কৃষকের জন্য বাজেট কেন স্মার্ট হয় না?

সরকারের কাছে কৃষকের চাওয়া-পাওয়া কিন্তু খুবই কম। খুব সহজভাবে বলতে গেলে, কৃষক চায় ফসল ফলানোর উপকরণগুলো যেন তারা কম দামে কিনতে পারে। যেমন: কৃষকের শস্য ফলাতে প্রয়োজন জমি, বীজ, শ্রমিক, সেচের জন্য জ্বালানি বা নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, সার, কীটনাশক এবং সহজলভ্য ও টেকসই প্রযুক্তি।

গত ২ বছরে পৃথিবীতে বড় ২টি সংকট তৈরি হয়েছে। একটি করোনা মহামারি, অপরটি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন। ফলাফল, পৃথিবী জুড়ে তৈরি হয়েছে নানা সমস্যা। সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে বহুগুণ। ফলে দেশে দেশে মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে অনেক।

অন্যদিকে এই পরিস্থিত সামাল দিতে বাংলাদেশের কৃষক রেখেছে অন্যন্য ভূমিকা। তেল, সার, কীটনাশক, বিদ্যুৎ, শ্রমিকের মজুরি—সবকিছুর খরচ বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও কৃষক তার জমি ফেলে রাখেনি। বিগত ২ বছরে আগের বছরের তুলনায় কৃষক ভালো ফসল ফলিয়েছেন। ফলে সরকারকে অধিক মূল্যে বিদেশ থেকে খুব বেশি পরিমাণ খাদ্য শস্য, বিশেষ করে চাল আমদানি করতে হয়নি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২০-২১ অর্থ বছরে বাংলাদেশে চাল উৎপাদনের পরিমান ছিল ৩ কোটি ৮৩ লাখ টন। আর চলতি অর্থবছরে তা (আমন, আউশ, বোরো মিলে) ৪ কোটি ৪ লাখ ৪৪ হাজার টন। অন্যদিকে গত অর্থবছরের তুলনায় এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২৫-৩০ লাখ টন চাল বেশি উৎপাদিত হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা।

আমাদের কৃষকের বড় অংশ এখনো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে খুব বেশি শিক্ষিত না। বাজেট সম্পর্কে সব কৃষকের স্পষ্ট ধারণা নেই। খুব অল্প কৃষক হয়তো বাজেটের ধারণা বোঝেন। এর বাইরে বাজেট সর্ম্পকে কৃষকের তেমন কোনো আগ্রহ নেই।

তবে, আমরা যারা সরাসরি কৃষকের সঙ্গে সম্পৃক্ত, মাঝে মাঝেই তাদের খোঁজ-খবর নিতে যাই, তারা অন্তত বলতে পারি যে আসলেই সরকারের কাছে কৃষক কী চায়।

সরকারের কাছে কৃষকের চাওয়া-পাওয়া কিন্তু খুবই কম। খুব সহজভাবে বলতে গেলে, কৃষক চায় ফসল ফলানোর উপকরণগুলো যেন তারা কম দামে কিনতে পারে। যেমন: কৃষকের শস্য ফলাতে প্রয়োজন জমি, বীজ, শ্রমিক, সেচের জন্য জ্বালানি বা নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, সার, কীটনাশক এবং সহজলভ্য ও টেকসই প্রযুক্তি।

ফসল চাষ করে কৃষক তার পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে চায় এবং ধারাবাহিকভাবে কৃষি থেকে আয় করে জীবনে উন্নতি করতে চায়। সুতরাং কৃষক যে ফসল ফলান, তিনি সেগুলোর উপযুক্ত মূল্য চায়। আর সর্বশেষে কৃষক চায় যেন বাজারে খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কম থাকে।

কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখছি? ফসল চাষ করতে কৃষকের যা যা প্রয়োজন, সবকিছুর দাম নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। জমি, বীজ, তেল, সার, কীটনাশক, শ্রমিকের মজুরি, প্রযুক্তি থেকে শুরু করে সবকিছুর দাম মাসে মাসেই বাড়ছে।

প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন, উৎপাদন বাড়াতে, এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে।

কিন্তু, কৃষক উৎপাদন বাড়াবে কীভাবে?

কৃষক যখন উৎপাদন করতে যান, তখন তার কাছে থাকে না নগদ অর্থ। ফসল কাটার পরে জমির ভাড়া, সার-কীটনাশকের দোকানে হালখাতা, সেচ মেশিনের হালখাতা, দোকান বাকি পরিশোধ করার পর তার হাতে আর কিছুই থাকে না। ফসল চাষের সময় তাকে উচ্চসুদে হয় কারো কাছে থেকে ধার নিতে হয়, কিংবা কোনো এনজিও থেকে ঋণ নিতে হয়। খোঁজ নিয়ে দেখবেন, গ্রামাঞ্চলে কতগুলো এনজিও ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবসা করছে। প্রত্যেকটা কৃষক সেই ঋণের জালে জড়িয়ে গেছে।

পক্ষান্তরে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে প্রতি মাসেরই বাড়ছে বড় বড় ঋণ খেলাপির সংখ্যা। লাখো কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়েছে বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি, ব্যবসার মালিকদের কাছে। তারা কৌশলে সরকারের কাছে থেকে স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা নিচ্ছে। অথচ কৃষক এনজিওর কাছ থেকে ১৩-১৪ শতাংশ পর্যন্ত হারে সুদে ঋণ নিচ্ছে।

এ বছর যেসব কৃষক জমি লিজ নিয়ে বোরো ধান চাষ করেছেন, তারা বিঘা প্রতি লাভ করেছেন মাত্র ৪-৫ হাজার টাকা। বগুড়া নন্দীগ্রাম উপজেলার কুন্দারহাটের কৃষক আবু রায়হান তার ৫ বিঘা জমিতে ব্রি-২৯  জাতের ধান চাষ করে বিঘা প্রতি পেয়েছেন ২৪ থেকে ২৫ মণ ধান। প্রতিমণ ধান ৯৬০ টাকা (বর্তমান বাজারমূল্য) দরে বিক্রি করে লাভ করেছেন ২৫ হাজার টাকা। তার অন্য কোনো আয়ের উৎস নেই। রায়হানের পরিবারে তার মা, বাবা, বোন, ছেলে, মেয়ে ও স্ত্রীসহ ৭ জন সদস্য। আগামী ৬ মাস এই ২৫ হাজার টাকায় তাকে সংসার চালাতে হবে। সে হিসাবে ৭ জনের সংসারে প্রতি মাসে মাথাপিছু ব্যয় করতে পারবে প্রায় ৬০০ টাকা। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতিতে একজন মানুষ এই টাকায় কীভাবে পুরো একটি মাস পার করবে?

পক্ষান্তরে কৃষক যখন ফসল, বিশেষ করে ধান কেঁটে বাজারে বিক্রি করতে যায়, তখন ধানের সরবরাহের তুলনায় চাহিদা কমিয়ে রাখছে ব্যবসায়ীরা এবং কৃষক বাধ্য হয়ে কম দামে ধান বিক্রি করছে। আবার সরকার এমন কঠিন শর্ত দিয়ে ধান কিনছে, যা পূরণ করা কৃষকের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সরকার কৃষককে নায্য দাম দিতে পারছে না। এর ফলে শুধু কৃষক লাভ না করতে পারলেও মধ্যসত্বভোগীরা ঠিকই লাভ করছে।

অন্যদিকে কৃষক না আশা করে প্রণোদনার, না আশা করে আর্থিক ক্ষতিপূরণের। কৃষকের প্রধান চাওয়া ২টি। প্রথমত, সে ন্যয্যদামে কৃষি উপকরণ চায়, দ্বিতীয়ত ফসলের ন্যয্যমূল্য চায়।

এবার আসি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রসঙ্গে। এবার কৃষিতে   ভর্তুকির পরিমান ১৮ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। এই ভর্তুকি থেকে টাকা কোথায় যাবে? কৃষক হাতে কয় টাকা পাবে?

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বলছেন, শস্য উৎপাদন বাড়াতে সাশ্রয়ী মূল্যে সার, বীজ ও অন্যান্য উপকরণ এবং সেচ সুবিধা দিতে এই ভর্তুকি বাড়িয়েছেন। খুবই ভালো কথা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ভর্তুকিতে সত্যি কি কৃষক খুব একটা উপকৃত হচ্ছেন?

এই ১৮ হাজার ২৯৯ কোটি টাকার ভর্তুকি কৃষক কীভাবে পাবে? কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, এই টাকার বেশিরভাগ যাবে সার ও বিদ্যুৎ কিনতে। এরপরে কৃষক কিছু প্রণোদনা পাবে, যা যৎ সামান্য।

সরকার গত অর্থবছরেও ভর্তুকি বাড়িয়ে ২৮ হাজার টাকা খরচ করেছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তেল, গ্যাস ও সারের দাম বেড়ে যাওয়ায়। কিন্তু তারপরেও মাঠ পর্যায়ে কৃষককে বিদ্যুৎ, তেল, সার ও অন্যান্য উপকরণের জন্য অতিরিক্ত পয়সা খরচ করতে হয়েছে। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে বাজারে পাওয়া যায়নি পর্যাপ্ত সার।

অন্যদিকে সামান্য প্রণোদনা দিয়ে কৃষকের তেমন কোনো লাভ হয় না। সাধারণত প্রণোদনা হিসেবে কৃষক তার আবাদি জমির বিপরীতে কিছু বীজ ও সার এবং উপকরণ ও প্রশিক্ষণের জন্য সামান্য অর্থ পেয়ে থাকে। তাও বেশিভাগ ক্ষেত্রে উপযুক্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পায় না।

এখন বিদ্যুতের জন্য যে টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয় তা পায় বড় বড় বিদ্যুৎ কোম্পানি। তাও লোডশেডিং থাকে। সারের জন্য যা ভর্তুকি দেওয়া হয়, সেই টাকা চলে যায় সার কোম্পানির কাছে। কৃষি উপকরণ কেনার জন্য যে ভর্তুকি দেওয়া হয়, সেটাও চলে যায় কোম্পানির হাতে। যেমন: ধান কাটার জন্য যে হার্ভেস্টর মেশিন কৃষককে ভর্তুকির মাধ্যমে দেওয়া হয়, সেই হার্ভেস্টর কিছুদিন পরে নষ্ট হলে কোম্পানি আর বিক্রয়োত্তর সেবা দেয় না। ফলে ভর্তুকিতে পাওয়া মেশিনটা পরে থাকে এবং সুবিধা কৃষকের তুলনায় ওই কোম্পানি বেশি পায়।

মূল কথা হলো, শুধু ভর্তুকি দেওয়াটা আসল কথা নয়। কৃষক সেই ভর্তুকির সুবিধা কতটুকু পাচ্ছে, সেই বিষয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যাথা নেই। এ নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কোনো কাজ হয় না। তা ছাড়া, কৃষক তো ভর্তুকি চায় না। কৃষক চায় চাষের জন্য ভালো বীজ সরকারি পর্যায় থেকে পেতে। সরকারের হাতে ভালো বীজ নেই, সেগুলো চলে গেছে বেসরকারি পর্যায়ে।

কৃষক চায় কম দামে উৎপাদনের উপকরণ পেতে, সেটা পায় না। কৃষক চায় মৌসুমি ফসল যেন সরকারি ব্যবস্থায় সংরক্ষণ করতে পারে এবং সঠিক সময়ে বিক্রি করতে পারে, সেটাও কৃষক পারে না। ফসল ঘরে তুলে সঙ্গে সঙ্গে সঠিক মূল্যে বিক্রি করতে চাইলেও, সেটাও সে পায় না।

কৃষক চায় নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় মাত্রায় থাকুক, সেটাও সে পায় না। সরকারি ঋণ পেতে কৃষককে নানা হয়রানির স্বীকার হতে হয়। ফলে কৃষক আর ব্যাংকেই যায় না ঋণ নিতে। তারা যায় এনজিওতে। কারণ এনজিও কৃষকের বাড়িতে আসে টাকা দিতে।

তাহলে আগামী অর্থবছরের বাজেটে কৃষকের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন কোথায়?

কৃষকের জন্য কেবল ভর্তুকিনির্ভর বাজেট হলে হবে না। থাকতে হবে টেকসই উন্নয়নের বাজেট, যেখানে কৃষকের জন্য বাজার ব্যবস্থা প্রয়োজনে সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। কৃষককে ফসল রোপনের সময় বিনাসুদে, সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে, যাতে সে ইচ্ছেমত ফসলের উৎপাদন বাড়াতে পারে। কৃষি উপকরণে বিক্রয় উত্তর সেবা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষকের ফসল সংরক্ষণের জন্য জেলা-উপজেলায় হিমাগার করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। কৃষি গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে, যেন ভালো বীজের বাজার সরকারের অধীনে থাকে।

কৃষক চায় আত্মনির্ভরশীল হতে। কৃষক চায় তার পেশা হবে লাভজনক। আর আমাদের শুধু সামান্য ভর্তুকির বাজেট দিন দিন কৃষককে করছে পর নির্ভরশীল। এই অবস্থা থেকে কৃষককে বের করে আনার জন্য বাজেট হতে হবে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে। বাজেট হতে হবে কৃষকবান্ধব। কৃষকের ভর্তুকির অর্ধেক টাকা বিনা সুদে, সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া যেতে পারে। অথবা ঋণের জন্য কৃষিতে আরও বাজেট বাড়াতে হবে।

মোস্তফা সবুজ দ্য ডেইলি স্টারের বগুড়া প্রতিনিধি

Comments