বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে কি দুর্নীতি মেনে নিতে হবে?
দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)-এর দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ আরও এক ধাপ পিছিয়েছে। বৈশ্বিক গড় স্কোরের তুলনায় এবারও বাংলাদেশের স্কোর অনেক কম এবং গত এক দশকের মতো দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ দ্বিতীয়। বাংলাদেশের আগে আছে কেবল তালেবানশাসিত আফগানিস্তান। যদিও গত বছরের তুলনায় দেশটিতে দুর্নীতি কমেছে বলে টিআইয়ের গবেষণায় উঠে এসেছে।
গত ৩১ জানুয়ারি টিআইয়ের বাংলাদেশ শাখা অর্থাৎ টিআইবি বৈশ্বিক দুর্নীতির যে গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে বিশ্বের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম, যেখানে গত বছর ছিল ত্রয়োদশ। এবার এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে চতুর্থ। সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার শীর্ষে আছে ডেনমার্ক। দ্বিতীয় ফিনল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড এবং তৃতীয় স্থানে আছে নরওয়ে। বৈশ্বিক সূচকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ সোমালিয়া, দ্বিতীয় শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ যৌথভাবে দক্ষিণ সুদান ও সিরিয়া এবং তৃতীয় লাতিন আমেরিকার দেশ ভেনেজুয়েলা।
যদিও বাংলাদেশে দুর্নীতির চিত্র কেমন—সেটি বোঝার জন্য টিআইয়ের সূচকের দিকে তাকানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কারণ দেশের প্রতিটি খাতে, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালে এবং দুর্নীতি নিয়ে সাধারণ মানুষ এমনকি রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও যে ধারণা পোষণ করেন; যে ধরনের কথাবার্তা বলেন—সেদিকে খেয়াল করলেই বোঝা যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গত দুই দশকে 'অ্যাডাপটেশন' বা 'অভিযোজন' শব্দটি বেশ আলোচিত। অর্থাৎ মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে ভোগবাদের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বেড়ে যাওয়ায় প্রকৃতি যে অস্বভাবিক আচরণ করছে; প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে এবং তার ফলে বাংলাদেশের মতো সমুদ্র উপকূলীয় এবং দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলো যে ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন—সেই পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে লবণ ও খরাসহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবন; নতুন নকশার ঘরবাড়ি তৈরি; উপকূলীয় এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সাইক্লোন শেল্টার হিসেবে ব্যবহার করার উপযোগী করে নির্মাণ; প্রয়োজনীয় স্থানে টেকসই বেড়ি বাঁধ নির্মাণ; ম্যানগ্রোভ বন সৃষ্টিসহ নানাবিধ উদ্যোগ চোখে পড়ে। এগুলোকে এক কথায় বলা হচ্ছে অভিযোজন। অর্থাৎ যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনকে ঠেকানো যাচ্ছে না, অতএব তার সঙ্গে টিকে থাকার কৌশল।
এখন দুর্নীতির প্রসঙ্গেও এই অভিযোজন বা খাপ খাইয়ে নেওয়ার কথা আলোচিত হচ্ছে। সম্প্রতি একজন সিনিয়র সাংবাদিকের একটি বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে যেখানে তিনিও বলেছেন, 'যেহেতু দুর্নীতি বন্ধ করা যাচ্ছে না, ফলে এটাকে ওয়ে অব লাইফ (জীবন চলার পাথেয়) এবং লিগ্যালাইজ (আইনসিদ্ধ) করে দেওয়া উচিত।' তিনি কয়েকটি বাস্তব ঘটনার উদাহরণ টেনে অনেকটা হতাশার সুরে কথাগুলো বলেছেন। কিন্তু এই ধরনের কথা যে সমাজে অপরাধ ও দুর্নীতি আরও উসকে দেয়; অপরাধীদের মনে সাহস সঞ্চার করে; চোরের মায়ের গলা আরও উঁচু করতে সহায়তা করে—সেটিও বিবেচনায় রাখা দরকার। কারণ এই ধরনের কথার অর্থ দাঁড়ায়, যেহেতু চুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না, চলুন সবাই চুরি করি। যেহেতু ঘুষ বন্ধ করা যাচ্ছে না, চলুন আমরাও ঘুষ খাই।
স্মরণ করা যেতে পারে, সাবেক এক অর্থমন্ত্রী ঘুষকে বলেছিলেন 'স্পিড মানি'। যে দেশের নীতিনির্ধারক ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা দুর্নীতি দমনের সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা না নিয়ে পরোক্ষভাবে দুর্নীতির পক্ষে কথা বলেন, সেই দেশে দুর্নীতি কমানো শুধু কঠিন নয়, অসম্ভব ব্যাপার।
হতাশা থেকে অনেক কথাই বলা যায়। কিন্তু যেসব কারণে ওই হতাশা তৈরি হয়েছে, সেগুলো দূর করতে উদ্যোগী হওয়া এবং সরকারকে উদ্যোগ নিতে বাধ্য করাই দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাজ। অথচ সেটি না করে পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া অর্থাৎ দুর্নীতিকে মেনে নিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রকে আরও বেশি দুর্নীতির দিকে ঠেলে দেওয়া কোনোভাবেই দায়িত্বশীল আচরণ হতে পারে না।
টিআইয়ের দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হলো, নাকি অবস্থান ১২ কিংবা ১৩—সেটিও খুব বড় বিষয় নয়। বরং সাধারণ মানুষ কীভাবে দুর্নীতির ভিকটিম হচ্ছে এবং সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনবান্ধব ও দুর্নীতিমুক্ত করতে রাষ্ট্র কী করছে, সেটিই মূল বিবেচ্য।
সরকারের তরফে বরাবরই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহনশীল নীতির কথা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কোথাও যে দুর্নীতি কমেছে বা বন্ধ হয়েছে, সেটি দৃশ্যমান নয়। কোনো একটি প্রতিষ্ঠানকে পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত করা গেছে, এমন কথা সরকারও সম্ভবত জোর গলায় বলতে পারবে না। এক্ষেত্রে এই প্রশ্নটি খুব সঙ্গত যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে শক্ত অবস্থান ঘোষণার পরেও কেন দুর্নীতি থামানো যাচ্ছে না? জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহনশীল নীতি কি শুধুই মুখের কথা?
একটা সময় পর্যন্ত সবার ধারণা ছিল, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কম বলে তারা ঘুষ খান। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তাদের বেতন ও আর্থিক সুবিধা অনেক বেড়েছে। তারপরও সরকারি অফিসগুলোর নিম্ন পর্যায়ে দুর্নীতির প্রবণতা বেশি। কারণ এখানে বেতন ও আর্থিক বৈষম্য প্রকট। যে হারে উপরের পদগুলোতে বেতন-বোনাস ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা বেড়েছে, সেই তুলনায় নিচের পদগুলোয় বাড়েনি। একজন উপসচিবও মাসে তার গাড়ির জন্য যে তেল খরচ পান, সেটি তার নিচের পদে একজন কর্মীর পুরো মাসের বেতনের চেয়ে বেশি। তার ওপর প্রতিনিয়তই জীবন-যাপনের খরচ বাড়ছে। সব মিলিয়ে নিচু পদের কর্মীরাও পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে (অভিযোজন) বাড়তি আয়ের জন্য দুর্নীতিকে জায়েজ করার চেষ্টা করেন।
সরকার অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের সেবা ডিজিটালাইজড করলেও ডিজিটাল মাধ্যমে নাগরিকরা সেবা পায় না। কারণ অধিকাংশ সময়ই দেখা যায় 'সার্ভার ডাউন'। অথবা অনলাইনে আবেদন করেও সেবা পাওয়া যায় না। সেবাগ্রহীতাকে ঠিকই ওই অফিসে যেতে হয়। আর অফিসে গেলেই কাজটি করে দেওয়ার বিনিময়ে তাকে বাড়তি পয়সা দিতে হয়। এটা কখনো খুশি করার নামে, কখনো কাজটি দ্রুত করার জন্য (স্পিড মানি)। কিন্তু সেবাটি তিনি অনলাইনে পেয়ে গেলে ওই বাড়তি আয়ের পথটি বন্ধ হয়ে যাবে। যে কারণে সচেতনভাবেই সার্ভার ডাউন করে রাখা হয় বা অনলাইন সেবার প্রক্রিয়াটি নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়।
তাহলে সমাধান কী?
সমাধান হলো শুদ্ধাচার চর্চার পাশাপাশি উঁচু পদগুলোর সঙ্গে নিচু পদগুলোয় বেতন ও আর্থিক সুবিধার সমন্বয় করা। উপরের পদগুলোয় যে হারে এবং যে পরিমাণে বেতন ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা বাড়ানো হয়েছে, সেটি কতটা যৌক্তিক, তাও বিবেচনা করা দরকার। বেতনের বাইরে বিভিন্ন খাতে তারা যেসব আর্থিক সুবিধা পান, সেগুলো পুনর্বিবেচনা করা দরকার। সমন্বয় মানে বেতন বাড়ানো নয় বরং সাম্য নিশ্চিত করা। এটি নিশ্চিত করা না গেলে সরকারি সেবা যতই ডিজিটাল হোক, নাগরিকরা সুফল পাবে না। বরং কোনো না কোনো অজুহাতে তাদেরকে সশরীরেই অফিসে যেতে হবে এবং কাজটি করার জন্য তাকে বাড়তি পয়সা (ঘুষ) দিতে হবে—যা রাষ্ট্রকে দুর্নীতিমুক্ত করার পথে অন্যতম প্রধান অন্তরায়।
বেতন-ভাতা সমন্বয়ের পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহনশীল নীতির বাস্তবায়নের রাজনৈতিক সদিচ্ছাও থাকতে হবে। সব সময় যে কম বেতনের কর্মীরাই ঘুষ খান তা নয়, বরং সরকারের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের অনেক পদ 'লোভনীয়' হিসেবে বিবেচিত এবং ওইসব পদে মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে বদলি হতে হয়। সুতরাং যিনি মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে কোনো বিশেষ পদে বদলি হয়ে যান, ওই টাকা তাকে জনগণের ঘাড়ে পা রেখেই তুলতে হয়।
এইসব কথিত লোভনীয় ও আকর্ষণীয় পদসমূহকে অনাকর্ষণীয় করতে হবে। সেজন্য ওইসব চেয়ারে যারা বসেন, তাদের উপর সবচেয়ে বেশি নজরদারি করা দরকার। পরপর কয়েকজনকে পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে এবং বড় ধরনের শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে বাকিদের মনে ভয় ঢুকে যাবে। ওইসব পদের যে কাজ, সেগুলোকে পুরোপুরি অনলাইননির্ভর এবং বিকেন্দ্রীকরণ করে দিতে হবে। অর্থাৎ ওই সেবাটি প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে—যাতে কেউ আর ওই পদকে 'লোভনীয় পোস্টিং' ভাবতে না পারেন।
ছোট পদের লোকেরা ছোট অংকের ঘুষ খান। ছোট অংকের দুর্নীতি করেন। কিন্তু বড় পদে থাকলে তাদের সামনে বড় অংকের ঘুষ খাওয়া এবং বড় অংকের দুর্নীতির সুযোগ থাকে। ফলে বেতন ও আর্থিক সুবিধা বেশি থাকার পরেও যারা ঘুষ খান; তাদের চিহ্নিত করা গোয়েন্দা বাহিনীর জন্য খুব কঠিন কাজ নয়। তাদেরকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা গেলে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার কাজ সহজ হবে। সেজন্য যারা তদন্ত করবেন, তাদের দুর্নীতিমুক্ত থাকা জরুরি। এর চেয়েও বেশি জরুরি সরকারের সদিচ্ছা। অর্থাৎ দেশ দুর্নীতিমুক্ত হোক—এটি সরকার চায় কি না। নাকি সরকার যেহেতু গণকর্মচারীদের দিয়ে 'রাজনৈতিক কাজ' করায়, ফলে তাদের অন্যায়গুলোর ব্যাপারে চুপ থাকে। নাকি চোরকে চুরি করতে বলে গৃহস্তকে সজাগ থাকতে বলার নীতি অবলম্বন করে—সেটিও ভাবা দরকার।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments