‘স্বতন্ত্র সদস্য’ ও ‘বিরোধী দলে’র সাংবিধানিক জটিলতা

যেহেতু এবারও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, অতএব তারা চাইলে বিরোধী দল, বিরোধী দলীয় নেতা এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের বিষয়ে কিছু গণতান্ত্রিক বিধান সংবিধান ও কার্যপ্রণালি বিধিতে যুক্ত করতে পারে।

গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে বিরোধী দল নিয়ে—বাংলাদেশের সংবিধানে যে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বিধান নেই।

এমনকি সংবিধানে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য এবং বিরোধী দল বলে কোনো শব্দও নেই। তার মানে, স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে যারা সংসদ সদস্য হয়েছেন, তারা কি বৈধ বা তারা কি সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী কোনো দলে যোগ দিয়ে সেই দলের এমপি হিসেবে বিবেচিত হতে পারবেন? কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জোটবদ্ধ হয়ে একটি মোর্চা বা সংঘ তৈরি করে বিরোধী দলের আসনে বসতে পারবেন? যেহেতু বিরোধী দল বা বিরোধী দলীয় নেতার ব্যাপারে সংবিধানে কিছু বলা নেই, ফলে সংসদে যদি কোনো বিরোধী দল বা বিরোধী দলীয় নেতা না থাকেন, সেটি কি অবৈধ হবে?

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবার চেষ্টা করা হবে এই নিবন্ধে।

গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের বাইরে এককভাবে অর্থাৎ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন ৬২ জন, যাদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন আওয়ায়ামী লীগ এবং তার বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের বর্তমান এবং কেউ কেউ সাবেক অথবা বহিষ্কৃত নেতা। এককভাবে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২২৩টি এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দল হিসেবে জাতীয় পার্টি পেয়েছে মাত্র ১১টি আসন।

কতগুলো আসন পেলে বিরোধী দল?

সংবিধান বা সংসদ পরিচালিত হয় যে কার্যপ্রণালি বিধির দ্বারা, তার কোথাও বিষয়টি স্পষ্ট নয় যে সংসদের বিরোধী দল হওয়ার জন্য ন্যূনতম কতগুলো আসন পেতে হবে। তবে এরকম একটি রেওয়াজ আছে যে মোট আসনের অন্তত এক দশমাংশ না পেলে সেই দলকে বিরোধী দল বলা যায় না।

তার মানে ৩০০ আসনের সংসদে অন্তত ৩০টি আসন থাকতে হবে। প্রতিবেশী ভারতে এই চর্চা রয়েছে। যেমন: এই ‍মুহূর্তে ভারতের লোকসভায় কোনো বিরোধী দলীয় নেতা নেই। ৫৪৫ জনের ভারতের লোকসভায় কমপক্ষে এক–দশমাংশ আসন না পেলে সেই দলকে বিরোধী দল হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয় না।

ভারতে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত টানা তিনটি লোকসভায় কোনো বিরোধী দল ছিল না। দীর্ঘদিন পরে আবার সেই একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি লোকসভা। গত দুই মেয়াদ ধরে ভারতের লোকসভায় বিরোধী দলীয় নেতার আসন শূন্য। কারণ সেখানেও ক্ষমতাসীন বিজেপির নিরঙ্কুশ বিজয়ের ফলে মোট আসনের এক দশমাংশও পায়নি কংগ্রেস।

বাংলাদেশের সংবিধান বা কার্যপ্রণালিবিধিতে এরকম কোনো বিধান নেই। বরং স্পিকার চাইলে তার বিবেচনামতে সংসদে বিরোধিতাকারী দল বা সংঘের নেতাকে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে ঘোষণা করতে পারেন। এখানে তার একক ক্ষমতা রয়েছে। অবশ্য স্পিকার সাধারণত সংসদ নেতার সঙ্গে পরামর্শ করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অতএব জাতীয় পার্টিকেই বিরোধী দল এবং সেই দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকেই বিরোধী দলীয় নেতা ঘোষণা করতে হবে—এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি এবং জাতীয় সংসদ সচিবালয় আইন ১৯৯৪ অনুযায়ী বিরোধী দলের নেতা অর্থ 'স্পিকারের বিবেচনামতে যে সংসদ-সদস্য সাময়িকভাবে সংসদে সরকারের বিরোধীতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমত দল বা অধিসঙ্ঘের নেতা।'

এখানে শর্ত তিনটি:

১. সংসদে সরকারের বিরোধীতাকারী দল বা অধিসংঘ।

২. সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য নিয়ে গঠিত দল বা অধিসংঘ।

৩. দল বা অধিসংঘের নেতা।

এখানে এটি বলা হয়নি যে, নির্বাচনে যে দল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পাবে সেই দল বিরোধী দল হবে এবং সেই দলের নেতা বিরাধী দলীয় নেতা হবেন। এখানে বলা হয়েছে, স্পিকারের বিবেচনামতে যে সংসদ সদস্য সাময়িকভাবে সংসদে সরকারের বিরোধীতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য নিয়ে গঠিত দল বা অধিসংঘের নেতা।

তার মানে দলীয় পরিচয়ের বাইরেও যদি অনেক সদস্য মিলে একটি জোট গড়ে তোলেন, এই বিধানের আলোকে সেটি অবৈধ নয়। এমনকি স্পিকার চাইলে তার বিবেচনা মতে যেকেনো সদস্যকেই বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে ঘোষণা করতে পারেন। কেননা সংসদে কোনো একটি দলকে বা অধিসংঘকে বিরোধী দল হতেই হবে—এমন বিধান বাংলাদেশের সংবিধান বা কার্যপ্রণালি বিধিতে নেই। বরং এটি সংসদীয় রীতি বা রেওয়াজ।

প্রশ্ন উঠতে পারে দল ও অধিসংঘ কি অভিন্ন? যদি অভিন্ন হতো তাহলে দল বা অধিসঙঘ লেখা হতো না। এখানে অধিসংঘকে দল থেকে আলাদা করার জন্যই দুটি শব্দ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের সাংবিধানিক বৈধতা

বাংলাদেশের সংবিধানে রাজনৈতিক দলের একটি সংজ্ঞা রয়েছে এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রণ করতে হলে যেকোনো রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হতে হবে—এমন বিধানও রয়েছে। সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে: 'রাজনৈতিক দল বলিতে এমন একটি অধিসঙ্ঘ বা ব্যক্তিষসমষ্টি অন্তর্ভুক্ত, যে অধিসঙ্ঘ বা ব্যক্তিসমষ্টি সংসদের অভ্যন্তরে বা বাহিরে স্বাতন্ত্র্যসূচক কোন নামে কার্য করেন এবং কোন রাজনৈতিক মত প্রচারের বা কোন রাজনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার উদ্দেশ্যে অন্যান্য অধিসঙ্ঘ হইতে পৃথক কোন অধিসঙ্ঘ হিসাবে নিজদিগকে প্রকাশ করেন।'

এখানে রাজনৈতিক দল বলতে এমন একটি অধিসংঘকে বুঝানো হয়েছে যারা সংসদের অভ্যন্তরে বা বাইরে স্বাতন্ত্র্যসূচক কোনো নামে সক্রিয়। আর অধিসংঘ বলতে বুঝনো হয়েছে ব্যক্তিসমষ্টিকে।

আপাতদৃষ্টিতে এখানে দল ও অধিসংঘ অভিন্ন মনে হলেও এই বিধানের বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়ে এটি প্রমাণ করা সম্ভব যে দল ও অধিসংঘ আলাদা সত্তা। যদি না হতো তাহলে কার্যপ্রণালি বিধিতে দল ও অধিসংঘ দুটি শব্দই উল্লেখ করা হতো না এবং সংবিধানেও রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞায় অধিসংঘ শব্দের ওপর বিশেষভাবে জোর দেওয়ার প্রয়োজন হতো না।

সংবিধানের বিধানের আলোকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা 'কোনো রাজনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার উদ্দেশ্যে পৃথক অধিসঙ্ঘ হিসেবে' নিজেদেরকে প্রকাশ করতে পারেন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদেও এই বিধানটি ছিল। পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে সংবিধানের ৭০ (৩) অনুচ্ছেদের বিধান ছিল: 'যদি কোনো ব্যক্তি নির্দলীয় প্রার্থীরূপে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইবার পর কোনো রাজনৈতিক দলে যোগদান করেন, তাহা হইলে তিনি এই অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্যসাধনকল্পে উক্ত দলের মনোনীত প্রার্থীরূপে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।'

পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে এই বিধানটি বাতিল করা হয়েছে। এই বিধানটি বাতিল করার মূল কারণ ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে এই বিধানটি ছিল না। এটি পবর্তীতে যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু এই বিধানটি বাতিলের ফলে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের কোনো রাজনৈতিক দলে যোগদান করার বিষয়টি প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ালো কি না—সেটি বিরাট প্রশ্ন। কেননা এখন যদি সত্যি সত্যি ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের সবাই কিংবা কিছু সংখ্যক অথবা একজনও যদি কোনো দলে যোগদান করতে চান, সংবিধান কি সেটি অনুমোদন করবে?

আবার রাজনৈতিক দলের নেতা হওয়া সত্ত্বেও যারা দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত হননি, তারাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই দলের সংসদ সদস্য হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে পারবেন না। ফলে এখানে একটি ধোঁয়াশা আছে যে, স্বতন্ত্র এমপিরা কোনো দলে যোগ দিতে পারবেন কি না এবং দলে যোগ না দিয়েও তারা নিজেরা একটি সংঘ বা মোর্চা গঠন করে বিরোধী দলের আসনে বসতে পারবেন কি না?

সংঘ বা অধিসংঘ গঠনে বাধা না থাকলেও যেহেতু বিষয়টি সংবিধানে স্পষ্ট নয়, তাই এ বিষয়ে স্পিকার তার বিবেচনামতে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন। তবে স্পিকারও নিজের খেয়াল খুশিমতো যেকোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। তার সিদ্ধান্তটিও সাংবিধানিক এবং কার্যপ্রণালি বিধির আলোকেই হতে হয়।

স্বতন্ত্র এমপিদের আইনি বৈধতা

সংবিধানে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা বা নির্দেশনা না থাকলেও নির্বাচনি আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ২০ ধারায় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে গেলে তাকে কোন কোন শর্ত মানতে হবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় তাকে প্রতীক দেওয়া হবে, এই ধারায় সেটি বিস্তারিত বলা আছে।

তার মানে সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা তাদের দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য আলাদা প্রতীকের ব্যবস্থা রয়েছে। এই বিধানে এটি স্পষ্ট যে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের বিধান মেনে বাংলাদেশের যেকেনো নাগরিক সংসদ সদস্য হিসেবে প্রার্থী হতে পারবেন এবং দলীয় প্রতীক না থাকলেও তিনি স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন।

কেন স্বতন্ত্র সদস্য?

স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নতুন কোনো বিষয় নয়। ১৭ শতকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে 'স্বতন্ত্র' বলতে রাজার সঙ্গে সংশ্রবহীন সদস্যদের বুঝাতো। তখন দলীয় আনুগত্য ও দলের সাংগঠনিক শৃঙ্খলার নীতি এত কঠোর ছিল না। কোনো কোনো সদস্য দল নিরপেক্ষ হলেও তাদের সাধারণভাবে টোরি, উইগ বা র‍্যাডিকেল দলের সদস্য বলে মনে করা হতো। তাদেরকে পার্লামেন্টের একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে বিবেচনা করা হতো।

হ্যারল্ড নিকোলসন পাঁচ ধরনের স্বতন্ত্র সদস্যের কথা বলেছেন।

১. সত্যিকারের স্বতন্ত্র, যারা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব সম্পদ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা মোকাবিলা করেন;

২. আপাত স্বতন্ত্র, যারা দলের সঙ্গে সাময়িক সম্পর্ক ছিন্নের কারণে স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন (দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এই ক্যাটাগরিতে পড়েন);

৩. একাডেমিক স্বতন্ত্র। যেমন: কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সদস্য;

৪. মেজাজি স্বতন্ত্র সদস্য, যারা আসলে কোনো দলের সদস্য কিন্তু মতভিন্নতার কারণে সেখানে অবস্থান করেন না এবং

৫. অসহায় স্বতন্ত্র। অর্থাৎ মৃত বা জনবিচ্ছিন্ন দলের টিকে থাকা জনপ্রিয় কোনো নেতা, যার স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে নির্বাচন করা ছাড়া উপায় নেই। (পার্লামেন্টারি শব্দকোষ, বাংলা একাডেমি/২০১০, পৃষ্ঠা ১২১)

সংসদীয় গণতন্ত্রে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় নানা কারণেই। যে কারণে অনেক সময় কোনো বড় দলের ব্যাকবেঞ্চারদের তুলনায় স্বতন্ত্র সদস্য অনেক সহজেই স্পিকারের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেন—যার বড় উদাহরণ নবম সংসদের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ফজলুল আজিম।

তবে স্বতন্ত্র সদস্যদের বিরুদ্ধে অনেক সময় রাজনীতির মধ্যে থেকে রাজনীতিহীনতার কথা বলার অভিযোগ ওঠে। অনেক সময় পার্লামেন্টারি বিতর্কের সময় তারা অনেকটা বিচ্ছিন্ন বোধ করেন। যে কারণে পার্লামেন্টারি রাজনীতির মূলধারায় এদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হয় না।

আবার স্বতন্ত্র সদস্যরা দলীয় মেরুকরণের কারণে এলাকার উন্নয়নে সরকারি দলের সদস্যদের মতো বিশেষ সুবিধা পান না। এসব বিবেচনায় নিয়ে এবার যে ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের কতজন সত্যি সত্যিই বিরোধী দলীয় সদস্য পরিচয়ে পরিচিতি হতে চাইবেন—তা নিয়ে সংশয় আছে।

এবার কী হবে?

গণমাধ্যমের খবর বলছে, নবনির্বাচিত স্বতন্ত্র এমপিদের মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা চলছে। নতুন একটি জোট বা রাজনৈতিক প্লাটফর্ম গঠনের বিষয়ে আলোচনা এগিয়েছে এবং বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছেছে বলেও শোনা যাচ্ছে।

এমনকি স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের মধ্যে থেকে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে দুয়েকজন সম্ভাব্য এমপির নামও শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ভরাডুবির পরে জাতীয় পার্টির ভেতরে যে টানাপড়েন শুরু হয়েছে, সেই বাস্তবতায় স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা মিলে একটি অধিসংঘ গঠন করে স্পিকারের কাছে তাদের একজন নেতার নাম প্রস্তাব করলে সেটি বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে একটি নতুন ঘটনা হবে।

১৯৮৮ সালে আ স ম আব্দুর রবের নেতৃত্বে সম্মিলিত বিরোধী দল গঠন করা হলেও সেটি ওই অর্থে খুব একটা কার্যকর ছিল না। কিন্তু এবার যেহেতু স্বতন্ত্র এমপিদের সংখ্যা অনেক বেশি এবং তারা যদি সত্যি সত্যিই নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলে বিরোধী দলের আসনে বসতে চান, সেটি সংসদীয় রাজনীতির জন্য মন্দ হয় না। কিন্তু এর সম্ভাবনা কম। কারণ যারা স্বতন্ত্র হিসেবে জয়ী হয়েছেন তাদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলেরই লোক। ক্ষমতাসীন দলের লোক বিরোধী দলের পরিচয় বহন করতে চাইবেন কি না, সেটি বড় প্রশ্ন।

সমাধান কী?

অতএব আগামী ২৯ জানুয়ারি একাদশ সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরু হবে, সেখানে সত্যিই কারা বিরোধী দলের আসনে বসবেন এবং বিরোধী দলীয় নেতাই বা কে হবেন, সেটি হয়তো কয়েকদিনের মধ্যেই স্পষ্ট হবে। নতুন কিছু না ঘটলে আগের দুটি সংসদের ধারাবাহিকতায় হয়তো শেষ পর্যন্ত সবেধন নীলমনি জাতীয় পার্টিই বিরোধী দলের আসনে এবং দলের নেতা হিসেবে জি এম কাদের বিরোধী দলীয় নেতা হবেন।

কিন্তু সংবিধান ও কার্যপ্রণালি বিধিতে বিরোধী দল, বিরোধী দলীয় নেতা এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের ব্যাপারে যে অস্পষ্টতা রয়ে গেলো তার কী হবে?

দ্বাদশ সংসদের সদস্যরা কি এই বিষয়গুলো সংবিধানে যুক্ত করা তথা পরিস্কার করার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন? সংসদীয় গণতন্ত্রে যেহেতু বিরোধী দলের ভূমিকা অপরিসীম এবং একটি স্বাধীন সার্বভেৌম দেশের নাগরিক হিসেবে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের বিধান মেনে যেকোনো নাগরিক দলীয় প্রার্থী হিসেবে তো বটেই, স্বতন্ত্রভাবেও সংসদ সদস্য নির্বাচিতে হতে পারেন, ফলে এই দুটি বিষয়ে পরিস্কার দিকনির্দেশনা থাকা দরকার।

যেহেতু এবারও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, অতএব তারা চাইলে বিরোধী দল, বিরোধী দলীয় নেতা এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের বিষয়ে কিছু গণতান্ত্রিক বিধান সংবিধান ও কার্যপ্রণালি বিধিতে যুক্ত করতে পারে। অর্থাৎ সংসদে বিরোধী দল হতে গেলে ন্যূনতম কতগুলো আসন পেতে হবে; কোনো দল সেই ন্যূনতম আসন না পেলে কী হবে বা সেই সংসদ বিরোধী দলবিহীন থাকবে কি না; স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী কোনো দলে যোগ দিলে তার স্ট্যাটাস বা মর্যাদা কী হবে—এসব বিষয়ে খুব স্পষ্ট বিধান থাকা জরুরি।

 

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments