আত্মসমালোচনায় কোনো সরকারের পতন হয় না

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত আমাদের করণীয় নিয়ে একটি 'দীর্ঘ তালিকা' দিয়ে গেছেন। একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সফরের পর এ ধরনের কথা ইতিবাচক মনে হয় না, বিশেষ করে যখন কোনো কিছু করার জন্য আমাদের সুপারিশ (ভদ্রতাবশত এখানে আমি 'উপদেশ' শব্দটি ব্যবহার করছি না) করা হয়। এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে এমন কিছু শুনতে কারো ভালো লাগার কথা নয়। দেশ ভেদে এই 'করণীয়' তালিকা যখন ছোট-বড়, কঠিন বা সহজ ভাষায় কিংবা সরাসরি কিংবা ঘুরিয়ে বলা হয়— তখন এর অনুভূতি ক্ষোভের পর্যায়ে চলে যায়। বৈশ্বিক অথবা আঞ্চলিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোকেও কি একই ঘটনায় এ ধরনের তালিকা দেওয়া সম্ভব? যেমন- চীন, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন বা ভারতের সঙ্গে কি একই ভাষায় কথা বলা সম্ভব?

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত আমাদের করণীয় নিয়ে একটি 'দীর্ঘ তালিকা' দিয়ে গেছেন। একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সফরের পর এ ধরনের কথা ইতিবাচক মনে হয় না, বিশেষ করে যখন কোনো কিছু করার জন্য আমাদের সুপারিশ (ভদ্রতাবশত এখানে আমি 'উপদেশ' শব্দটি ব্যবহার করছি না) করা হয়। এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে এমন কিছু শুনতে কারো ভালো লাগার কথা নয়। দেশ ভেদে এই 'করণীয়' তালিকা যখন ছোট-বড়, কঠিন বা সহজ ভাষায় কিংবা সরাসরি কিংবা ঘুরিয়ে বলা হয়— তখন এর অনুভূতি ক্ষোভের পর্যায়ে চলে যায়। বৈশ্বিক অথবা আঞ্চলিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোকেও কি একই ঘটনায় এ ধরনের তালিকা দেওয়া সম্ভব? যেমন- চীন, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন বা ভারতের সঙ্গে কি একই ভাষায় কথা বলা সম্ভব?

আমরা যদি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে এ ধরনের উপদেশ শোনা বন্ধ করতে চাই, তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের এবং সরকারকে দেশের মানুষের সমালোচনাকে গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে অনুগ্রহ নয় বরং সরকারকে অধিকার হিসেবে অন্যদের কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। সরকারের কোনো বিষয়ের বিরুদ্ধে বিশেষজ্ঞ, অংশীজন এবং গণমাধ্যমের জোরালো অবস্থান, বিকল্প পরামর্শ এবং ভিন্নমত গ্রহণ করতে হবে। সমালোচনাকারীকে 'ষড়যন্ত্রকারী' হিসেবে অভিহিত করা হলে সমালোচনার দ্বার বন্ধ হয়ে যায়।

কোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়নি, বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেনি, কারা-হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি, গুমের ঘটনা ঘটেনি, আইনের লঙ্ঘন হয়নি— এ ধরনের বক্তব্য আসলে কোনো কাজে আসে না। বাস্তবতাকে অস্বীকার করে আমরা বিদেশিদের 'উপদেশ' দেওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করি এবং বাইরের শক্তির কাছে নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করি। এটা কি অস্বীকার করা যাবে যে, যুক্তরাষ্ট্রের বিধিনিষেধ আরোপের পর র‍্যাবের হাতে 'ক্রসফায়ারে' মৃত্যুর ঘটনা কার্যত বন্ধ হয়েছে? দেশের মানুষ এবং গণমাধ্যম বছরের পর বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে জোরালো প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছে। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে হাজারো প্রতিবাদ সভা, মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন ও স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বাইরের শক্তি বিধিনিষেধ আরোপের পর সাময়িকভাবে হলেও- ম্যাজিকের মতো হঠাৎ সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। এ থেকে মানুষ কী বুঝবে? তারা এটাই বুঝবে যে, আমাদের প্রতিবাদের কোনো মূল্য নেই। শুধু আন্তর্জাতিক মহল থেকে সরকারের ওপর চাপ এলেই তখন আমরা কিছু ফল দেখতে পাই।

সোজা কথায়, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার যা যা বলেছেন তার সবকিছুই আমরা, দেশের মানবাধিকার কর্মী, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম বছরের পর বছর ধরে বলে আসছি। এ বিষয়গুলোর ওপর মোটা মোটা বইও লেখা হয়েছে এবং হাজারো সম্পাদকীয় ও মতামত কলাম ছাপানো হয়েছে। কিন্তু, এর কোনোটাকেই গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয়নি। আদতে, সবচেয়ে শক্তিশালী ও জ্ঞানগর্ভ লেখাগুলোকে অবজ্ঞাভরে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, যারা 'সরকারের নজিরবিহীন সাফল্য সহ্য করতে পারেন না' তারা এসব লেখে। তাদের স্বভাবই হলো সমালোচনা করা।

আমরা চাই, মিশেল ব্যাশেলেতের সুপারিশগুলোর মধ্য থেকে অন্তত একটিকে যেন সরকার গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয় তদন্তের জন্য একটি নিরপেক্ষ ও বিশেষায়িত সংস্থা গঠন করা হোক। এই একটি সুপারিশের বাস্তবায়ন হলে অনেক জায়গায় পরিবর্তন আসবে। বিশেষত, এই সংস্থাটির মাধ্যমে জবাবদিহির প্রক্রিয়া চালু হবে, সরকারের প্রতিটি অংশে যে বিষয়টির অভাব দৃশ্যমান।

শেখ হাসিনার অনেক অর্জনকে যেটি কলঙ্কিত করেছে, তা হলো জবাবদিহির অভাব। সরকারপ্রধান ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে (আমাদের সংবিধান সরকারপ্রধানকে উচ্চমাত্রার নির্বাহী ক্ষমতা দিয়েছে) সবার প্রত্যাশা এটাই যে, তিনি সবচেয়ে কঠোর জবাবদিহির আওতায় থাকবেন। সম্প্রতিকালে আমরা দেখেছি, যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে কীভাবে তার দেশের পার্লামেন্ট ও নিজের দল জবাবদিহির আওতায় এনেছে। কিন্তু, আমাদের বাস্তবতা একই রকম নয়। আমাদের এরকম কোনো কিছু পাওয়া তো দূরের কথা, আশা করাও যেন অন্যায়। তবে, প্রধানমন্ত্রী যদি এ ধরনের একটি কার্যকরী প্রশাসন চান, তাহলে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি দরকার তা হলো প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ, ব্যাংকিং, স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা- বস্তুত সরকারের প্রতিটি পর্যায়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করা। বলা যায়, জবাবদিহির অভাব এই সরকারকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে এবং চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সমন্বয়হীনতার জন্য অনেকাংশে সেটা দায়ী।

বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সরকারকে বিপুল অর্থ বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের জন্য নিত্যপণ্যে বড় ধরনের ভর্তুকি দিতে হবে। এই অর্থ কোথা থেকে আসবে? এর জন্য যেমন আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের কাছে যেতে হবে, অন্যদিকে গত এক দশকে আমাদের কষ্টার্জিত সম্পদ কীভাবে ব্যয় করা হয়েছে, সে বিষয়েও জবাবদিহি করতে হবে। অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানকে কয়েক বছর ধরে 'ক্যাপাসিটি চার্জ' হিসেবে হাজার হাজার কোটি টাকা দেওয়া, তাও আবার মার্কিন ডলারে।  রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট ৩-৪ বছরের জন্য শুরু হলেও এখন ১৩ বছর ধরে সেটি চলছে— জবাবদিহির অভাবে যা হতে পারে তার একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ এটি। হয়তো একটি সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বা ক্ষুদ্র পরিসরে এ ব্যবস্থাটির প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তা কখনোই এতদিন ধরে চলার বা এর পেছনে এত অর্থ ব্যয় করার কথা ছিল না।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের সুপারিশের বিষয়ে ফিরে আসি। আমাদের বিশ্বাস, এ ধরনের একটি সংস্থা আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীগুলোতে জবাবদিহি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে। আমাদের পুলিশ, র‍্যাব, গোয়েন্দা ও নজরদারি বাহিনীগুলোকে তাদের ইচ্ছেমতো কাজ করতে দেওয়ার কারণে দেশের জনগণকে বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ২টি পরিণতি হচ্ছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম। গরিব, দিনমজুর, নিম্ন আয়ের মানুষ এবং ছোটখাটো ব্যবসায়ীরা মূলত এ ধরনের বাহিনীর ক্ষমতা অপব্যবহারের শিকার। এক্ষেত্রে তাদের খুব উপযোগী ও শোষণমূলক একটি কৌশল হচ্ছে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে অর্থ আদায়।

অন্যের কাছে নিজের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করা স্বাভাবিক। তবে, সেটাই একমাত্র বক্তব্য- এমন ভাবাটা খুবই বিপজ্জনক। আমরা এখন সেই বিপজ্জনক অংশে বাস করছি। আমাদের মন্ত্রীরা জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারকে নিজেদের বক্তব্যে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তা বাস্তবতা-বিবর্জিত। যেসব মানুষ তাদের আপনজনকে হারিয়েছেন, তাদের সম্পর্কে এই ধরনের বক্তব্য প্রহসনের পর্যায়ে পড়ে। সর্বোপরি এসব বক্তব্য দ্বারা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ধারণাকে আরও ভিত্তি দিয়ে দেওয়া হয় যে, সরকারের দেওয়া কোনো তথ্যই এখন আর বিশ্বাসযোগ্য নয়।

আমাদের অবশ্যই অস্বীকারের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং আত্মসমালোচনা করার মতো আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে হবে। আত্মসমালোচনার কারণে পৃথিবীর কোনো দেশেই সরকারের পতন হয়নি। বরং, আত্মপ্রেমে মজে থাকার কারণে অনেকেই ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। এ ধরনের ঘটনার পেছনে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিকটি হলো, অন্যকে বিভ্রান্ত করতে যা অস্বীকার করা হয় তা নিজেকেও বিভ্রান্ত করে। এতে এক সময় তারা নিজেরাও বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।

মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments