আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের ‘কেউ না’
তিনি যে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সেই সরকার তার বক্তব্যের দায় নিচ্ছে না। তার দায় নিচ্ছে না রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগও। বলছি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের কথা। চট্টগ্রামের একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, 'আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারত সরকারকে সেটা করার অনুরোধ করেছি।'
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী বলেছেন, 'যিনি এ কথা বলেছেন, তার ব্যক্তিগত অভিমত হতে পারে। এটা আমাদের সরকারের বক্তব্য না,দলেরও বক্তব্য না।'
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বলেছেন, 'তিনি তো আমাদের দলের কেউ না আসলে। সুতরাং তার এই বক্তব্যে আমাদের দলের বিব্রত হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।'
যদিও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এবং মহানগর আওয়ামী লীগের ১ নম্বর সদস্য। তারপরও তিনি আওয়ামী লীগের কেউ নন?
সরকারেরও না, দলেরও না, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আসলে কার? কে নেবে তার দায়িত্ব? আবার এই প্রশ্নও উঠছে যে, ওবায়দুল কাদের ও আব্দুর রহমানের বক্তব্য কি সরকার ও আওয়ামী লীগের? নাকি তাদের বক্তব্যও ব্যক্তিগত?
যাইহোক, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের কাছে দেশের পরিস্থিতি তুলে ধরার বিষয়টি নতুন নয়। আওয়ামী লীগ-বিএনপি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এটা করেছে বা করে। সাধারণত যখন যারা বিরোধী দলে থাকে, তারা এটা বেশি করে।
সম্প্রতি জাতিসংঘের প্রধান মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেত বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। তিনি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন, নাগরিক সমাজের সঙ্গে কথা বলেছেন, মানবাধিকার কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছেন, বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গেও কথা বলেছেন। এই কথাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, বিদেশিদের কাছে তদবির করে লাভ নেই। কোনো বিদেশি বা জাতিসংঘ দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তদন্ত করতে পারবে না। একই রকমের কথা তথ্যমন্ত্রীও বলেছেন।
ঠিক সেই সময়ই সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন এলেন আলোচনায়। তিনি রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে গিয়ে যা করেছেন, তা শোনালেন দেশের মানুষকে।
আজকের আলোচনা মূলত সেই প্রসঙ্গ নিয়েই।
প্রথমে দেখা দরকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতে কেন গিয়েছিলেন। তিনি ভারতে গিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে। সেখানে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে তারা আলোচনা করেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি ভারতে গিয়ে প্রটোকল পেয়েছেন। তিনি ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, আলোচনা করেছেন। ভারতের আমলাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, কথা বলেছেন। এর সবই হয়েছে বাংলাদেশ-ভারত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের মিটিং।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের খরচ কে বহন করেছ? তার সফরের যাবতীয় খরচ বহন করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদশের জনগণের অর্থে এই খরচ বহন করা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন নিজের ব্যক্তিগত খরচে ভারতে যাননি, নিজের ব্যক্তিগত খরচে ভারতে থাকেননি, নিজের ব্যক্তিগত খরচে সেখানে গিয়ে চলাচল করেননি। বাংলাদেশ সরকারের অর্থে, বাংলাদেশের জনগণের অর্থে তিনি গিয়েছেন, থেকেছেন, ফিরে এসেছেন। তাহলে এই সফরকে বা এই কথাকে কি ব্যক্তিগত বলা যায়?
বাংলাদেশের মানুষের আত্মমর্যাদাবোধ আছে। বাংলাদেশ ছোট দেশ, কিন্তু স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। বহু ত্যাগের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। সেই স্বাধীন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতে গিয়ে 'ব্যক্তিগত' মতামতে তিনি ভারতের নেতাদের কাছে বললেন, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য আপনাদের যা যা করণীয়, তা করতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে শপথ নেওয়া একজন মন্ত্রী অন্য দেশে গিয়ে এসব কথা বলতে পারেন? বললে শপথ ভঙ্গ হয় না? এই দেশের মানুষের আত্মসম্মানবোধে আঘাত লাগে না? ওবায়দুল কাদেরের আত্মসম্মানবোধে আঘাত লাগে না? সরকারের আত্মসম্মানবোধে আঘাত লাগে না?
তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন সহজ ও সরল মানুষ, তার যা মনে আসেন তাই তিনি বলে দেন। এই যুক্তি দেওয়ার আগে বিবেচনায় নিতে হবে, তিনি যখন একটি রাষ্ট্রের মন্ত্রী,তখন 'সহজ বা সরল' আখ্যা দিয়ে যা ইচ্ছা তাই বলার সুযোগ নেই।
এখানে বিষয় দুটি। তিনি হয়তো না বুঝে বলে ফেলেছেন কথাটি। আর না হয়, তিনি বুঝে-শুনেই বলেছেন।
প্রথমটি ঠিক হলে, একটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অন্য দেশে যাবেন এবং তিনি না বুঝে কথা বলে ফেলবেন, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটা যদি গ্রহণযোগ্য হয় যে তিনি না বুঝে বলে ফেলেছেন, তাহলে একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যোগ্যতা-দক্ষতা ও ইন্টেলেকচুয়াল লেভেল নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ তৈরি হয়।
আর যদি দ্বিতীয়টি ঠিক হয়, তাহলে বাংলাদেশের জনগণকে অসম্মান করা হয়। সরকার সব সময় চিন্তিত থাকে যে 'ভাবমূর্তি' নিয়ে, তা সবচেয়ে বেশি ক্ষুণ্ন হয় এ ধরণের কথায়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের আরও কিছু কথা যদি আমরা স্মরণ করি, তিনি কিছুদিন আগে বললেন,বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো। একটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুটি দেশকে নিয়ে কে কার স্বামী, কে কার স্ত্রী, এই প্রক্রিয়ায় দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্ককে ব্যখ্যা করবেন—ধারণা করি এমন নজীর পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এটা কোনো কূটনীতির ভাষা তো হয়ই না, কোনো সাধারণ রাজনীতির ভাষাও এটা হতে পারে না।
ভারত বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র, ভারত বৃহৎ রাষ্ট্র। ভারতের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক রাখতে হবে। সুসম্পর্ক রেখে সেখান থেকে যা পাওয়ার তা পেতে হবে। যা ভারতের দরকার, সেটাও আমরা দেবো। সুসম্পর্কের অর্থ এই নয় যে তার কাছে গিয়ে আমাকে বলতে হবে, আমার সরকারকে টিকিয়ে রাখেন, আমাকে টিকিয়ে রাখেন। স্বামী-স্ত্রীর প্রসঙ্গ টেনেও তিনি বাংলাদেশকে হেয় করেছেন।
কয়েকদিন আগে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত বললেন, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের কার কার টাকা আছে সে বিষয়ে বাংলাদেশ সুনির্দিষ্ট করে জানতে চায়নি। পরের দিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, সুইস রাষ্ট্রদূত মিথ্যা বলেছেন। কূটনীতির কিছু ভাষা আছে, কূটনীতির কিছু দক্ষতা আছে, কূটনীতির কিছু কৌশল আছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের বক্তব্যে সেই কূটনীতির ভাষা, দক্ষতা, যোগ্যতা, কৌশল— কোনোকিছুই দেখা যায় না। তিনি সরাসরি একজনকে বলে দিলেন, রাষ্ট্রদূত মিথ্য বলেছেন। এই যে কথা বলার ধরন, এই কাজটি তিনি বহু বছর ধরে করে আসছেন। আমেরিকায় গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে বলেছেন, 'বিএনপিকে নির্বাচনে আনা একটা চ্যালেঞ্জ। তাদেরকে ভোটে নিয়ে আসেন।'
বাংলাদেশের মানুষ এটা বোঝে যে বর্তমান সরকারের প্রতি ভারতের সমর্থন আছে। আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় থাকে, তাহলে ভারতের জন্য সার্বিকভাবে স্বস্তিদায়ক হয়। স্বস্তিদায়ক হয় এই অর্থে যে, সেভেন সিস্টার্সকে কেন্দ্র করে যে অস্থিরতা ভারতের ভেতরে আছে এবং তার একটি অবস্থান বাংলাদশের ভেতরে ছিল বলে বলা হয়, সেই জায়গায় বাংলাদেশ যেহেতু ভারতকে খুব বড়ভাবে সহায়তা করেছে, সেই কারণে ভারত সরকারের আস্থা আওয়ামী লীগের ওপর প্রবলভাবে আছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো থাকবে, আস্থার সম্পর্ক থাকবে, বিশ্বাসের সম্পর্ক থাকবে—সেটাই প্রত্যাশিত।
কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মনে পারসেপশন তৈরি হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশে কে সরকারে থাকবে, সেটা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ভারত, জনগণ নয়। আব্দুল মোমনের বক্তব্যে জনগণের সেই ধারণা শক্ত ভিত পেয়ে গেল। যা ভারতের জন্যও স্বস্তিদায়ক হওয়ার কথা নয়।
আগামী বছর দেশে জাতীয় নির্বাচন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে সেই বিষয়েও একটি ধারণা তৈরি হয়ে যেতে পারে যে এবারও হয়ত জনগণকে ভোট দিতে হবে না। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার ক্ষেত্রে আমাদের কোনো ভূমিকা নেই। অর্থাৎ, জনগণের কোনো ভূমিকা নেই। ভূমিকা আছে অন্য দেশের। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেটা বললেন, ভারতের।
র্যাব ও এর কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের চেষ্টা থাকবে সেই নিষেধাজ্ঞা কীভাবে প্রত্যাহার করা যায়। সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়াটা ছিল বাংলাদেশের দায়িত্ব। ব্যবস্থা নিয়ে দেখানো দরকার ছিল, আমরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই কাজগুলো আর করছি না। র্যাবের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই কাজগুলো আর হচ্ছে না।
সেই জায়গায় একটি ঘটনা আমরা দেখছি যে 'ক্রসফায়ার' বন্ধ আছে। এর বাইরে গুম, মিথ্যা মামলায় হয়রানিসহ অন্যান্য যেসব অভিযোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এনেছে, সেই জায়গায় মৌলিক কোনো পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করছি না। বাংলাদেশ সরকার সেই মৌলিক পরিবর্তন আনার চেয়েও ভারতের কাছে এ বিষয়ে সহযোগিতা চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, র্যাবের ওপর থেকে যাতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ ভারতের কাছে অনুরোধ করেছে, ভারত বিষয়টি নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে তদবির করছে।
সমস্যা বাংলাদেশের, স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ, আব্দুল মোমেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য তিনি তদবির করছেন ভারতের কাছে। র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হোক, এটা অবশ্যই আমরা চাই। এটা হওয়া দরকার। এটা বাংলাদেশের ইমেজের জন্য কোনোভাবেই স্বস্তিদায়ক নয়, কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়। কিন্তু যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে, তার ভিত্তি আছে কি না, সেটা তো খতিয়ে দেখা দরকার। সেই জায়গায় ব্যবস্থা নিলে আমরা তো সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেই আলোচনা করতে পারি। আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করতে পারি, র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করতে পারি। তা না করে আমরা ভারতকে অনুরোধ করছি।
এই যে বারবার ভারত, ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখবে ভারত, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে দেবে ভারত, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভারতের সঙ্গে—এই কথাগুলোর মধ্যে প্রথমত পেশাদারিত্বের ছাপ নেই, দ্বিতীয়ত কূটনৈতিক ভাষার কোনো সংযোগ নেই, তৃতীয়ত বাংলাদেশের জনগণের জন্য অসম্মানজনক, চতুর্থত বাংলাদেশ সরকারের জন্য অসম্মানজনক, পঞ্চমত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদটির জন্য অসম্মানজনক।
এই বিষয়গুলো আমরা বুঝতে পারছি কি না?
Comments