চা বাগানে দাস প্রথা ও আমাদের দায়

ইদানিং রপ্তানি কিছুটা বাড়লেও বাংলাদেশে উৎপাদিত চায়ের প্রধান গ্রাহক স্থানীয় পর্যায়ের ভোক্তা। দেশের বাজারে যেসব উৎপাদক ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান চা বাজারজাত করছে, তাদের নির্ধারণ করা দামেই বিনা বাক্যে তা কিনছি আমরা।

ইদানিং রপ্তানি কিছুটা বাড়লেও বাংলাদেশে উৎপাদিত চায়ের প্রধান গ্রাহক স্থানীয় পর্যায়ের ভোক্তা। দেশের বাজারে যেসব উৎপাদক ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান চা বাজারজাত করছে, তাদের নির্ধারণ করা দামেই বিনা বাক্যে তা কিনছি আমরা।

অথচ আমাদের মতো গ্রাহক-ক্রেতারা কখনো প্রশ্ন তুলিনি, এই চা উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের জীবন মানের কোনো উন্নয়ন হয়েছে কি না।

দেশ স্বাধীনের পর থেকে আজ অবধি চা-শ্রমিকরা যে মজুরি পান, তা দিয়ে কি দুবেলা খেতে পারেন তারা? লাখো চা-শ্রমিকের ঘাম ও চোখের জলে মিশানো চা আমরা বিনা প্রশ্নে কিনি, পান করি। চা-শ্রমিকদের দাস প্রথা এবং তাদের মানবেতর জীবনের দায় ভোক্তা হিসেবে আমরা কি এড়াতে পারি?

২০১৩ সালের আগে বাংলাদেশের রপ্তানিমুখি পোশাক কারখানায় কয়েকটি অগ্নিকাণ্ড ও ভবন ধসে অগণিত প্রাণহানির পর পশ্চিমা ভোক্তারা হৈচৈ শুরু করেন। তারা জোরালো দাবি জানান, 'সেই কাপড় গায়ে দিব না, যেই কাপড়ে শ্রমিকের রক্ত লেগে আছে।' ভোক্তাদের চাপে শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয় করে ইউরোপের ক্রেতা-ব্রান্ডগুলো অ্যাকর্ড আর আমেরিকার ব্রান্ডগুলো অ্যালায়েন্স তৈরি করলো। মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিলো। অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্স নিরাপদ কর্ম পরিবেশ এবং শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ শুরু করলো।

অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সের চাপে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো ভবনের নিরাপত্তা, অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থাসহ নিরাপদ কর্মস্থলের পাশাপাশি শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন নিশ্চিত করলো। বিস্ময়কর হলেও সত্য, বাংলাদেশে অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সের কর্মকাণ্ড শুরুর পর একটি রপ্তানিমুখি তৈরি পোশাক কারখানায়ও বড় ধরনের দুর্ঘটনা বা প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। যারা অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের অডিট পাস করতে পারেনি তারা রপ্তানি থেকে সরে গেছে এবং কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে।

এই যে ভোক্তাদের তৈরি চাপ একটা দেশের প্রধান রপ্তানি খাতে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করলো ও শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত হলো, এর পুরো কৃতিত্ব আসলে পশ্চিমা মানুষের। কারণ, তারা প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন।

কয়েক বছর আগে শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ এলাকার কয়েকটি চা বাগানে একটি ফিকশনের শুটিং করতে যাই। আমাদের ইউনিটকে বাগানে থাকা এবং শুটিংয়ের অনুমতি দেওয়া হয় শর্ত সাপেক্ষে। আগেই নিষেধ করা হয় নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে আমরা যেন না যাই। সঙ্গে দেওয়া হয় অনুমোদিত এলাকার বাইরে ক্যামেরা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা। কোথাও ঘুরতে গেলে আমাদের সঙ্গে বাগান কর্তৃপক্ষের কাউকে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করা হয় নিরাপত্তার অজুহাতে।

শুটিংয়ের অবসরে একদিন আমরা ঘুরতে যাই। যথারীতি বাগানের এক কর্মকর্তাও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। হঠাৎ চোখে পড়লো কয়েকজন নারী (চা-শ্রমিক) নালায় গোছল করছেন। অনেকটা পুরনো দিনের সিনেমার মতো। গাড়ি থামিয়ে নামলাম। কয়েকটা স্টিল ছবি তুললাম মোবাইল ফোনে। সঙ্গে থাকা কর্মকর্তা যখন বুঝতে পারলেন ছবি তুলছি, তিনি নেমে এলেন। ছবি দেখতে চাইলেন। সরল বিশ্বাসে দেখালাম। তিনি ফোনটা হাতে নিয়ে সবগুলো ছবি ডিলিট করে দিলেন; আমাদের সেন্সর বোর্ডের মতো। বললেন, এভাবে ছবি তুললে শ্রমিকদের হামলার মুখে পড়ার আশংকা আছে। এই ঘটনা আমাকে কৌতূহলী করলো। ভাবলাম, একদা সাংবাদিক সব সময়ই সাংবাদিক।

খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, চা-শ্রমিকদের নিরাপদ আবাসনের সঙ্গে পাকা শৌচাগার ও নারীদের জন্য চার দেয়ালের গোছলখানা বানানো বাগান কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। যেসব বাগানে এই নিয়ম মানা হয় না, সেখানকার শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে ছরা বা নালায় গোছল করেন, যা অস্বাস্থ্যকর। বুঝতে বাকি রইল না, সঙ্গে থাকা বাগানের কর্তা ব্যক্তি কেন ছবিগুলো ডিলিট করে দিয়েছিলেন কিছু না বলে।

পরদিন আরও কৌতূহল নিয়ে কাউকে না জানিয়ে দেখতে গেলাম শ্রমিকদের ঘর-বাড়ি। শ্রীমঙ্গলে এমনিতে প্রচুর বৃষ্টি হয়। মৌসুম হলেতো দিন-রাত লাগাতার। শ্রমিকদের অধিকাংশ ঘরেই থালা, গামলা বা বালতি দিয়ে বৃষ্টির পানিতে ঠোকানোর প্রচেষ্টা চোখে পড়ে। চালের পুরনো টিনগুলোর অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে আসা বৃষ্টির পানি ঠেকানোর আর কোনো উপায় এসব শ্রমিক পরিবারের জানা নেই। কর্তা ব্যক্তিরা এগুলো দেখে শ্রমিকদের কষ্টও অনুভব করেন। তবে মালিকরা এগুলো পাত্তা দেন না। শ্রমিকদের রক্ত চুষে খাওয়াই যেন তাদের ব্যবসার মূলনীতি। এই অনুভূতি সেদিন আমার হয়েছিল।

অনেকের জানা, চা-শ্রমিকদের জীবনটা আসলে এক করুন ইতিহাস। ব্রিটিশ আমলে তাদের দাস শ্রমিকের মতো শ্রীলঙ্কা থেকে জাহাজ বোঝাই করে আনা হয়েছিল। অভাবের কারণে তারা আর কোনো দিন শ্রীলঙ্কায় ফিরতে পারেননি। বংশ পরম্পরায় তারা এখানে জীবন-যৌবন শেষ করছেন। এমনকি তারা তাদের আদি ভাষা-সংস্কৃতি সব হারিয়েছেন। পাকিস্তান আমলে তাদের ভোটাধিকার ছিল না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের ভোটাধিকার দিয়েছিলেন বলে ঐতিহাসিকভাবে তারা আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দেন। কালের প্রবাহে এখন অনেক বাগানে মুসলমান শ্রমিকও যুক্ত হয়েছেন।

আওয়ামী লীগের কয়েকজন সংসদ সদস্য আছেন, যারা বছরের পর বছর এই চা-শ্রমিকদের ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এইসব সংসদ সদস্যদের বছর বছর সম্পদ বেড়েছে। কেউ কেউ মাছ চাষি হিসেবে ট্যাক্স রিটার্ন দিয়ে অল্প ট্যাক্সে কালো টাকা সাদাও করেছেন। কিন্তু তাদের ভোটার এই সব নিরীহ চা-শ্রমিকরা দিনে ১২০ টাকা মজুরি পেয়ে দুবেলা খেতে পারেন না। কারণ এই টাকা দিয়ে দুবেলার চালই হয় না, মাছ-মাংস এবং তেল কেনার কথা কল্পনাই করা যায় না মুদ্রাস্ফীতির উচ্চহারের এই সময়ে। দুপুরে তাই শ্রমিকরা শুধু চা পাতা পিষে ভর্তা করে আহারের কাজ সারেন। আমিও এই অভিজ্ঞতা নিয়েছি।

অথচ বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাত বা অন্য খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দিনে ৩০০ টাকার কম নয়। সত্যি কথা হলো, চা-শ্রমিকদের দিনে ১২০ টাকা মজুরির কথা কাগজে-কলমে থাকলেও খুব কম সংখ্যক শ্রমিক এই টাকা পান। চা পাতা তোলার ওপর এই মজুরি নির্ভর করে বলে অনেক সময় তারা এটিও পান না। খাবার আর বাসস্থানের করুন অবস্থার বর্ণনা দিতে পারলেও তাদের আরও দুটি মৌলিক অধিকার—শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে কি আর বলবো। ওই জঙ্গলে এর কোনো ব্যবস্থা আদতে নেই। দু-একটা এনজিও শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করলেও, কোনো বাগানে হাসপাতাল চোখে পড়েনি। বাগান কর্তৃপক্ষ প্যারাসিটামল ছাড়া আর কোনো ওষুধের ব্যবস্থাও রাখে না।

বাংলাদেশের ২৪১টি চা বাগানের প্রায় দেড় লাখের বেশি শ্রমিক মজুরি বাড়ানোর দাবিতে গত কয়েকদিন ধরে আন্দোলন করছেন। তাদের এই আন্দোলন-ধর্মঘটের ফলে চা শিল্পে একটি অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। তারা ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবি করছেন। কিন্তু মালিকপক্ষ এই যৌক্তিক দাবি মানতে রাজি নয়। গত বুধবার শ্রমিক-মালিক ও  শ্রম অধিদপ্তরের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকেও এ বিষয়ে কোনো সমাধান আসেনি। গত বৃহস্পতিবার শ্রমিকরা তাদের ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর সহজ-সরল এই শ্রমিকদের মাত্র ২৫ টাকা দৈনিক মজুরি বাড়ানো হয়েছে—যা এই বাজারে কিছুই না।

অন্ন, বস্ত্র, চিকিত্সা, শিক্ষা এবং বাসস্থানের মতো চা পান অপরিহার্য নয়। যে চা উত্পাদনে এই দেশে শ্রমিককে শোষণ করা হয়, সেই চা পান না করলে কী যায় আসে আমাদের? যতদিন চা-শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায় না হবে ততদিন চা পান করলে ভোক্তা হিসেবে এই দায় আমাদের কাঁধে চলে আসে অবধারিত ভাবে। নিরীহ শ্রমিকের ঘাম ও চোখের জলে মিশানো এই দেশের সকল চায়ের ব্রান্ডকে ভোক্তারা না বললেই কেবল শ্রমিকদের জীবন মানের উন্নয়ন হতে পারে।

জসিম আহমেদ: চলচ্চিত্র নির্মাতা

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments