ডিজিটাল প্রভুত্ব এবং রাষ্ট্র বোঝার তরিকা
রাষ্ট্র বোঝার জন্য অনেক বড় গবেষণার প্রয়োজন হয় না। একজন সাধারণ নাগরিক রাষ্ট্রীয় সেবা পেতে গিয়ে কী ধরনের আচরণের সম্মুখীন হয় বা তাকে কী কী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়—সেটি খেয়াল করলেই বোঝা যায়।
চট্টগ্রামে মায়ের কিডনি ডায়ালাইসিসের খরচ নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন এক তরুণ। অথচ রাষ্ট্রের উচিত ছিল, এরকম একটি জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে প্রতিবাদকারী ওই তরুণের দাবিটি যৌক্তিক কি না, সেটি অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া এবং তার মায়ের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা। সেটি না করে তাকে গ্রেপ্তার করে হাসপাতালে ভর্তি অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা ব্যহত করা হলো। এটি কোনো মানবিক রাষ্ট্রের কোনো দায়িত্বশীল বাহিনীর আচরণ হতে পারে না—সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় যাদের বেতন হয়।
প্রশ্ন হলো, কেন এইসব মানবিক ইস্যুতে আন্দোলন বা প্রতিবাদকারীদেরও পুলিশ বা রাষ্ট্রের অন্য কোনো বাহিনী আটক করে? কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে, সেখানে সরকারের কোনো নীতি বা কর্মকাণ্ডের সমালোচনাকেও সরকারবিরোধিতা এবং সরকারবিরোধিতাকে 'রাষ্ট্রদ্রোহিতা' হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
ঘটনাটি গত ১০ জানুয়ারির। ডায়ালাইসিস ফি বৃদ্ধি ও সরকারিভাবে ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে কিডনি রোগীর স্বজনদের বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে মুস্তাকিম নামে ওই তরুণকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। যথারীতি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, 'সরকারি কাজে বাধা দান ও পুলিশের ওপর হামলা'। গণমাধ্যমের খবর বলছে, অষ্টম শ্রেণি থেকে টিউশনি করে মায়ের চিকিৎসা ও পরিবারের খরচ চালিয়ে আসছেন মুস্তাকিম। কিন্তু ডায়ালাইসিসের খরচ বেড়ে যাওয়া এবং সরকারির ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ করায় তিনি গ্রেপ্তার হন। পরে তার পক্ষে দাঁড়ায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন। তিনি আদালত থেকে জামিন পান।
চট্টগ্রামের এই তরুণের পক্ষে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দাঁড়ালেও আরেকটি জাতীয় কমিশনের ব্যাপারে আসছে উল্টো খবর। ১৮ জানুয়ারি দেশের একাধিক শীর্ষ সংবাদপত্রের খবরের শিরোনাম: দখলদারদের পক্ষে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন। খবরে বলা হয়, দেশের নদ-নদী দখলদারদের তালিকা তৈরিতে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এর কাজ শেষ হয় গত ডিসেম্বরে। প্রকল্পটির মাধ্যমে ৩৭ হাজার ৩৯৬ নদ-নদী দখলদারকে চিহ্নিত করা হয়, যা কমিশনের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু ডিসেম্বরেই এক সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সে তালিকা ওয়েবসাইট থেকে মুছে দিয়েছে কমিশন নিজেই। এমনকি প্রকল্পের প্রতিবেদনও গ্রহণ করেনি।
বাংলাদেশের প্রাণ তার নদীগুলো। যে কারণে এই দেশকে বলা হয় নদীমাতৃক। অর্থাৎ নদী যে দেশের মা, সেই দেশের নদীগুলো অপরিকল্পিত উন্নয়ন আর মানুষের লোভের শিকার হয়ে এখন বিপন্ন। নদীকে সেই বিপন্নতার হাত থেকে বাঁচাতে প্রধান দায়িত্ব যার; উচ্চ আদালতও যাকে বলেছেন 'নদীর অভিভাবক'—সেই জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনই যদি নদীর সবচেয়ে বড় শত্রু দখলদারদের পক্ষে দাঁড়ায়—তাহলে মানুষ কোথায় যাবে? কার কাছে বিচার চাইবে? কে নদী বাঁচাবে? রাষ্ট্র বোঝার জন্য এটিও কি একটি বড় উদাহরণ নয়?
রাষ্ট্র বোঝার জন্য রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের আচরণের দিকে খেয়াল রাখা জরুরি। তারা কী বলেন, কীভাবে বলেন, নাগরিকদের প্রতি তাদের মনোভাব ও ভঙ্গি কেমন—সেখানে অনেক ইঙ্গিত থাকে। যেমন সম্প্রতি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) থেকে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে যে, এখন থেকে সব অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনে বিজয় কি–বোর্ড ব্যবহার করতে হবে। এজন্য মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, স্মার্টফোনগুলো কমিশন থেকে বাজারজাতকরণের অনুমতি নেওয়ার আগে এপিকে ফাইলটি ইনস্টল করে তা প্রদর্শন করতে হবে।
প্রসঙ্গত, বিজয় বাংলা কি–বোর্ড সফটওয়্যারের স্বত্বাধিকারী ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। তার মানে এখানে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের সংঘাত আছে। টেলিযোগাযোগমন্ত্রী হয়ে নিজের কোম্পানির সফটওয়্যার ব্যবহারের জন্য তিনি বিটিআরসিকে দিয়ে নির্দেশনা জারি করতে পারেন কি না, সে প্রশ্নও আছে। তাছাড়া বিজয় কি-বোর্ড ইউজার ফ্রেন্ডলি (ব্যবহারবান্ধব) সফটওয়্যার নয় এবং মোবাইল ফোন যেহেতু ব্যক্তিগত সম্পত্তি, অতএব এখানে কোন ব্যবহারকারী কোন সফটওয়্যার ব্যবহার করবেন—সেই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। মোবাইল ফোনে কে কোন অ্যাপ বা সফটওয়্যার ব্যবহার করবেন, রাষ্ট্র সেটি ঠিক করে দিতে পারে কি না—সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ফলে এই নির্দেশনার মধ্য দিয়ে মোবাইল ফোন গ্রাহকের পছন্দের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হলো কি না—সেই প্রশ্ন উঠছে এবং কেউ কেউ এই ঘটনাকে 'ডিজিটাল প্রভুত্ব' বলেও মন্তব্য করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. বি এম মইনুল হোসেনের ভাষায়: কি-বোর্ডের মতো সফটওয়্যার বা অ্যাপের গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হলো, এর নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট দিকগুলো। এই কি-বোর্ড দিয়ে মুঠোফোনে কখন কী টাইপ করা হচ্ছে, তার সবকিছুই রেকর্ড করে রাখা সম্ভব। তা সে পাসওয়ার্ড হোক, বন্ধুকে পাঠানো খুদে বার্তা হোক কিংবা আর্থিক লেনদেনের তথ্যই হোক। 'কি-লগার' নামক একধরনের ম্যালওয়ার এই পদ্ধতিতেই ব্যবহারকারীর ডিজিটাল নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলে দেয়। বিজয় কি-বোর্ড কি উন্মুক্ত (ওপেন সোর্স) সফটওয়্যার? তা না হলে, সেটি কীভাবে কাজ করে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার সরাসরি কোনো উপায় নেই। (প্রথম আলো, ১৮ জানুয়ারি ২০২৩)।
কাছাকাছি সময়ে গণমাধ্যমের আরেকটি বড় খবর, রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম বন্ধে 'আইনসম্মতভাবে' আড়ি পাতার ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। জাতীয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের বক্তব্য উদ্ধৃত করে গণমাধ্যমের খবরে জানানো হয়, ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মনিটরিংয়ের মাধ্যমে দেশ ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম বন্ধে এনটিএমসিতে (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার) ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজির (ওএসআইএনটি) মতো আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজিত হয়েছে। একইসঙ্গে একটি ইন্টিগ্রেটেড ল-ফুল ইন্টারসেপশন সিস্টেম, আইএলআইএস (আইনসম্মতভাবে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট মাধ্যমে যোগাযোগে আড়িপাতার ব্যবস্থা) চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, সরকার যে 'আইনসম্মতভাবে' আড়ি পাতার কথা বলছে, সেটি কোন আইনে? ফোনে আড়ি পাতা এবং ফোনালাপ প্রকাশ নিয়ে দেশের কোনো আইনে সুস্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। টেলিযোগাযোগ আইনের একটি ধারায় বলা হয়েছে, তদন্ত বা মামলার স্বার্থে টেলিফোন সেবাদাতা সংস্থা তাদের সব রকমের তথ্য নিরাপত্তা সংস্থাকে দিতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু তারা যে কারো ফোনে আড়ি পাততে পারবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। বরং বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩ (খ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকিবে।' অর্থাৎ নাগরিকরা চিঠিপত্র এবং যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যম যেমন ফোন, ই-ইমেল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করলে রাষ্ট্র তার গোপনীয়তা রক্ষা করবে। আইন বলছে, সুনির্দিষ্ট মামলা বা তদন্তের স্বার্থে ফোনকল রেকর্ড করা যাবে।
১৯৪৮ সালে ঘোষিত জাতিসংঘ মানবাধিকার ঘোষণার ১২ নম্বর আর্টিকেলেও বলা হয়েছে: 'কারো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কিংবা তার গৃহ, পরিবার ও যোগাযোগের ব্যাপারে খেয়াল খুশিমতো হস্তক্ষেপ কিংবা তার সুনাম ও সম্মানের ওপর আঘাত করা যাবে না। এ ধরনের হস্তক্ষেপ বা আঘাতের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।'
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, 'দেশের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের ষড়যন্ত্র রুখে দিতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।' প্রশ্ন হলো, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কথাটার মানে কী? প্রশ্নটা এ কারণে যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সরকারের কোনো নীতি বা কাজের সমালোচনা করলেও সেটিকে 'উন্নয়নবিরোধিতা' এবং 'দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র' বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। অথচ সরকারবিরোধিতা এবং দেশ বা রাষ্ট্রবিরোধিতার মধ্যে যে বিস্তর ফারাক আছে, সেটি আমাদের নীতিনির্ধারকরা অনেক সময়ই ভুলে যান।
যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো সরকারের সমালোচনা করবে; সরকারের বিভিন্ন নীতি ও কর্মকাণ্ডকে গণবিরোধী আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলবে; মিছিল-মিটিং করবে; গণমাধ্যমে কথা বলবে এমনকি বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ, বিশেষ করে সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করবেন—এটিও স্বাভাবিক। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সেটি রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা দেশবিরোধিতা।
প্রশ্ন হলো, সরকারবিরোধী কোনো দল বা সংগঠন যদি তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য মোবাইল ফোন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দলের নেতাকর্মী ও অন্যান্য পেশাজীবীদের সঙ্গে কথা বলে; কর্মসূচির বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেয়; কৌশল ঠিক করে—সেগুলোও কি দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হবে এবং আড়ি পাতার মাধ্যমে এই ধরনের ফোনালাপ রেকর্ড করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে?
ফোনে আড়িপাতার সঙ্গে আছে আরেকটি উৎপাত, তার নাম ফোনালাপ ফাঁস। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৩ সালের অক্টোবরে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার ফোনালাপ ফাঁসের মধ্য দিয়ে।
তবে ফোনে আড়িপাতা এবং ফোনকল ফাঁস করার এইসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ডকেও ছাড়িয়ে গেছে সম্প্রতি রাজধানীতে বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে নাগরিকের মোবাইল ফোন চেক করার বিষয়টি। এমন অদ্ভুত দৃশ্য, দৃশ্যত যা একধরনের 'ডিজিটাল প্রভুত্ব'—সেটি দেশে আগে দেখা যায়নি যে, পুলিশ কোনো নাগরিকের মোবাইল ফোনের এসএমএস এমনকি গ্যালারি পরীক্ষা করছে। শুধু পুলিশ নয়, কোথাও কোথাও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও নাগরিকদের মোবাইল ফোন চেক করেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। সুতরাং, রাষ্ট্র বুঝতে হলে এইসব ঘটনাবলি, বিশেষ করে ডিজিটাল প্রভুত্বের দিকে নজর রাখা দরকার। কারণ আপাতবিচ্ছিন্ন হলেও এর প্রত্যেকটির সঙ্গে প্রত্যেকটির নিবিড় সংযোগ রয়েছে।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments