বিজয় দিবস ও আমাদের অপারগতা

পৃথিবীর প্রায় সব স্বাধীন দেশেরই আছে স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু বিজয় দিবস নামে বিশেষ বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত এবং বিপুল গৌরবমণ্ডিত দিন সব জাতির ইতিহাসে নেই; সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে স্বাধীনতা ঘোষণার পর সফলভাবে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জনও সব জাতিকে করতে হয়নি। বাঙালি জাতি সেই অনন্য সাধারণ কাজটি করেছে বলেই তাদের কাছে বিজয় দিবসের তাৎপর্য ও ব্যঞ্জনা অপরিসীম।
বিজয় দিবস ও আমাদের অপারগতা
ছবি: স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

পৃথিবীর প্রায় সব স্বাধীন দেশেরই আছে স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু বিজয় দিবস নামে বিশেষ বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত এবং বিপুল গৌরবমণ্ডিত দিন সব জাতির ইতিহাসে নেই; সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে স্বাধীনতা ঘোষণার পর সফলভাবে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জনও সব জাতিকে করতে হয়নি। বাঙালি জাতি সেই অনন্য সাধারণ কাজটি করেছে বলেই তাদের কাছে বিজয় দিবসের তাৎপর্য ও ব্যঞ্জনা অপরিসীম।

শত বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের গণমানুষ সবচেয়ে বীরত্বপূর্ণ ও গৌরবময় অধ্যায় রচনা করেছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। শুধু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ তো নয়, বাঙালি প্রাণপণ যুদ্ধের মাধ্যমে শক্তিশালী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে সেই যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে। অঞ্চলভিত্তিক খণ্ড যুদ্ধজয়ের দু-একটি দৃষ্টান্ত অতীতে থাকলেও ভাষাভিত্তিক বাঙালিত্বের পরিচয়ে এবং বাঙালি  জাতীয়তার ভিত্তিতে এমন শৌর্য-বীর্যময় বিজয় লাভ  বাঙালির জাতীয় জীবনে আগে কখনো ঘটেনি। অথচ ১৯৭১ সালের এ যুদ্ধ ছিল এক অসম যুদ্ধ, ভোটযুদ্ধে জয়ী শান্তিকামী নিরস্ত্র বাঙালির ওপরে যুদ্ধবাজ পাকিস্তানি সামরিক শাসকের চাপিয়ে দেওয়া একতরফা যুদ্ধ।

২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে বর্বর পাকিস্তানি সৈনিকেরা বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় অতর্কিত সশস্ত্র হামলা চালিয়ে পৈশাচিক হত্যালীলায় মেতে ওঠে, অগ্নিসংযোগ লুণ্ঠন আর নারী নির্যাতনের মধ্য দিয়ে সারা দেশে চরম ত্রাস সৃষ্টি করে। দুঃসহ এই জীবন-মরণ সংকটের মুখে বাঙালিকে আত্মরক্ষার তাগিদেই ঘুরে দাঁড়াতে হয়, সত্যিকারের যুদ্ধের জন্য সার্বিক প্রস্তুতি নিতে হয় এবং মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য প্রাণ বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়।  যুদ্ধবিমুখ নিরস্ত্র বাঙালির ঐক্যবদ্ধ শক্তি, সাহসিকতা ও প্রবল দেশপ্রেমের কাছে আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী পাকিস্তানি সৈন্যের পরাজয় ও আত্মসমর্পণের মধ্য  দিয়ে অর্জিত হয় বাঙালির বিজয়, সার্থক হয় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।

এরই মধ্যে পেরিয়ে এসেছি বিজয়ের অর্ধ শতক। মহার্ঘ্য এই অর্জন নিয়ে আমাদের আনন্দ ও শ্লাঘা পর্বতপ্রমাণ। কিন্তু বিরাট এই পর্বতের ভিত্তি রচিত হয়েছে যাদের রক্তের মূল্যে, জাতীয়ভাবে তাদের অবদান কীভাবে এবং কতখানি মূল্যায়িত হয়েছে সেটা খতিয়ে না দেখলেই নয়।

বিশেষ করে দৃষ্টি ফেরাতে চাই 'তিরিশ লাখে'র সংখ্যাগত প্রাকারে বন্দি শহিদদের দিকে। মুক্তিযুদ্ধে নানা রকমের অবদানের জন্য এরই মাঝে সরকার নানান স্বীকৃতি, সনদ ও ভাতা প্রদানের যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তা প্রশংসনীয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এ নিয়ে বেশ বিতর্কও তৈরি হয়েছে। এটা হয়েছে সর্বজনগ্রাহ্য নির্ভেজাল মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়নের ব্যর্থতার কারণে। সরকারের সচিব পর্যায়েও যখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম সন্নিবেশিত হয়ে যায়, তখন আর এ নিয়ে মন্তব্য করার কী বাকি থাকে।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা মুক্তিযোদ্ধার নির্ভুল তালিকা প্রস্তুত করতে পারিনি। এরচেয়ে গ্লানিকর আর কী হতে পারে! পারিনি আরও অনেক কিছুই। আমাদের গীতিকবি বুকের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া গান লিখেছেন 'দুঃসহ বেদনার কণ্টকপথ বেয়ে শোষণের নাগপাশ ছিঁড়লে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না'। লিখেছেন, 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না'। তা বেশ, তাদের ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না, শোধ হওয়ারও নয়। কিন্তু প্রশ্নটা এইখানে— তারা সত্যিই কতজন ছিলেন? এক দুই তিন চার করে কাঁটায় কাঁটায় ঠিকঠাক সঠিক সংখ্যা না হয় না-ই হলো, তাদের নাম-ঠিকানা, সেইটুকুও কী কোথাও লেখা হবে না?

মুক্তিযোদ্ধার তালিকা শুধু নয়, মুক্তিযুদ্ধের কারণে যারা শহিদ হয়েছেন, রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা অথবা অমুক্তিযোদ্ধা শহিদ (সাধারণ মানুষ) যা-ই হন না কেন, সেই শহিদের তালিকাও নেই আমাদের হাতে। বলা হয়, তিরিশ লাখ শহিদের কথা। এই সংখ্যা নিয়েও অভব্য ও অরুচিকর বিতর্ক তৈরির চেষ্টা এ দেশে হয়েছে। এ বিতর্ক যে কোনো প্রকার সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তা এই 'তিরিশ লাখের' প্রাকারবন্দি হতভাগ্য (!) মানুষগুলোর কোনো পরিচয় জাতি জানতে পারবে না কখনো? শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের তবু এক প্রকার তালিকা পাওয়া যায়, মুক্তিযুদ্ধের কারণে যে সমস্ত সাধারণ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, তাদের কি কোনোদিন কোনো রকম তালিকাই হবে না? খাস জমি কিংবা সরকারি ভাতা না হোক বরাদ্দ তাদের নামে, তবু শহিদের স্বীকৃতিটুকু অন্তত দেওয়া যাবে না? কারো উত্তরপুরুষ যদি জাতির কাছে জানতে চায়— আমার পূর্ব পুরুষ ১৯৭১ সালে তার নিজ বাড়িতেই পাকিস্তানি সৈনিকের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে, তবু তাকে শহিদ বলা হবে না কেন? রাষ্ট্রের কোনো দলিলপত্রে তাকে শহিদ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি কেন? তার এই প্রাণদানের কোনো মর্যাদা নেই? কেবল 'তিরিশ লাখের' প্যাকেটে ঢুকিয়ে রাখলেই চলবে?

আমরা কিছুতেই ভুলে যাব না যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুধুমাত্র দুই দল সৈনিকের শক্তি পরীক্ষার যুদ্ধ ছিল না। একেবারে শুরু থেকেই অগণিত সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে তা হয়ে ওঠে জনযুদ্ধ। সৈন্যবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান তৈরি করা যত সহজ, মনে রাখতে হবে জনযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ মোটেই তত সহজ নয়। কিন্তু আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তাও অসম্ভব নয়। প্রয়োজন আন্তরিকতা ও বাস্তবতার নিরিখে উপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ। এ ধরনের শুভ উদ্যোগের জন্য জাতিকে আর কত অপেক্ষা করতে হবে কে জানে!

শোনা যায়— 'তিরিশ লাখ' এই সংখ্যা নিয়েও কোনো কোনো মহলে বিশেষ উদ্বেগ আর শঙ্কা রয়েছে, পাছে শহিদের সংখ্যা যদি ওই পরিমাণ না হয়! যেন বা এ জন্যে খুব লজ্জায় পড়তে হবে তাদের! কেন, তাদের লজ্জিত হতে হবে কেন? সত্যের ভার বহনে লজ্জা পাওয়ার তো কিছু নেই।

আমার প্রবল বিশ্বাস, এখনো নিরপেক্ষভাবে গ্রামে গ্রামে সরেজমিনে হিসাব নিতে পারলে শহিদের সংখ্যা তিরিশ লাখেরও অধিক হবে। তিরিশ লাখের প্রাকার ভেঙে শহিদের প্রকৃত সংখ্যা ও সঠিক পরিচয় লিপিবদ্ধ করার সময় এখনো একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। শহিদের সংখ্যাগত বিতর্কের বাতি উসকে দেওয়ার বদমতলব থেকে এ নিবন্ধ রচনা করা হয়নি। বরং মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা নির্বিশেষে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী সকল শহিদের প্রতি সত্যিকারের সম্মান জানানোর তাগিদ থেকেই লেখাটি।

শহিদদের সঠিক নাম-পরিচয় উদ্ধার শুধু নয়, স্থানীয়ভাবে তাদের নামে বিভিন্ন স্মারক নির্মাণ, স্কুল-কলেজ ও সড়ক-সেতুর নামকরণের উদ্যোগও নেওয়া যেতে পারে। শহিদের উত্তর প্রজন্ম এই নামকরণের মধ্যেও দেশের প্রতি তাদের পূর্বপুরুষের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি ও স্বস্তি খুঁজে পাবে। এটুকু করার জন্য শহিদ-পরিবারের পক্ষ থেকে কখনো কোনো দাবি উত্থাপন করা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। হয়তো কোনোদিন এ দাবি তারা করবেনও না। এটা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদেরই কর্তব্য। যাদের প্রাণের মূল্যে মহান মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত হয়েছে বিজয়, আমরা পেয়েছি বহু প্রত্যাশিত ও প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা, তাদের বিদেহী আত্মার প্রতি সম্মান জানানোর দায় সকলেরই।

শহিদের সংখ্যার পাশাপাশি যুদ্ধকালে সম্ভ্রমহারা নারীদেরও সঠিক সংখ্যা ও পরিচয় উদ্ধার করা খুবই জরুরি। কাজী নজরুল ইসলাম 'কোন রণে কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর' বলে স্বামীহারা অকাল বিধবাদের সংখ্যার দিকে দৃষ্টিপাত করে খেদোক্তি জানিয়েছেন, যে শহিদদের নামের পাশে তাদের নাম কখনো লেখা হয় না। আমরা আর এক ধাপ এগিয়ে 'সিঁথির সিঁদুর' হারানো শহিদ-পত্নীদের নাম ছাড়িয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্যে সম্ভ্রমহারা বীরাঙ্গনাদের কথা বলতে চাই। তাদের প্রতি সম্মান জানানোর মহৎ উদ্দেশ্যেই তাদের নির্ভুল তালিকা প্রস্তুত করা প্রয়োজন। সন্দেহ নেই, এতদিন পরে এ কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন বড়ই কঠিন। তবু সত্যিকারের ইতিহাসের প্রতি দায়বোধ থেকে বলতেই হয়, বিলম্বে হলেও এই কঠিন কাজে হাত দেওয়াও প্রয়োজন।

অন্যদিকে আন্তরিকতা নিয়ে কাজে হাত দিলে এই কুখ্যাত স্বাধীনতা বিরোধীদের তালিকাও প্রস্তুত করা সম্ভব। প্রশ্ন উঠতে পারে, এতদিন পরে কী হবে এ তালিকা করে? কী হবে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করা সম্ভব, কিন্তু এখন থাক সে আলোচনা। এখন শুধু বলি— সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো না বলাও এক রকম পাপ, এক রকম অন্যায়। এ পাপের বোঝা আর কতকাল বয়ে বেড়াব আমরা?

বিজয় দিবসের প্রাক্কালে, আমাদের এতদিনের অপারগতাগুলোর বিশ্লেষণ করি সাদা চোখে, নিরপেক্ষ ভাবে। আর কিছু না পারি, মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী শহিদদের প্রকৃত পরিচয় খুঁজে বের করার পক্ষে জোর দাবি তুলি এবং তাদেরকে 'তিরিশ লাখের' সংখ্যাগত প্রাকারের বাইরে বের করে আনি। 'হয়তোবা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না' গানের এই বেদনাধোয়া বাণী বুকে ধারণ করেই বলতে চাই, ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম লেখার উদ্যোগ আজ হোক, কাল হোক, আমাদের নিতে হবে।

Comments