মাহির গ্রেপ্তার ও জামিন নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন
বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা পুলিশের মামলায় গ্রেপ্তার, আদালতে প্রেরণ, আদালতে জামিন নামঞ্জুর, কারাগারে প্রেরণ, ফের জামিন আবেদন এবং জামিন মঞ্জুর, অতঃপর কারামুক্তি। এই সবগুলো ঘটনা ঘটেছে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে।
এই দৃশ্য দেখে মনে হতে পারে, দেশের বিচার ব্যবস্থা বোধ হয় খুব 'ফাস্ট' হয়ে গেছে। আসলে কি তা-ই? সেটি অন্য প্রসঙ্গ। মূল ঘটনায় নজর দেওয়া যাক।
১৮ মার্চ, শনিবার, দুপুর ১২টা ৪ মিনিটে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের খবর, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করেছে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ। পৌনে ১২টার দিকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার মানে, ঘটনার ২০ মিনিটের মধ্যে খবরটি প্রকাশ করে ডেইলি স্টার।
এর ২ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে দুপুর ১টা ৫৩ মিনিটে ডেইলি স্টারের আরেকটি খবরের শিরোনাম, মাহিয়া মাহিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ। আদালতে মাহির ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করা হয়েছিল। আদালত রিমান্ড মঞ্জুর না করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এর ৪ ঘণ্টা পরে সন্ধ্যা ৬টা ১৩ মিনিটে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পুলিশের মামলাসহ ব্যবসায়ীর মামলায় জামিন পেয়েছেন চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি। এরপর রাত ৮টা ১১ মিনিটে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম, কারামুক্ত মাহিয়া মাহি। এতে বলা হয়, শনিবার সন্ধ্যা ৭টা ৫০ মিনিটে গাজীপুর জেলা কারাগারের মূল ফটকে পৌঁছান মাহিয়া মাহি। জেল সুপার আনোয়ারুল করিম জানান, রাত পৌনে ৮টার দিকে আদালতের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে তাকে কারামুক্ত করা হয়। প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, কারামুক্ত হওয়ার পরে মাহির ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা ফুল ছিটিয়ে তাকে বরণ করছেন।
পবিত্র মক্কা শরিফ থেকে ওমরাহ করে বিমানবন্দরে অবতরণের পরপরই মাহির এই গ্রেপ্তার। প্রথমে জামিন নামঞ্জুর এবং পরে একই আদালতে জামিন মঞ্জুর ও কারামুক্তির বিষয়গুলো নিয়ে নানা প্রশ্ন সামনে আসছে।
১. মাহির বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, তিনি ফেসবুক লাইভে পুলিশের একজন সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ এনেছেন। এতে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এ কারণে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো নাগরিক কি কোনো অভিযোগ করতে পারবেন না? অভিযোগ করলেই তার বিরুদ্ধে মামলা হবে এবং মামলার পরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে?
২. রাষ্ট্রের কাছে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ, পুলিশের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলে ওই নাগরিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, নাকি অভিযোগের তদন্ত করা?
৩. মাহি একজন অন্তঃসত্ত্বা নারী হওয়া সত্ত্বেও আদালত তাকে কেন জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিলেন?
৪. কারাগারে পাঠানোর ৪ ঘণ্টার মধ্যে কী এমন ঘটনা ঘটলো যে একই আদালত মাহিকে জামিন দিলেন?
পুলিশের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, গাজীপুরের ভাওয়াল কলেজ এলাকায় মাহি ও তার স্বামীর একটি গাড়ির শোরুম আছে। শোরুমের জায়গা নিয়ে ঝামেলা আছে। ওই শোরুমে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছেন। আর এতে গাজীপুর পুলিশ প্রশাসন সহায়তা করছে।
একটি ফেসবুক লাইভে মাহি এই ঘটনার উল্লেখ করে গাজীপুর মহানগর পুলিশের একজন সিনিয়র কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ারও অভিযোগ করেন। এ কারণে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগে গাজীপুর মেট্রোপলিটনের বাসন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ রোকন মিয়া বাদী হয়ে ১৭ মার্চ রাত ৯টার দিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মাহি ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করেন।
একই দিনে কোটি টাকা মূল্যের জমি জোর করে দখলের অভিযোগে মাহি ও তার স্বামীকে আসামি করে বাসন থানায় আরেকটি মামলা করেন স্থানীয় ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন।
প্রসঙ্গত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মাহির একটি ফেসবুক লাইভের অংশ বিশেষে দেখা যাচ্ছে, তিনি গাড়ির শোরুম নিয়ে ঝামেলার বিষয়ে গণমাধ্যমের অপরাধ-বিষয়ক সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। এমনকি, তিনি দেশে ফেরার পরে গ্রেপ্তার হতে পারেন বলেও আশঙ্কার কথা জানান।
অবশেষে ১৮ মার্চ দুপুরের দিকে মাহিকে বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে গাজীপুর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইকবাল হোসেনের আদালতে নেওয়া হয়। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার ৭ দিনের রিমান্ড চাইলেও আদালত রিমান্ড নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে পরিবারের সদস্যরা মাহির জন্য আইনজীবী নিয়োগ করেন। বিকাল ৫টার দিকে একই আদালতে মাহির জামিন চেয়ে আবেদন করেন আইনজীবীরা। সেই আবেদন বিবেচনা করে তাকে ২ মামলাতেই জামিন দেন আদালত।
মাহির আইনজীবী আনোয়ার সাদাত সরকার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মাহি অন্তঃসত্ত্বা। তাছাড়া, মামলা যখন হয়েছে তখন তিনি দেশের বাইরে ছিলেন। আবেদনে আমরা এগুলো তুলে ধরেছি। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেছেন।'
কিন্তু, এর আগে যখন মাহির জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিলেন, তখন আদালত থেকে বেরিয়ে মাহি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, 'জাজ আমার সঙ্গে কোনো কথা বলে নাই। জাজ একটা কথাও বলে নাই। জাজ জাস্ট চেয়ারে বসেছেন, আর উঠেছেন। ১ সেকেন্ডের মধ্যে কোর্ট কীভাবে শেষ হয়ে যায়? কোর্ট আমার সঙ্গে কোনো কথাই বলে নাই।'
আসলে কি তা-ই? গাজীপুরের একটি জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক, যিনি মাহিকে আদালতে নেওয়ার সময়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তার কাছে বিষয়টা জানতে চাই। তিনি বলেন, বিচারক সত্যিই কোনো ধরনের শুনানি ছাড়াই মাহিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। প্রশ্ন হলো, এই একই আদালত ৪ ঘণ্টা পরে কেন তাকে জামিন দিলেন? আদালত কেন একজন নারীর শারীরিক অবস্থা না জেনে, কোনো ধরনের শুনানি ছাড়াই কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিলেন? একজন আসামি, তার সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান যা-ই হোক না কেন, শুনানি ছাড়া তার জামিন মঞ্জুর, নামঞ্জুর কিংবা রিমান্ড দেওয়া না দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়? যদি কোনো আসামির পক্ষে আইনজীবী নাও থাকেন, তারপরও বিচারক সরাসরি আসামির সঙ্গে কথা বলতে পারেন। আইন তাকে সেই ক্ষমতা ও এখতিয়ার দিয়েছে। তার ওপর আসামি যখন একজন নারী এবং সেলিব্রিটি।
কারাগার থেকে বের হওয়ার পরে মাহি অভিযোগ করেছেন, বিমানবন্দর থেকে আদালতে নেওয়ার পরে পুলিশ তার সঙ্গে মানবিক আচরণ করেনি। তিনি বলছিলেন যে তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কিন্তু পুলিশ বলেছে, এভাবেই যেতে হবে। তিনি পানি চেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে পানি দেওয়া হয়েছে এক ঘণ্টা পরে। এই অভিযোগগুলোরও তদন্ত হওয়া দরকার। একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর সঙ্গে পুলিশ যদি সত্যিই এই ধরনের আচরণ করে থাকে, সের বিষয়ে তাদের জবাবদিহি করা উচিত।
প্রশ্ন হলো, কোনো এক বা একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা কিংবা পুরো পুলিশ বাহিনী সম্পর্কেও যদি রাষ্ট্রের একজন নাগরিক, তার পরিচয় যা-ই হোক না কেন, তিনি যদি কোনো অভিযোগ করেন; তিনি যদি পুলিশের কোনো কাজে সংক্ষুব্ধ হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু লেখেন বা বলেন, তাহলে কি ওই নাগরিকের বিরুদ্ধে পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেবে? এই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহিনী যদি নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন করে, তা ওই বাহিনী সম্পর্কে জনমনে কী বার্তা দেবে? এখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব কী?
যদিও মাহি দাবি করেছেন, তিনি পুলিশ বাহিনীর সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি। বরং সুনির্দিষ্টভাবে একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। পক্ষান্তরে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোল্লা নজরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন, মাহিয়া মাহির স্বামী রকিব সরকারের বিরুদ্ধে এর আগে অস্ত্র, হত্যা ও ধর্ষণের ৩টি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া, তার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অভিযোগ আসছে। মাহি বা তার স্বামী জমিসংক্রান্ত কোনো বিষয় নিয়ে তার কাছে আসেননি বলেও দাবি করেন মোল্লা নজরুল ইসলাম।
সুতরাং বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখলে এই প্রশ্নও তোলা দরকার, মাহিয়া মাহি একজন চিত্রনায়িকা বলে, তার অনেক জনপ্রিয়তা আছে বলে, তিনি সামাজিকভাবে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে পুলিশ কি তাকে গ্রেপ্তার করতে পারবে না বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না? বরং পুলিশের তরফে তার স্বামীর ব্যাপারে যেসব তথ্য দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোরও সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। স্বামীর অপরাধ আড়াল করতে মাহি তার সামাজিক সুখ্যাতির অপব্যবহার করছেন কি না, সেটিরও অনুসন্ধান প্রয়োজন। ব্যক্তি জীবনে যার পরিচয় যা-ই হোক না কেন, সংবিধান বলছে, আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিক সমান। সুতরাং যে আইনে একজন চা বিক্রেতার বিরুদ্ধে মামলা করা যায়, সেই আইনে দায়ের করা মামলায় একজন মন্ত্রীকেও গ্রেপ্তার করা যায়। আইনের শাসনের মূল স্পিরিট এটাই।
অতএব মাহিয়া মাহি যেমন আইনের ঊর্ধ্বে নন, তেমনি পুলিশ বাহিনীও আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং ক্ষমতা আছে বলেই একটি ফেসবুক লাইভে মাহির একটি বক্তব্যের রেশ ধরে পুলিশ একটি বিতর্কিত আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা করবে এবং তিনি ওমরাহ করে দেশে নামার পরপরই বিমানবন্দরেই তাকে গ্রেপ্তার করা হবে; কোনো ধরনের শুনানি না করেই, তার শারীরিক অবস্থা না জেনেই কিংবা আমলে না নিয়েই, তিনি যে একজন অন্তঃসত্ত্বা নারী, সেই তথ্যটুকুও জানার প্রয়োজন বোধ না করেই তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হবে; পানি চাইলে সেটি এক ঘণ্টা পরে দেওয়া হবে—সেটিও কাঙ্ক্ষিত নয়। বরং এই সবকিছুই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সংবিধান যে নাগরিককে বলছে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক, সেই নাগরিকের সঙ্গে সম্মানজনক আচরণের পরিপন্থী।
আমীন আল রশীদ, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments