যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ পার্টি ও আমাদের রাজনীতি

নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় লাভ করে প্রধানমন্ত্রী হওয়া বরিস জনসন যখন কোভিড-১৯ বিধিনিষেধ ভেঙে পার্টি আয়োজন করায় পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন, তখন বাংলাদেশের অনেকে হেসেছিলেন। জনসমক্ষেও নয়, নিজের কার্যালয়ের গোপনীয়তায় ওই পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল। জনগণের বিপুল সমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হওয়া একজন প্রধানমন্ত্রী কীভাবে এ ধরনের সামান্য (আমাদের বিবেচনায়) ঘটনায় পদত্যাগে বাধ্য হলেন?

নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় লাভ করে প্রধানমন্ত্রী হওয়া বরিস জনসন যখন কোভিড-১৯ বিধিনিষেধ ভেঙে পার্টি আয়োজন করায় পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন, তখন বাংলাদেশের অনেকে হেসেছিলেন। জনসমক্ষেও নয়, নিজের কার্যালয়ের গোপনীয়তায় ওই পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল। জনগণের বিপুল সমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হওয়া একজন প্রধানমন্ত্রী কীভাবে এ ধরনের সামান্য (আমাদের বিবেচনায়) ঘটনায় পদত্যাগে বাধ্য হলেন?

৬ সেপ্টেম্বর লিজ ট্রাস প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র ৪৪ দিনের মাথায় গত ২০ অক্টোবর যখন পদত্যাগ করলেন, তখন আমরা মনে করেছিলাম, এবার বুঝি যুক্তরাজ্যের গণতন্ত্র গেল! আমাদের সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভু এখন একটি স্থিতিশীল সরকার গঠনের সামর্থ হারিয়েছে এবং তারা জানে না, কাকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী করবেন।

এসব ভেবে আমরা হাসি চেপে রাখতে পারিনি।

তারপর দৃশ্যপটে এলেন ৪২ বছর বয়সী ঋষি সুনাক— গত ২০০ বছরের মধ্যে যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী তিনি। আমরা ধরেই নিলাম, এক সময় যে সাম্রাজ্যে কখনো সূর্যাস্ত হতো না, সেখানে আজ যোগ্য লোকের এতই অভাব দেখা দিয়েছে যে, তারা নিজেদের মধ্যে যোগ্য কাউকে না পেয়ে ভারত ও কেনিয়া বংশোদ্ভূত একজনকে শাসক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য খুঁজে বের করেছে।

আমরা যুক্তরাজ্যকে নিয়ে উপহাস করতে থাকি।

আমার মতে, এই ৩টি ঘটনার ক্ষেত্রেই আমরা বোকার মতো হেসেছি। আমরা হেসেছি, তার কারণ আমরা নির্বাচনের অর্থ ভুলে গেছি। ভোটার হিসেবে আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা ভুলে গেছি এবং তাদের নৈতিকতা ও জবাবদিহিতার বিষয়ে প্রশ্ন তোলা ছেড়ে দিয়েছি। আমরা দেশের নাগরিক, ভোটার ও করদাতা হিসেবে নিজেদের অধিকারগুলো ত্যাগ করেছি।

আমরা বরিস জনসনের পদত্যাগে হেসেছি কারণ, দীর্ঘদিন ধরে আমরা সবস্তরের জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে ন্যায়-নীতির বিষয়ে কোনো ধরনের 'জবাবদিহির' প্রত্যাশা থেকে বহু দূরে সরে গেছি, বিশেষ করে সর্বোচ্চ পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের। সামান্য যে আইনি জবাবদিহি অবশিষ্ট রয়েছে, সেটাও আইনের যান্ত্রিক ব্যাখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ; নৈতিক মূল্যবোধ ও নীতিপরায়ণতা থেকে বিচ্যুত। (স্মরণ করুন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের কথা। নির্বাচন কমিশন ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ জন সংসদ সদস্যকে কোনো প্রকার ভোট ছাড়াই 'নির্বাচিত' হওয়ার বিষয়টিকে মেনে নিলেন— যে সংখ্যাটিই সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট ছিল। বিপুল সংখ্যক জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া সামান্য একটি কারিগরি ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে তারা এটা করলেন। এই ১৫৩টি আসনে একটি ভোটও পড়েনি। যদি নির্বাচনের অর্থ এটা হয় (এর অর্থ অন্য কিছু হতে পারে না)— ভোটাররা সরাসরি নিজেদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে ব্যালটে ভোট দিয়ে তাদের নির্বাচিত করতে পারছেন না, তাহলে একে নির্বাচন বলা যায় না। এই ১৫৩ আসনের 'মানুষ' (ভোটার) কোথায় ছিলেন? তারপরও নির্বাচন কমিশন এখানে নীতি-নৈতিকতার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা দেখেনি)।

সহজ কথায় বলতে গেলে, আমাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের এবং যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের আবির্ভাব, সেখানে কোনো জবাবদিহি নেই। প্রতি ৫ বছর অন্তর আমাদের জনপ্রতিনিধিরা ভোটারদের সামনে আসেন এবং পরের বার আসার সময় হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা কী করেন, সেটা জনগণের পর্যবেক্ষণের বাইরেই থাকে। এ কারণেই আমাদের কাছে বরিস জনসনের পদত্যাগের বিষয়টি এত অদ্ভুত এবং তার অপরাধকে আমাদের কাছে এত সামান্য ঘটনা বলে মনে হয়। জনসন এবং তার দল উভয়ে স্বীকার করেছেন, তিনি 'নৈতিক' জবাবদিহিতার পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন। আমাদের কোনো দলের কোনো নেতা কি এ ধরনের পরীক্ষার মুখোমুখি হতে পারবেন?

এবার লিজ ট্রাসের পদত্যাগের বিষয়ে আসা যাক। আরেকটি জবাবদিহির উদাহরণ এটি। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি একটি 'মিনি' বাজেট প্রণয়ন করেন, যেখানে তিনি বড় আকারে কর কর্তনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে কর কর্তনের ফলে যে ঘাটতি হবে, তা কীভাবে মেটাবেন, সেটা তিনি দেখাতে পারেননি। ফলে বাজারে এর তাৎক্ষণিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ও সংসদ সদস্যরা জনগণের সমর্থন হারানোর আসন্ন সম্ভাবনা, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি অস্থিতিশীলতা ও বিভ্রান্তি থেকে বাঁচতে নতুন প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগে বাধ্য করেন।

এটা হচ্ছে দলের প্রতি জবাবদিহি।

কনজারভেটিভ পার্টির সাম্প্রতিক নেতৃত্বের পালাবদলে গত ৪ মাসের মধ্যে ৩ জন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ পেয়েছেন, যা আপাতদৃষ্টিতে খুবই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বলে মনে হতে পারে। তবে এই নজিরবিহীন পরিস্থিতিতেও সব কার্যক্রম ওই দেশের আইনে নয়, বরং কনজারভেটিভ পার্টির নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুযায়ী চলেছে। বরিস জনসনকে উৎখাত করায় তিনি কোনো 'ষড়যন্ত্রের' গন্ধ পাননি। শুরু থেকেই দলের জরিপে সুস্পষ্টভাবে এগিয়ে থাকলেও লিজ ট্রাস প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ঋষি সুনাক তার সমর্থকদের নিয়ে পথে নেমে যাননি এবং শেষ পর্যন্ত লিজ ট্রাস দলের আস্থা হারানোর পর মাথা নত করে সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন। এ ঘটনায় তিনি 'বাইরের শক্তির' কোনো সংযোগ থাকার দাবিও তোলেননি।

এখান থেকে আমাদের যা শেখা দরকার, তা হলো সেখানে একটি 'সিস্টেম' বজায় রয়েছে। সংসদীয় ব্যবস্থায় মানুষ একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সংসদ সদস্যদের নির্বাচিত করার মাধ্যমে একটি দলকে দেশ পরিচালনার জন্য নির্বাচিত করে। এরপর সংসদ সদস্যরা যাকে তাদের নেতা হিসেবে নির্বাচন করেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না দল অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি ওই দায়িত্ব পালন করেন। সুতরাং, ২০১৯ সালের নির্বাচনে বরিস জনসনের কারিশমা, ভোটারদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন ও তাদের প্রভাবিত করতে পারার দক্ষতার কারণে কনজারভেটিভ পার্টি জয়লাভ করেছিল। তারপরও দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে তার দল, তিনি নন।

এ ঘটনা যেটি মনে করিয়ে দেয় তা হলো, দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা ভুলে গেছি— নেতার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা হলো ব্যক্তি বনাম প্রতিষ্ঠানের মতো। এই অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশে যে ধরনের সংসদীয় ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়, যেখানে দলের ভূমিকা পুরোপুরি নেতার ভূমিকার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত। এই নেতারা শক্ত হাতে দলকে নিয়ন্ত্রণ করেন, যার ফলে নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, বরং কোনো নীতিমালার ক্ষেত্রে কোনো সংসদ সদস্য সামান্য প্রশ্ন তুললেই তা গর্হিত অপরাধ হিসেবে মনে করা হয়। দলের মধ্যে কেউ এ ধরনের কাজ করলে সেটাকে নেতার বিরুদ্ধে 'বিশ্বাসঘাতকতা' হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে বিদ্রোহী সংসদ সদস্য হিসেবে প্রধানমন্ত্রীরা তার নাম ভুলিয়ে ছাড়েন।

ঋষি সুনাকের ক্ষমতায় আসার ঘটনায় যে বিষয়টির প্রশংসা করা উচিত, তা হলো কনজারভেটিভ পার্টি মানসিকতা— যে দলটি তার নামের মাধ্যমেই জানান দেয় যে এটি একজন ভারতীয়-কেনীয় বংশোদ্ভূত, হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে (যুক্তরাজ্যের আনুষ্ঠানিক ধর্ম খৃস্টধর্ম হলেও অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি গীতা সামনে রেখে শপথ নেন) নির্বাচিত করার ক্ষেত্রে 'কনজারভেটিভ' বা রক্ষণশীল। তা ছাড়া এমন একটি সময়ে ঘটনাটি ঘটলো, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে 'শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য' দেখা দিয়েছে এবং ইউরোপের দেশগুলো অভিবাসন-বিরোধীতে পরিণত হচ্ছে, যার সবশেষ উদাহরণ হলো ইতালির উগ্র ডানপন্থি ও ফ্যাসিবাদী দলের সঙ্গে সংযুক্ত নেত্রী জর্জিয়া মেলোনির নির্বাচনে জয়লাভ করে প্রধানমন্ত্রী হওয়া।

তবে একজন 'বাদামি সাহেব' হওয়ার চেয়েও ঋষি সুনাকের ক্ষেত্রে নেতিবাচক কিছু ঝুঁকি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষ করে অভিবাসনগত নীতির ক্ষেত্রে তার দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে, যার সুফল তিনি ও তার পরিবার ভোগ করছেন। সুনাকের শাসনামলের প্রাথমিক লক্ষণগুলো কিছুটা চিন্তার উদ্রেককারী, বিশেষ করে তার মন্ত্রিসভার নিয়োগের বিষয়ে।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments