‘জনগণের কল্যাণে যে কাজ করার সেটাই করব’
অনেক বিষয়েই আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একমত নই। তবে, যখন সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বার্থ ও মর্যাদার বিষয় আসে, তখন আন্তরিকভাবে তাকে সমর্থন জানাই। তিনি যখন বলেন, বাঙালিদের পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে হাঁটতে হবে, তখন সেটা আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয়। সম্প্রতি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আপনাদের একটি জিনিস মাথায় রাখতে হবে যে শেখ হাসিনাকে চাপ দিতে পারে, এমন কোনো চাপ নেই।' তিনি আরও বলেন, 'জনগণের কল্যাণে যে কাজ করার সেটাই করব।' উভয় ক্ষেত্রেই আমরা তাকে সমর্থন করি।
তবে, যে প্রশ্নের সঙ্গে অনেক কিছু জড়িয়ে আছে, সেটা হলো, 'জনগণের কল্যাণে যেটা করা দরকার'—সেটা প্রকৃতপক্ষে কে নির্ধারণ করবে? প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন যে কেবল আওয়ামী লীগই এটা নিশ্চিত করতে পারবে। বিএনপির ভাষ্য, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারলেই জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত হবে।
জনগণের কল্যাণের সিদ্ধান্তের সঙ্গে তো জনগণকে সম্পৃক্ত রাখতে হবে। আর জনগণকে সম্পৃক্ত করার উপায় হচ্ছে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়েই জনমতের প্রতিফলন ঘটে।
শুধু আমাদের বিদেশি বন্ধুরা চায় বলেই আমরা কোনো কিছু করব না। করতে হবে নিজেদের তাগিদ থেকে। তাগিদ আসতে হবে এর মূল্যটা জেনে। ভোটাধিকারের জন্য আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল। পাকিস্তানিরা ১৯৭০ সাল পর্যন্ত আমাদেরকে ভোটাধিকার দিতে চায়নি। আমরা এর জন্য যুদ্ধ করেছি এবং এর অভাবে ভয়াবহ দুর্ভোগের শিকার হয়েছি।
জাতীয়তাবাদী গৌরব আমাদের ইতিবাচক অনুপ্রেরণার উৎস। আবার একইসঙ্গে তা আমাদেরকে সংকীর্ণমনা করে তুলতে পারে এবং গুরুত্বপূর্ণ বার্তা ধর্তব্যে না নেওয়ার মানসিকতাও তৈরি করে দিতে পারে। অভ্যন্তরীণ কিংবা বাহ্যিক যেকোনো উৎস থেকেই এই ধরনের বার্তা আসতে পারে। যা অবদান রাখতে পারে জনগণের কল্যাণে।
এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ রানা প্লাজার মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর আমাদের তৈরি পোশাক খাতের রূপান্তর। বিদেশি ক্রেতারা অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স নামে ২টি সংগঠন তৈরি করে এবং আক্ষরিক অর্থে আমাদের ওপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার চাপিয়ে দেয়। এসব সংস্কারের ফলে এই খাতটি উপকৃত হয়েছে, উজ্জ্বল হয়েছে আমাদের ভাবমূর্তি। ১ হাজার ১০০ জনেরও বেশি পোশাকশ্রমিক নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা যে চরম বৈশ্বিক ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছিলাম, সংস্কারের ফলে তা অনেকটাই ফিরে এসেছে। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি স্বীকৃত 'সবুজ' কারখানা বাংলাদেশে।
বাংলাদেশকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার সময় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) যে শর্তগুলো দিয়েছে, সেগুলোকে স্বাগত জানাই; যদিও আমরা আইএমএফের ভক্ত না। আমরা আশা করি, অবশেষে আমাদের আর্থিকখাতে, বিশেষ করে ব্যাংকিংখাতে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার দেখতে পাব, যে সংস্কার সম্ভব হয়নি গণমাধ্যমের শত শত প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় ও কলাম লিখেও। একই ধারা দেখা গেছে র্যাব ও পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু, ক্রসফায়ারে মৃত্যু ও গুমের ক্ষেত্রেও। হঠাৎ করেই যেন সব উধাও হয়ে গেল। এ ক্ষেত্রেও অভ্যন্তরীণ জবাবদিহির চেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে বাহ্যিক চাপ।
বর্তমান বিশ্বে আমরা সবাই পারস্পরিক নির্ভরতার জালে আবদ্ধ। এর মধ্যে কিছু বিষয় দৃশ্যমান হলেও বেশিরভাগই অদৃশ্য। ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি আরও ভালো করে বুঝতে উদাহরণ হিসেবে দেখতে পারেন ঢাকা বিমানবন্দরে ফ্লাইট পরিচালনাকারী সংস্থাগুলোর কার্যক্রমকে। একটি ফ্লাইট পরিচালনার করতে যে পরিমাণ চুক্তি সই, প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র জোগাড়, নীতিমালা ও বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়; সেখান থেকেই পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে পরিচালিত বর্তমান বিশ্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আমাদের জীবনের প্রতিটি বিষয়, এমনকি প্রত্যন্ত কোনো গ্রামের নির্ঝঞ্ঝাট এক বাসিন্দার ভাগ্যও নির্ধারণ হয় আমাদের দেশসহ বিশ্বের সব দেশে হওয়া বৈশ্বিক চুক্তি ও আইনি অবকাঠামো গঠন এবং এর সুচারু বাস্তবায়নের মাধ্যমে।
সমন্বিত বিশ্বের আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে, আমাদের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতা। কে আমাদেরকে 'স্বল্পোন্নত দেশ' হিসেবে অভিহিত করেছে? আমাদের জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে এসব উপাধি কি বর্জন করা উচিত ছিল না? আমাদের কি বলা উচিত ছিল না, 'আমাদেরকে "স্বল্পোন্নত দেশ" আখ্যা দেওয়ার অধিকার আপনাদের কে দিয়েছে?' কেন আমরা কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার সম্মতির অপেক্ষায় না থেকে এখনই নিজেদেরকে 'উন্নত' দেশ হিসেবে ঘোষণা দিচ্ছি না? আমরা যে কেবল প্রচলিত প্রক্রিয়ায় সম্মতি দিয়েছি তাই নয়, বরং স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যেসব সুবিধা পেতাম, সেগুলো আরও ২ বছর পাওয়ার জন্য অনুরোধও জানিয়েছে, যেন উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে পারি। এর অর্থ এই নয় যে আমরা বাহ্যিক চাপে নতি স্বীকার করছি। বরং, আমরা একটি বৈশ্বিক গ্রামে সবার সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করছি, যেন নিজেদের জন্য সবচেয়ে বেশি সুবিধা আদায় করে নেওয়া যায়।
ব্যবসা ও বাণিজ্যের মতো গণতন্ত্র, মানবাধিকার, স্বাধীনতা, সুশাসন, বিশেষত গণতান্ত্রিক নির্বাচন বিষয়ে জাতিসংঘের অসংখ্য আইন ও বৈশ্বিক চর্চা রয়েছে, যেখানে আমরা সম্মতি দিয়েছি। এসব চর্চা মেনে চললে জাতীয় নির্বাচন বৈশ্বিক স্বীকৃতি পায়, যা প্রকারান্তরে বিশ্ব মঞ্চে দেশের সরকারকে সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা এনে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর সবচেয়ে বড় সূচক হলো প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং এ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য বার্তাটি হওয়া উচিত সুস্পষ্ট। ইকনোমিস্ট ম্যাগাজিনে আমাদেরকে 'উন্নয়নের সুপার স্টার' হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও এফডিআই এসেছে খুবই কম। এমনকি অসংখ্য রোড শো, সফর ও কনফারেন্সও এখন পর্যন্ত কাজে আসেনি।
উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রেকর্ড অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। কিন্তু গত ২টি জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে যে প্রশ্ন ও সমালোচনা রয়েছে, তা তার পর্যালোচনা করে দেখার সুযোগ আছে।
নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন শুধু বিএনপির অপপ্রচার নয়, কিংবা তিনি প্রায়শই যাদের কথা বলেন সেই 'সরকারের কৃতিত্বকে ছোট করে দেখাতে চাওয়া ষড়যন্ত্রকারীদের' কাজও নয়।
গত ২ নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা যতই থাকুক না কেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেগুলো সহ্য করতে পেরেছেন এবং বড় কোনো প্রতিকূলতা ছাড়াই ক্ষমতায় থাকতে পেরেছেন। এর ফলে তিনি নির্বাচন তার মতো করে করার দক্ষতা অর্জন করেছেন, ক্ষমতা ধরে রাখার বিষয়ে আরও সাহসী হয়েছেন। অবস্থাদৃষ্টে এসব নির্বাচন সমালোচিত হলেও তার কিছু আসে যায় না। তারচেয়েও ক্ষতিকর হচ্ছে, তার সুসময়ের সেই সমর্থকরা দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ করে যাচ্ছেন, দুর্নীতি যাদের মজ্জাগত বিষয়। তাদের বিশ্বাস, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় টিকে থাকার উপায় খুঁজে বের করবেন এবং এর ফলে তারা জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থাকবেন।
সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে এই গোষ্ঠীই অন্যদের তুলনায় বেশি বিরোধিতা করে। কারণ, তাদের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে 'ম্যানেজ' করা নির্বাচনের ওপর। সবাই নয়, তবে এই গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছেন অনেক রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী নেতা, জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম পর্যায়ের আমলা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, গোয়েন্দা সংস্থা ও অন্যান্য ক্ষমতাবান ব্যক্তি, এমনকি আমার পেশার মানুষও।
সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিরোধিতাকারী এই গোষ্ঠীটি একটি নেক্সাস তৈরি করে রেখেছে এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের সব উদ্যোগ বানচালে যা করা দরকার, তার সবই তারা করে। প্রধানমন্ত্রী কোনো বিষয়ে নমনীয় হওয়ার চেষ্টা করলে সেই উদ্যোগেও তারা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। (গুজব রয়েছে, গত নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী কিছু আসন বিরোধী দলকে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিকল্পনাটি তারা বানচাল করে দেয়।)
'জনগণের কল্যাণের জন্য যা দরকার করব'—শেখ হাসিনার এই বক্তব্যে ফিরে প্রশ্ন করা যায়: কোনটি 'জনগণের কল্যাণ' নিশ্চিত করতে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, একটি বিতর্কিত নির্বাচন, নাকি একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন? প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর রয়েছে—সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ যেকোনো কিছু এর বিপরীত পরিস্থিতির চেয়ে ভালো। কাজেই কোনো শক্তিকে সন্তুষ্ট করতে নয়, বরং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী 'জনগণের কল্যাণের জন্য'ই সেটা আমাদের বেছে নেওয়া দরকার।
পুনশ্চ:
গত ২ দিনের ঘটনায় আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। আইনজীবীদের অংশগ্রহণে সর্বোচ্চ আদালত চত্বরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন যদি সুষ্ঠুভাবে আয়োজন না করা যায়, তাহলে জাতীয় নির্বাচনে কী হবে? সেখানে আমরা কী প্রত্যাশা করব? জাতীয় নির্বাচনে আমাদের চাওয়া-পাওয়া আরও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং ভোটারদের মধ্যে দলীয় সমর্থক যেমন আছেন, তেমনি আছেন নিরপেক্ষ ব্যক্তিও। আমাদের সর্বোচ্চ আদালতে আইন ব্যবসা করেন যে আইনজীবীরা, তারাই নিজেদের মতপার্থক্য নিরসনের জন্য আলোচনার পথে হাঁটেননি। বরং, তারা সহিংস বিক্ষোভ করেছেন এবং সেখানে পেশাগত দায়িত্বপালনকারী সাংবাদিকরাও আহত হয়েছেন।
মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments