তামাক কর কাঠামো সংস্কারে রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে

তামাক জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় নয়। বরং এর ব্যাপক ব্যবহার জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতি—উভয়ের জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর।

তামাক জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় নয়। বরং এর ব্যাপক ব্যবহার জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতি—উভয়ের জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর। বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করতে হলে তামাক কোম্পানির লাভের রাজস্ব আয়ের চেয়ে অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্যকে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে। তামাক কোম্পানিকে সুবিধা দিতে বাংলাদেশে তামাক কর কাঠামো অত্যন্ত জটিল করে রাখা হয়েছে। এখানে তামাকজাত দ্রব্যের ওপর কর নির্ধারণ করা হয় বিভিন্ন স্তরভিত্তিক বিক্রয়মূল্যের ওপর, যেখানে করভিত্তি খুবই কম এবং তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য এবং করের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে।

বিভিন্ন মূল্যস্তরভিত্তিক কর কাঠামো থাকায় কোনো এক স্তরের দাম বাড়লেও ব্যবহারকারীরা সহজেই নিম্নস্তরের সিগারেটে চলে যেতে পারে। কারণ নিম্নস্তরের তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য সবসময় তামাকসেবীর ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার প্রচেষ্টা থাকে। বাংলাদেশে তামাকজাত দ্রব্য তুলনামূলক সস্তা ও সাশ্রয়ী। দরিদ্ররা বিত্তবানদের তুলনায় তাদের আয়ের একটি বড় অংশ তামাকজাত দ্রব্য সেবনে ব্যয় করে এবং তারা তামাক ব্যবহারজনিত রোগে সবচেয়ে বেশি ভোগে। ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার পরিবর্তে ধূমপায়ীরা সস্তা সিগারেটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ধূমপানজনিত রোগের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসা ব্যয় লাখো পরিবারকে প্রতি বছর আর্থিক সংকট ও ভয়াবহ দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

গবেষণার ফলে দেখা গেছে, বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা ও উচ্চপদস্থ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে তামাক কোম্পানিগুলোর খুব ঘনিষ্ট ও পারস্পরিক লাভের সম্পর্ক রয়েছে। তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার থাকায় সরকারি কর্মকর্তারা এই সুবিধা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। বিভিন্ন পর্যায় থেকে তামাক কর কাঠামো সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে অনুরোধ জানালেও আজ অবধি কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি। তামাক কোম্পানিগুলো কর সংস্কার প্রক্রিয়ায় জড়িত এনবিআর ও অন্য সরকারি কর্মকর্তাদের নগদ এবং বিভিন্ন ধরনের উপহার দিয়ে থাকেন। এমনকি তাদের জন্য বিদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থাও করা হয়ে থাকে।

সরকার তামাক কোম্পানির বিভিন্ন অনুদানসহ তাদের করপোরেট সামাজিক দায়িত্বের (সিএসআর) কাজকর্মকে সমর্থন দেয়। তামাকজাত পণ্যের কর নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় তামাক কোম্পানিগুলো অনেক আগে থেকেই সুপরিকল্পিত হস্তক্ষেপ করে আসছে। এমনকি কর নির্ধারণেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা দিয়ে থাকে। করোনাকালেও তারা বাংলাদেশের 'প্রয়োজনী পণ্য আইন ১৯৫৬' আইনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে লবিং করে অনুমতি নিয়ে তাদের উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও বিতরণ অব্যাহত রাখে। আইনটিতে সিগারেটের মতো ক্ষতিকর পণ্যকে আজও বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে গণ্য করা হয়।

বিগত অর্থবছরগুলোতে বাজেটে তামাকের ব্যবহার কমানোর মতো কর আরোপ করা হয়নি, যা সত্যিই হতাশাজনক ছিল। নিম্নস্তরের সিগারেট, বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্যের দাম সামান্য বৃদ্ধির প্রস্তাব থাকলেও সম্পূরক শুল্ক খুবই স্বল্প পরিমাণে বাড়ানো হয়েছিল। বাজারে নিম্নস্তরের সিগারেটের আধিক্য থাকায় স্পষ্টতেই সরকারের রাজস্ব আয় কমে যায়। কারণ বিক্রয়মূল্য কম হওয়ায় নিম্নস্তরের সিগারেট থেকে রাজস্ব কম আসে। এ ছাড়া কয়েক বছর ধরে সরকার সব তামাকপণ্যের ওপর ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আদায় করছে। এখন সময় এসেছে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে অন্তত ২ শতাংশে উন্নীত করা ও তামাক নিয়ন্ত্রণে এর ব্যবহার নিশ্চিত করা। যদি ২ শতাংশ সারচার্জ নির্ধারণ করা হয়, তাহলে সরকার প্রায় ৩০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করতে পারবে, যা স্বাস্থ্যখাতকে আরও শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশে তামাকজাত দ্রব্য তুলনামূলক সস্তা ও সাশ্রয়ী। দরিদ্ররা বৃত্তবানদের তুলনায় তাদের আয়ের একটি বড় অংশ তামাকজাত দ্রব্য সেবনে ব্যয় করে এবং তারা তামাক ব্যবহারজনিত রোগে সবচেয়ে বেশি ভোগে। ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার পরিবর্তে ধূমপায়ীরা সস্তা সিগারেটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এই রোগের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসা ব্যয় এবং উপার্জনের অংশ লাখো পরিবারকে প্রতি বছর আর্থিক সংকট ও ভয়াবহ দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয়। এদিকে তামাক ব্যবহার ভবিষ্যৎ উপার্জনের সম্ভাবনাকে হ্রাস করে, বিশেষ করে তরুণ ও প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিকদের অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) অনুচ্ছেদ ৬ এ সামগ্রিক জাতীয় স্বাস্থ্য নীতির একটি অংশ হিসেবে তামাক কর নীতিমালা গ্রহণ এবং তামাকের ব্যবহার কমাতে তামাকজাত দ্রব্যের ওপর কর বৃদ্ধির জন্য সরকারের প্রতি সুপারিশ করা হয়েছে। তামাকের ব্যবহার হ্রাস করার ক্ষেত্রে উচ্চ কর আরোপ হলো সবচেয়ে কার্যকর উপায়ের মধ্যে অন্যতম। উচ্চহারে কর আরোপের ফলে তামাকের ব্যবহার হ্রাসের পাশাপাশি রাজস্বও বৃদ্ধি করে।

অধিকন্তু ঢাকায় অনুষ্ঠিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রথম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান স্পিকারস সামিটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দেন। পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে তামাকের ব্যবহার কমানোর জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী পদক্ষেপ হিসেবে একটি তামাক কর নীতিমালা প্রণয়নের ঘোষণাও দিয়েছেন। সরকার প্রধানের এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে তামাক কোম্পানিতে থাকা সরকারের শেয়ার বিক্রি করে দিতে হবে এবং তাদের সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ত্যাগ করতে হবে।

সরকারকে সমন্বিত ও কার্যকর তামাক কর নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। কর নীতিমালায় সরকারকে, বিশেষ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে তামাক কোম্পানির প্রতি আনুকূল্য দেখানো বন্ধ করতে হবে। তামাকজাত দ্রব্যের খুচরা মূল্য বাড়ানো, বিশেষ করে নিম্নস্তরের সিগারেটের, সিগারেটের মূল্যস্তর নামিয়ে আনতে হবে, সব তামাকজাত দ্রব্যের ওপর একই হারে সম্পূরক শুল্ক এবং সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণের যেকোনো কাজে তামাক কোম্পানির অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করতে হবে। এমনকি তামাক কোম্পানি সিএসআর কার্যক্রমও পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।

বিগত বছরে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে তামাক কর বিষয়ে প্রস্তাব করা হয়েছিল। এই প্রস্তাবগুলোর লক্ষ্য হলো, তামাকখাত থেকে রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং তামাকের ব্যবহার কমানোর মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য রক্ষা করা। এগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে তামাকখাত থেকে সরকার অতিরিক্ত ১০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পেতে পারে। দেশে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ও স্বাস্থ্যব্যয় মেটাতে অতিরিক্ত রাজস্ব আয়ের উৎস হিসেবে সরকারের উচিত তামাক করকে প্রাধান্য দেওয়া। জনগণের ওপর থেকে করের বোঝা কমাতে তামাক থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করা যেতে পারে। আর ধারাবাহিকভাবে তামাক কর বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে তামাক কর কাঠামো সংস্কার প্রয়োজন।

সূত্র: বাংলাদেশ গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (জিএটিএস) ২০১৭; বাংলাদেশে তামাকের অর্থনৈতিক খরচ: একটি স্বাস্থ্য খরচ পদ্ধতি; বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি ২০১৯, সিটিএফকে ফ্যাক্টশিট: ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে তামাক কর বৃদ্ধি বিষয়ক।

লেখক: পরিচালক (স্বাস্থ্য ও ওয়াশ সেক্টর), ঢাকা আহ্‌ছানিয়া মিশন এবং সদস্য, জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাক্সফোর্স কমিটি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments