মানুষ কেন হিরো আলমকে এমপি হিসেবে দেখতে চায়

দেশের মোট ৬ আসনে উপনির্বাচন হয়েছে গত ১ ফেব্রুয়ারি। এর মধ্যে বগুড়ার ২ আসনের উপনির্বাচন নিয়ে সারা দেশের মানুষের আগ্রহ ছিল। আগ্রহটা মূলত হিরো আলমকে নিয়ে।

দেশের মোট ৬ আসনে উপনির্বাচন হয়েছে গত ১ ফেব্রুয়ারি। এর মধ্যে বগুড়ার ২ আসনের উপনির্বাচন নিয়ে সারা দেশের মানুষের আগ্রহ ছিল। আগ্রহটা মূলত হিরো আলমকে নিয়ে।

নির্বাচনের দিন দুপুর থেকে বগুড়ায় আমরা যারা সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করেছি, তাদের কাছে অসংখ্য ফোন এসেছে। প্রশ্নই একটাই, হিরো আলম কি এমপি হচ্ছেন? ভোটের ফলাফল ঘোষণার পর দেখা গেল বগুড়া-৪ আসনে হিরো আলম সামান্য ব্যবধানে হেরে গেছেন।

হিরো আলমকে নিয়ে মানুষের কেন এই আগ্রহ? কেন এত মানুষ ভোট দিয়েছেন হিরো আলমকে? কেনই বা তারা হিরো আলমকে সংসদ সদস্য বানাতে চান? হিরো আলম কি সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য? এমন প্রশ্ন দেশের অনেক মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। তার আগে ভোটের পরিসংখ্যানটা দেখে নেওয়া যাক।

গত ১ ফেব্রুয়ারি বগুড়া-৪ (কাহালু ও নন্দীগ্রাম উপজেলা) এবং বগুড়া-৬ (বগুড়া সদর উপজেলা) ২ আসনেই হেরেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম। বগুড়া-৪ আসনে তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সমর্থিত জাসদ প্রার্থীর কাছে মাত্র ৮৩৪ ভোটে হেরেছেন। এই আসনে যিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছেন তিনি পেয়েছেন ২০ হাজার ৪০৫ ভোট আর হিরো আলম পেয়েছেন ১৯ হাজার ৫৭১ ভোট।

বগুড়া-৬ আসনে হিরো আলম পেয়েছেন ৫ হাজার ২৭৪ ভোট। সেখানে তিনি জামানত হারিয়েছেন।

অবশ্য গত ১ ফেব্রুয়ারি রাতেই হিরো আলম তার বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে ভোটের ফলাফল বর্জন করেছেন। তার দাবি, ষড়যন্ত্র করে তাকে হারানো হয়েছে। গণনার সময় ভোটের ফল পরিবর্তন করা হয়েছে। হিরো আলম নির্বাচনে জিতলে সরকারের মান-সম্মান যাবে। শিক্ষিত লোকেদের তাকে 'স্যার' বলতে হবে। এজন্যই তাকে হারানো হয়েছে বলে দাবি এই স্বতন্ত্র প্রার্থীর। এই বিষয়ে তিনি আদালতে যাবেন বলেও সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।

বগুড়া-৪ ও বগুড়া-৬ এ ভোট পড়েছে শতকরা ২৪ শতাংশের নিচে। অর্থাৎ ২ আসনেই প্রায় ৭৬ শতাংশ মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেননি। ২ আসন মিলে হিরো আলম একতারা প্রতীকে পেয়েছেন ২৫ হাজার ৩৬৯ ভোট। বগুড়া-৪ আসনে যত ভোট পড়েছে তার ২৬ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছেন হিরো আলম। বিজয়ী প্রার্থীসহ বাকি ৮ জন পেয়েছেন ৭৪ শতাংশ ভোট।

এখন যে প্রশ্ন নিয়ে সব চেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। প্রথম প্রশ্ন হলো—সত্যিই কি হিরো আলম সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য? যৌক্তিক উত্তর হচ্ছে—অবশ্যই হিরো আলম সংসদ সদস্য হিসেবে যোগ্য। সংবিধান বলছে, তিনি নির্বাচনে দাঁড়ানোর যোগ্য। আইনগতভাবে হিরো আলমের নির্বাচন করতে বাধা নেই। দেশের প্রচলিত আইন মেনেই নির্বাচন কমিশন তার প্রার্থিতা নিশ্চিত করেছেন।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতীয় সংসদের সদস্য পদ লাভের জন্য বাংলাদেশের নাগরিক হওয়াসহ বয়সসীমা অবশ্যই ২৫ বছরের ঊর্ধ্বে হতে হবে। এটিই মূল যোগ্যতা। সংসদ সদস্য হতে হলে বিশেষ কোনো জ্ঞান বা উচ্চশিক্ষিত হতে হবে, এমন শর্ত নেই। কাজেই বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে হিরো আলম যে এমপি হওয়ার যোগ্য।

হিরো আলমের কি যোগ্যতা আছে এমপি পদে নির্বাচন করার? এই প্রশ্ন সাংবাদিকরা তাকে বহুবার করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা হয়। এই প্রশ্নের জবাবও হিরো আলম দিয়েছেন।

তিনি সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, মমতাজ কণ্ঠশিল্পী থেকে এমপি হয়েছেন, মাশরাফি খেলোয়াড় থেকে এমপি হয়েছেন, আরও অনেকে অনেক পেশা থেকে এমপি হয়েছেন। তাদের কি যোগ্যতা আছে সংসদ সদস্য হওয়ার? যোগ্যতার প্রশ্ন কেন তাকেই বার বার করা হয়, অন্যদের করা হয় না কেন?

শ্রমজীবী শ্রেণির কেউ সংগ্রাম করে উপরে উঠে আসুক, সেটা সহ্য হয় না সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষের। সেই কারণের তার এত সমালোচনা করা হয় বলে অভিযোগ হিরো আলমের।

হিরো আলম প্রমিত বাংলায় কথা বলতে পারেন না। হিরো আলম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত নন। তিনি নিম্নমানের মিউজিক ভিডিও বানান, বিকৃত করে রবীন্দ্রসংগীত গান, ভাঁড়ামো করেন। তিনি কীভাবে সংসদে যাবেন—তাকে নিয়ে এমন হাজারো মন্তব্য করা হয়। কিন্তু তার বিরুদ্ধে চুরি, দুর্নীতি, কালোবাজারি, টেন্ডারবাজি, ঋণখেলাপি, ত্রাণের চাল চুরি, কম্বল চুরি, অর্থ আত্মসাৎ, টাকা পাচার, জমি দখল বা ভোট চুরির অভিযোগ নেই।

গত ১ ফেব্রুয়ারি ভোটের ফল ঘোষণার পর এক টেলিভিশনের টক-শোতে পুলিশের সাবেক আইজিপি শহিদুল হক হিরো আলমের সম্পর্কে কিছু বলতে চাননি। সঞ্চালক বার বার প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, হিরো আলমকে তিনি রাজনৈতিক কোনো ব্যক্তিত্ব মনে করেন না। তার কাছে হিরো আলম ফেসবুকের হিরো হলেও বাস্তবের হিরো নন।

এই হিরোইজমের একটা মানদণ্ড আমাদের সমাজ তৈরি করেছে। সেখানে কিন্তু সংসদ সদস্য হতে গেলে কী কী যোগ্যতা লাগে, সেটির উল্লেখ নেই। উল্লেখ থাকলে দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতি, অর্থপাচারের অভিযোগ থাকার পরও অনেকে এমপি-মন্ত্রী হচ্ছেন কীভাবে?

এবার আসি হিরো আলমকে এত মানুষ কেন ভোট দিলেন, সেই প্রশ্নে। উপনির্বাচনের একদিন আগে নন্দীগ্রাম ও কাহালু উপজেলার প্রায় ২৫০ জনের সঙ্গে কথা জানা গেছে, বেশিরভাগ মানুষ ভোট দিতে যাবেন না। কেন যাবেন না, তার উত্তরে যে কারণগুলো তারা জানিয়েছেন, তার মধ্যে প্রথমে আছে—এখন ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই, ভোটের ফলাফল ভোটারদের মতামতের ওপর নির্ভর করে না, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের যে ইতিহাস সেটা এখন আর নেই।

দ্বিতীয়ত, এই নির্বাচনে যেহেতু বিএনপি অংশ নিচ্ছে না তাই অনেকেই ভোট দিতে যাবেন না বলে জানান।

তৃতীয়ত, এর আগে এই আসনে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের যারা এমপি নির্বাচিত হয়েছেন, তারা মানুষের জন্য কাজ করেননি। ভোটারদের আশা-আকাঙ্ক্ষা নির্বাচিত ব্যক্তিরা পূরণ করতে পারেননি। মানুষের জন্য কাজ না করে নিজের স্বার্থে কাজ করেছেন। তারা দুর্নীতিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছেন। সাধারণ মানুষকে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুধু নিজেদের ধন-সম্পদ বাড়িয়েছেন। এ কারণে মানুষ বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রতি বিরক্ত ও বিতশ্রদ্ধ।

বগুড়া-৪ আসনের উপনির্বাচনে বড় রাজনৈতিক দলের প্রার্থীসহ মোট ৯ জন অংশগ্রহণ করছেন। তবে মানুষ কেন হিরো আলমকে ভোট দেবেন?—এই প্রশ্নের জবাবে ভোটাররা বলছেন, হিরো আলমকে কেউ ভোট দেবেন আবেগে, কেউ অভিমানে।

অভিমানটা হলো, বড় রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা জনগণের উন্নয়নে তেমন কাজ করেন না। কোনো সমস্যা নিয়ে তাদের কাছে সহজে যাওয়া যায় না। অনেক তরুণ ভোটার বলেছেন, হিরো আলম সহজসরল মানুষ। ভালো মানুষ। অন্য দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আছে, সেগুলো হিরো আলমের বিরুদ্ধে নেই। হিরো আলমের কাছে যে কেউ যেতে পারেন। কেউ বলেছেন, গতবারও হিরো আলম দাঁড়িয়েছিলেন, কিন্তু ভোট পাননি। তাই এবার অনেকে তাকে ভোট দেবেন।

হিরো আলম ভোট পাওয়ার পেছনের বড় কারণ হলো তার সরলতা। বড় দলের প্রার্থীরা ভোটের আগে যেসব বড় বড় স্বপ্ন দেখান, প্রতিশ্রুতি দিন, এমপি নির্বাচিত হলে তার একটিও করবেন না বলে মনে করেন ভোটাররা। অন্যদিকে হিরো আলম তার প্রচারণায় সহজসরল ভাষায় বলেছিলেন যে, এমপি হলে তিনি সময় পাবেন ৭ থেকে ৮ মাস। এত অল্প সময়ে তিনি জনগণের জন্য তেমন কিছু করতে পারবেন না। কিন্তু একটি কাজ তিনি করবেন, সেটা হলো এই এলাকায় জনগণের জন্য যেটা সবচেয়ে বেশি দরকার, জরুরি সেই কাজটি তিনি করবেন। হিরো আলমের এই সহজ স্বীকারোক্তি ভোটারদের ভালো লেগেছিল। মানুষ ভোট দেওয়ার জন্য বিকল্প খুঁজেছে। সেই বিকল্প হিসেবে তারা এবার হিরো আলমকে পেয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন ভোটাররা।

এখন আসল কথা হচ্ছে, গণতন্ত্র অর্থ যদি 'জনগণের শাসন' বোঝায়, তাহলে সেই জনগণই তো চাচ্ছে হিরো আলম সংসদ সদস্য হোক, সংসদে গিয়ে জনগণের স্বার্থে কথা বলুক, জনস্বার্থে আইন প্রণয়ন করুক। তাহলে হিরো আলমকে মেনে নিতে আমাদের সমস্যা কোথায়?

এই এলাকায় হিরো আলমই কি সংসদ সদস্য পদের জন্য সবচেয়ে যোগ্য লোক? না। কিন্তু কেন মানুষ হিরো আলমের প্রতি আস্থা রাখতে চাইছেন? কেন ভোট দেওয়ার জন্য আরও যোগ্য মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না? কেনই বা ভালো মানুষ রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন? বড় বড় রাজনৈতিক দল থেকে মানুষ কেন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন? কেন মাত্র ২৪ শতাংশ মানুষ ভোট দিচ্ছেন? কেন বড় রাজনৈতিক দলগুলো দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে? কেন রাজনীতিক কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ আর অংশ নিতে চাচ্ছে না? কেন ভোটের মতো গুরুত্বপূর্ণ অধিকারের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে তলানিতে ঠেকেছে? জনপ্রিয় দলগুলোকেই এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে।

১০০ ভোটারের মধ্যে ২৩-২৪ জন ভোট দিলে সেটাকে 'জনগণের শাসন' বা গণতন্ত্র বলা যায় কি? যায় না। গণতন্ত্রের এই যে পচন, সেখান থেকে রক্ষা পেতে জনগণ হিরো আলমের মতো মানুষের ওপর ভরসা রাখতে চাচ্ছে—যে হিরো আলম এর আগে বগুড়া-৪ আসনে মাত্র ৬৩৮ ভোট পেয়েছিলেন।

মোস্তফা সবুজ: নিজস্ব সংবাদদাতা, বগুড়া, দ্য ডেইলি স্টার

Comments