে। অভিনব এই যন্ত্রটি মানুষের গান শোনার অভ্যাসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া-আসার সময় মানুষ ওয়াকম্যানে গান শুনতে পারতেন। বিশেষ করে কর্মস্থলে যাওয়া-আসার সময় কিংবা কারও একাকী দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর যাত্রাকে অনেকাংশে আনন্দদায়ক করে তুলতো ওয়াকম্যান।
খুব দ্রুতই এটি সারা বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং গান শোনার অভ্যাসে পরিবর্তন আনে। পঞ্চাশের দশকের ট্রানজিস্টারের মতো আশির দশকে ওয়াকম্যানের ক্ষেত্রেও ডিজিটাল বিপ্লবের আভাস ছিল। অল্পদিনেই সেটি সারা বিশ্বকে নাড়া দেয়।
তবে, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত— সব ধরনের বিপ্লবের মতো এখানেও কিছু অপ্রত্যাশিত পরিণতি লক্ষ্য করা যায়। সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে ওয়াকম্যান ব্যবহৃত হলেও দেখা যায়, যারা এটা ব্যবহার করছেন তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। তারা নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকছেন (বর্তমান পরিস্থিতি যদিও এর চেয়ে খারাপ) এবং চারপাশের পরিবেশ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখছেন। ওয়াকম্যান চালিয়ে হেডফোন কানে দিয়ে একজন মানুষ যেকোনো জায়গায় যেতে পারতেন। সবচেয়ে ব্যস্ততম বাজার, হইচইপূর্ণ জনসমাবেশ কিংবা বিশাল বিক্ষোভ কর্মসূচির মধ্যে থাকলেও ওয়াকম্যান ব্যবহারকারীরা চারপাশের পরিস্থিতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারতেন।
১৯৭৯ সালে ইরানের মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভীর পতনের পর 'ওয়াকম্যান সিনড্রোম' কথাটা ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরু হয়। তখন জনগণকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ১৯৫৩ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা শাহ কেন টের পেলেন না যে, তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। তার ভয়ংকর গোয়েন্দা সংস্থা সাভাক, নজরদারির জন্য বিভিন্ন সংস্থা এবং দীর্ঘদিনের মিত্র মার্কিন প্রশাসন ও তাদের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সহায়তার পরও তিনি কেনো বুঝতে পারলেন না যে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য যে ফাঁদ তিনি পেতেছেন, সেই ফাঁদেই তিনি আটকা পড়বেন।
পরে অবশ্য এই বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, তেহরান ও ইরানের সব শহর ও বাজারগুলোতে শাহ'কে নিয়ে সমালোচনা হলেও তার লোকজন ওয়াকম্যান কানে দিয়ে শুধু নিজেদের পছন্দের কথাবার্তাগুলোই শুনতেন।
কীভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটলো? আমার সৌভাগ্য যে, এই বিতর্কের সময়কালে খুব কাছাকাছি থেকে তা প্রত্যক্ষ করেছি। আমি তখন ইউনেস্কো সদর দপ্তরে কাজ করতাম এবং প্যারিস শহরে ইরানি বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনি তার নির্বাসিত জীবনের শেষ কয়েকটি বছর কাটিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে ইরানে ফেরেন। ইউনেস্কোর করিডোরগুলোতে তখন অনেক ধরনের আলোচনা শোনা যেত; যার মধ্যে সবচেয়ে জোরালো ছিল কীভাবে শাহ'র প্রশাসন একেবারেই টের পেল না যে ক্ষমতার দৃশ্যপটে এরকম নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। এ ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হলো লর্ড অ্যাক্টনের নীতিবাক্যটি, 'ক্ষমতা মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে, চরম ক্ষমতা চরমভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে।'
এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট ব্যাখ্যা ছিল, তিনি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন এবং ইউনেস্কোর বিভিন্ন মহল এ বিষয়টিকে 'ওয়াকম্যান সিনড্রোম' হিসেবে অভিহিত করে। নতুন উদ্ভাবিত এই গ্যাজেটের জনপ্রিয়তা ব্যবহার করে ইরান ও শাহ'র রাজত্বে কী ঘটেছিল, তা খুব সহজেই ব্যাখ্যা করা হয়েছিল।
ওই ঘটনার ৪০ বছর পর এর ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলেও শব্দটি আবারও ব্যবহার করার লোভ সামলাতে পারছি না। আমার মতে, দেশের সরকার ও ক্ষমতাসীন দল উভয়ই 'ওয়াকম্যান সিনড্রোমে' আক্রান্ত। এ ক্ষেত্রে তারা আরও এক ধাপ এগিয়ে। তারা শুধু যে নিজেদের তৈরি আখ্যানই শুনছেন তা নয়, অন্যদের মতামত ও তা প্রচার রোধে সম্ভাব্য সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন। যদি কোনোভাবে বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ্যে এসে পড়ে, তাহলে সেটাকে সঙ্গে সঙ্গে 'ষড়যন্ত্র' তত্ত্ব হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে 'পরিণামের' বিষয়ে ইঙ্গিত দেওয়া হয়।
আমি কিছুদিন আগে লিখেছিলাম, 'পত্রিকার স্বাধীনতা এখন প্রশংসার স্বাধীনতায় পরিণত হয়েছে।' যতক্ষণ পর্যন্ত এই প্রশংসা চলতে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত পত্রিকা ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই নিরাপদ থাকে। সমালোচনা ও বিকল্প মতবাদের প্রতি অসহিষ্ণুতা এতটাই ভয়াবহ পর্যায়ে গেছে যে, গণতন্ত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য, মত প্রকাশের স্বাধীনতা আজকের বাংলাদেশে সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমকে দুর্বল করার পাশাপাশি সংসদেও জনজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আলোচনায় স্থান পায় না। একটি কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য হওয়া সত্ত্বেও সংসদে দেশের জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে কোনো বিতর্ক হয় না বললেই চলে। সারা বিশ্ব আজ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত হুমকির মুখোমুখি, বাংলাদেশ যার একেবারে অগ্রভাবে রয়েছে। কিন্তু আমাদের সংসদে এ বিষয়ে একবারও কোনো বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা হয়নি। শিক্ষা, তারুণ্য, নিয়োগ, পরিবেশ, প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতিমালা, জঙ্গিবাদের হুমকি, মানবসম্পদের উন্নয়ন— যেকোনো জাতীয় সংকটপূর্ণ বিষয়ের কথা উল্লেখ করলেই দেখা যায়, আমাদের জাতীয় সংসদে সেই বিষয়ে কোনো ধরনের অর্থবহ আলোচনা হয়নি।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় যেসব দেশে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু আমাদের সংসদে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা নেই। কোনো সংসদীয় আলোচনায় স্থান পায়নি করোনাভাইরাস মোকাবিলার কৌশল ও এর পেছনে খরচ হওয়া হাজারো কোটি টাকা, যা এসেছে করদাতাদের পকেট থেকে। পি কে হালদার ১০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন, যেটি পদ্মা সেতুর নির্মাণ খরচের এক-তৃতীয়াংশ। কিন্তু আমাদের জনপ্রতিনিধিদের মুখ থেকে এ বিষয়ে পারতপক্ষে কোনো কথাই বের হয়নি। এ রকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
মাঝে মাঝে 'পয়েন্ট অব অর্ডারে' বিচ্ছিন্নভাবে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু এগুলো যথেষ্ট নয় এবং এ থেকে কোনো অর্থবহ দিকনির্দেশনাও আসে না। প্রশংসা ও নিজেদের পিঠ চাপড়ানোর পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করা হয়। কিন্তু যখন হাজারো মানুষ করোনাভাইরাস, বন্যা অথবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণ হারান, তখন আমাদের সংসদ, আমাদের জনপ্রতিনিধিদের সে বিষয়ে আলোচনার জন্য কোনো সময় বরাদ্দ থাকে না।
আমাদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো— মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, তথ্য কমিশন এই 'ওয়াকম্যান সিনড্রোমে' ভুগছে। তারা শুধু সেগুলোই শুনতে পায়, যেটা তারা শুনতে চায়। বাকি সবকিছু বন্ধ করে রাখে। তবে, এ চর্চায় সবার থেকে এগিয়ে আছে নির্বাচন কমিশন। সম্ভবত তাদের মূল কাজ হচ্ছে নির্বাচনে ভোটারদের মনের ইচ্ছার প্রতিফলন নিশ্চিত করা। কিন্তু তারা ক্ষমতাসীনদের মনের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারলেই খুশি থাকে।
আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম ও লজ্জাজনক বিষয়গুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে 'গুম'। প্রতি বছর 'গুম' সংশ্লিষ্ট পরিবারের সদস্যরা কান্নাজড়িত চোখে সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ে সরকারি উদ্যোগ বা নিদেনপক্ষে কিছু প্রশ্নের উত্তর দাবি করেন। কিন্তু মানবাধিকার কমিশন এতে ভ্রুক্ষেপও করে না। সংবাদপত্রগুলো দুর্নীতির ওপর বিস্তারিত অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন ছাপায়, কিন্তু সেগুলো দুদককে আকর্ষণ করে না।
সবশেষ জ্বালানি সংকটে জাতীয় নিরাপত্তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ উন্মোচিত হয়েছে, যেটি আমাদের সবার জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। তবে, এটি এমন একটি বিষয়, যেটি অনেকাংশে জনগণের যথাযথ পর্যবেক্ষণের বাইরে থাকে। আমাদের সমগ্র জ্বালানি খাত, গ্যাসের উৎস খোঁজা, বিদ্যুৎ উৎপাদন, কুইক রেন্টাল, এলএনজি আমদানি, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ— এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো সংসদের নজরদারি ও দুদকের তদন্তের আওতায় আসেনি। বুধবার সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) রেকর্ড পরিমাণে তেলের দাম বাড়ানো সংক্রান্ত কিছু অবিশ্বাস্য তথ্য প্রকাশ করেছে। যা থেকে জানা গেছে, তেলের দাম না বাড়ালেও চলতো। সরকারের এই একটি উদ্যোগ দেশের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে চরম হতাশার দিকে এবং শিল্পগুলোকে জ্বালানি ও পরিবহনের জন্য বাড়তি খরচের কারণে নিদারুণ সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ বিষয়টি কি আমাদের সংসদে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হবে?
ইতোমধ্যে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত কিছু আইনের পাশাপাশি আরও কিছু খসড়া আইন বিবেচনাধীন রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব (প্রেস কাউন্সিল আইনের সংশোধন) ও দেশের নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য (তথ্য সুরক্ষা আইন) পাবে সরকার।
'ওয়াকম্যান সিনড্রোম' এর বাংলাদেশি সংস্করণ ভয়ংকর হয়ে উঠেছে আমাদের অতি অলংকরণের সংস্কৃতির কারণে। এ ক্ষেত্রে দুটি উদাহরণ দেওয়া যায়। আমরা আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইটটি কক্ষপথে পাঠানোর জন্য একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে টাকা দিয়েছি (যার প্রয়োজনীয়তা ও লাভ-ক্ষতির হিসাব এখনো আলোর মুখ দেখেনি) এবং এটাকে বলা হয়েছে 'আমাদের মহাকাশ বিজয়'। আমরা আন্তর্জাতিক আদালতে একটি আইনি লড়াইয়ে জিতেছি (সরকার এ বিষয়টি দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদন করার জন্য প্রশংসার দাবিদার) এবং দাবি অনুযায়ী সমুদ্রসীমা অর্জন করেছি। এই বিষয়টিকে আমরা 'সমুদ্র বিজয়' হিসেবে প্রচার করেছি। যা বাস্তবতার চেয়ে বেশি মাত্রায় অতিরঞ্জন।
'ওয়াকম্যান সিনড্রোম' এক ধরনের বিভ্রান্তিকর মানসিকতা তৈরি করেছে। আত্মপ্রশংসা শুনতে শুনতে এবং বিপরীত মতামত দমন করতে করতে আমাদের সরকার ও ক্ষমতাসীনরা প্রয়োজনীয় সমালোচনা থেকে নিজেদের বঞ্চিত করে রেখেছে। মানুষের প্রয়োজন সম্পর্কে আরও ভালো করে জানতে এবং তারা কী ভাবছে সেই বিষয়ে জানতে সমালোচনা সহায়ক হতে পারতো। কিন্তু তারা বাস্তবতা থেকে দূরে সরে গিয়ে বাগাড়ম্বরের সংস্কৃতিতে মজে আছে এবং নিজেদের অর্জনকে অতিরঞ্জন করে চলেছে (যেটি বাস্তবসম্মতভাবে মূল্যায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ, বিশেষ করে পদ্মা সেতু)।
আশা করি বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো তাদের জন্য 'জেগে ওঠার বার্তা' হিসেবে কাজ করবে এবং তাদের বাস্তবতাটা দেখার ইচ্ছা জাগাবে।
মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments