পাঠ্যবইয়ে ফের গণ্ডগোলের রিহার্সাল

পাঠ্যবই ছাপায় এবারও গোলমালের আভাস। গেল বছর একদিকে ছিল ভুল তথ্য, কপি পেস্টসহ উদ্ভট-উৎকট যত কাণ্ড, অন্যদিকে সময়মতো কার্যাদেশ না দেওয়ায় বছরের শুরুতে বই দেওয়া যায়নি শিক্ষার্থীদের। সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার আগেভাগে কাজ শুরুর একটা আশা করা হয়েছিল। কিন্তু, ভেতরগত খবর সুখকর নয়। ভেতরের আরও খবর হচ্ছে, বইয়ে ভুল থাকুক, আরও ছাপা হোক—সেই অপেক্ষায়ই থাকে একটি মহল। নামমাত্র রেটেও বই ছাপতে এক পায়ে খাড়া থাকে তারা। তাদের হিসাব পরিষ্কার—যত ভুল তত ছাপা, আর যত ছাপা তত লাভ। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এবার মোট বই ছাপা হবে যথাক্রমে প্রায় ৬ কোটি ৪৫ লাখ ও ৪ কোটি ৪৫ লাখ।

আগের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এবার আগেভাগেই ছাপার কাজ শুরু করেছে বলে খবর ছিল। কিন্তু, ঝামেলা বেধেছে ছাপার রেট নিয়ে। এ নিয়ে ভেতরে-ভেতরে কদিন গণ্ডগোল পাকানোর পর এখন মাধ্যমিক স্তরে প্রাক্কলিত দরের চেয়েও অস্বাভাবিক কম দরেই ম্যাজিকের মতো ছাপার কাজ নিচ্ছেন মুদ্রণকারীদের একটি চক্র। এর ভেতরে অনেক গোমড়। গত বছরের চেয়ে এবারে ছাপার কাগজের উজ্জ্বলতার শর্ত ৫ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। 
গত বছর এটি ছিল ৮৫ শতাংশ। কাগজ–সংকট বিবেচনায় এটি করা হয়েছে বলে যুক্তি এনসিটিবির সংশ্লিষ্টদের। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এনসিটিবি প্রাক্কলিত ব্যয় গড়ে ফর্মাপ্রতি ধরা হয়েছিল তিন টাকা। কিন্তু ভৌতিককাণ্ডের মতো ষষ্ঠ শ্রেণিতে মুদ্রণকারীরা ফর্মাপ্রতি সর্বনিম্ন দর দিয়েছেন ১ টাকা ৯৩ পয়সা। আর সপ্তম শ্রেণিতে ১ টাকা ৭৯ পয়সা। স্বাভাবিক হিসাবে এতে তাদের লাভ দূরে থাক, লোকসানেও কুলাবে না। পুঁজিই থাকার কথা নয়। এর গোমড় গরলে ভরা।

প্রতিবছরই পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে তারা সমস্যা তৈরিতে পারঙ্গম। প্রথমে নিম্ন দরে কার্যাদেশ নেন। পরে নানা অজুহাত তুলে সময়মতো বই পৌঁছান না। এরপর যা কিছু সাপ্লাই দেন সেগুলোর ছাপা ও কাগজের মান থাকে অত্যন্ত নিম্ন। এবার এনসিটিবি ছাপার কাগজের উজ্জ্বলতার শর্ত ৫ শতাংশ কমিয়ে আরেক কারসাজির দুয়ার খুলে দিয়েছে। এর যৌক্তিকতা হাতিয়ে পাওয়া দুষ্কর। এনসিটিবির প্রাক্কলিত ব্যয় যৌক্তিক হলে মুদ্রণকারীদের দেওয়া নিম্ন দর অযৌক্তিক। আবার মুদ্রণকারীদের দেওয়া দর যৌক্তিক হলে এনসিটিবির প্রাক্কলিত ব্যয় অবশ্যই অযৌক্তিক-প্রশ্নবিদ্ধ।

এ বিষয়ে গত ২৪ জুন দৈনিক ইত্তেফাকে 'কম মূল্যে বই ছাপতে রাজি কয়েক জন প্রেস মালিক' শীর্ষক সংবাদও প্রকাশ হয়।

নিম্নতর দরে কার্যাদেশ দিয়ে নিম্নমানের বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানোর চিন্তার এমন দুর্ভিক্ষ কী বার্তা দিচ্ছে? শিক্ষার্থীর সংখ্যা নিয়েও কিছু তেলেসমাতি কাণ্ড চলে আসছে নিঃশব্দে। যে সংখ্যক শিক্ষার্থীর নামে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপা হয়, প্রকৃত পক্ষে সে সংখ্যক শিক্ষার্থী আছে কি না, প্রশ্নের জায়গাই নেই। এবার ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থীর জন্য বই ছাপা হবে প্রায় ৩৪ কোটি। এর মধ্যে মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী প্রায় ১ কোটি ৬৭ লাখ। তাদের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে বই ছাপা হবে ২৩ কোটির মতো। দেশে মাধ্যমিক স্তরে এত শিক্ষার্থী কি আছে?

সরকারের শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য অনুযায়ী, মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটির কিছু বেশি। সেখানে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদেরও যোগ করলে এ সংখ্যা ১ কোটি ৬৭ লাখে যাবে না। প্রায় প্রতিবছরই শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি দেখিয়ে বই ছাপানোর কার্যাদেশ দেওয়া হয়। যেখানে ঘটে একটি বোঝাপড়ার লুটোপুটি।

২০১০ সাল থেকে দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে নতুন পাঠ্যবই দেওয়ার রেওয়াজ চালু হয়। এমন প্রশংসিত উদ্যোগটি নিয়েও উইপোকার তৎপরতা দমানোর অ্যাকশন প্রোগ্রাম নিতে পারেনি সরকার। বরং পোকা চক্রই সরকারকে কাবু করে ফেলছে। শিক্ষার্থীদের হাতে সময়মতো বই দেওয়া যাচ্ছে না আতঙ্ক তারাই তৈরি করে, আবার হুলস্থূলে দ্রুত বই পৌঁছানোর ব্যবস্থাও করে। এ পরিস্থিতিতে তাদের আমলনামা ঢেকে দেয়। বরং সরকারকে-দেশকে উদ্ধারের কৃতিত্ব নেয়। তাদের অপতৎপরতাতেই গেল বছর সব পাঠ্যবই যথাসময়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার।

এবার ৩৪ কোটি বই ছাপানো নিয়ে কী করবে বা করতে পারে—এর কিছু নমুনা এরইমধ্যে দেখা যাচ্ছে। মাধ্যমিক স্তরে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে অস্বাভাবিক কম দরে বই ছাপানোর কাজ নিয়ে তারা সেই রিহার্সালই শুরু করেছে। লোকসানের হিসাব প্রচার করে নানান ফন্দি-ফিকিরে মুনাফা হাতানোর পথ তাদের কব্জায়। অস্বাভাবিক কম দরে কার্যাদেশ নিয়ে নিশ্চয়ই তারা লোকসান গুনবেন না। দরপত্রে বইয়ের যে 'মান' উল্লেখ আছে, লাভ করার জন্য সেটিই যথেষ্ট। কাগজ-মুদ্রণের মান কমানোর শর্ত দিয়ে 'একে তো নাচুনি বুড়ি, তার ওপর ঢোলে বাড়ি'র মতো তাদের ফ্রি-স্টাইল এগোবার সংকেত দিয়ে দেওয়া হয়েছে। শর্তের চেয়ে আরও নিম্নমানের কাগজ ঢুকিয়ে দেওয়ার এনওসি তারা হাসিল করে নিয়েছেন।

গতবারের চেয়ে ৫ শতাংশ কম উজ্জ্বলতার কাগজে বই ছাপানোর নেপথ্যে সরকারের কিছু সাশ্রয়ের যুক্তি আবিষ্কারের পেছনে এনসিটিবি ও কিছু মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের কারসাজি ওপেন সিক্রেট সংশ্লিষ্ট মহলে। বই ছাপার কাজ পাওয়ার পর তারা এমনিতেই নিম্নমানের কাগজ-কালি ব্যবহার করে। এবার সরকারের দিক থেকেই মানে ছাড় দেওয়ার শর্ত হাসিলে তারা কী করবেন অপেক্ষা করে দেখার বিষয়। চলতি শিক্ষাবর্ষে নির্দেশনা ছিল ৮৫ গ্রামের কাগজে বই ছাপার। এবার তা কমিয়ে ৮০ গ্রাম করা হয়েছে। বাস্তবে তারা সেখানে কয় গ্রাম দেবেন—তা বোঝার সময়-সুযোগও না রাখার ব্যবস্থা তারা জানেন। ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে কয়েকটি মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের কাগজে বই সরবরাহ করে। এসব বই শিক্ষাবর্ষ শুরুর ২-৩ মাসেই ছিঁড়ে বা কালি উঠে পাঠের অযোগ্য হয়ে গেছে। এত মুদ্রাকরদের কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। বরাবরের মতো শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এনসিটিবি যেকোনোভাবেই নতুন শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন বই উৎসব করবে, তা অনেকটা নিশ্চিত। তাই যথেষ্ট? ভুল-শুদ্ধ মিলিয়ে বইয়ের গুণ-মানসহ অন্যান্য বিষয়াদির কথা তো তোলাই থাকল।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

No active militant presence in Bangladesh: home adviser

The reports of suspected extremists' deportation from Malaysia shows no links to local terrorist networks, he says

44m ago