আগুনের ব্যবহার ও আগুন নিয়ন্ত্রণ

আগুন প্রতিরোধ কোনো রকেট সাইন্স নয়, দুর্বোধ্যও না। শুধু সঠিক ব্যবস্থা নিলেই সেটা সম্ভব।
স্টার ফাইল ছবি

মানব সভ্যতার প্রথম আবিষ্কার আগুন। বলা চলে, আগুন আবিষ্কার ও তার ব্যবহারের মাধ্যমেই হয়তো মানুষ অন্যান্য জীব থেকে আলাদা হয়ে যায়। আগুন মানুষকে উষ্ণতা দেয়, বৈরি আবহাওয়াতে টিকে থাকতে শিখায়, কাঁচা খাবারের পরিবর্তে রান্না করা খাবারে অভ্যস্ত করে, হিংস্র পশুর হাত থেকে সুরক্ষা দেয়।

ধারণা করা হয়, তিন-চার মিলিয়ন বছর আগে থেকেই মানুষ আগুন ব্যবহার করছে। কিন্তু আগুন নিয়ন্ত্রণ করার দক্ষতা লাভ করে আরও অনেক পরে—হয়তো ১০ লাখ বছর আগে।

আগুন নিয়ন্ত্রণ করার আগ পর্যন্ত আগুন ব্যবহৃত হয়েছে অন্য যেকোনো প্রাণীর মতোই, যেভাবে সূর্যালোকে রোদ পোহায়। পরে একমাত্র মানুষই আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে, আর সেইসঙ্গে অন্য সব জীব থেকে আলাদা হয়ে সৃষ্টি হয় বুদ্ধিমান প্রজাতির।

আগুন কিংবা উত্তাপ সবসময়েই ছিল। কিন্তু পার্থক্য সৃষ্টি করেছে নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা দিয়ে। তবে ২০২৪ সালে এসেও বাংলাদেশে আমরা আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখিনি। আমরা আধুনিক বানরের মতো গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে বসে আছি, ড্রাইভিং শিখিনি। কখনো আগুন লাগছে চিনিকলে, কখনো গার্মেন্টসে, কখনো বস্তিতে, আবার কখনো মার্কেটে। মাতাল গাড়িচালক কখনো গাড়ি ফুটপাথে উঠিয়ে হত্যা করে পথচারী, কখনো রিক্সার ওপর চালিয়ে দিয়ে কাউকে হত্যা করে, আবার কখনো গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে নিজেকে হত্যা করে। আমরা আগুন ব্যবহার করছি এমনই এক চালকের মতো।

আগুনের প্রধান উৎস জ্বালানি তেল। তেল পরিবাহী এসব জাহাজ হলো বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থাপনা—বলা চলে ভাসমান বোম। জাহাজগুলোর ট্যাংকে খনিজ তেল ভরা হয়। খনিজ তেল থেকে সবসময় দাহ্য গ্যাস নির্গত হতে থাকে। আগুন লাগা, বিস্ফোরণ হওয়া থেকে শুরু করে বিষাক্ত গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে ট্যাংকার জাহাজগুলোতে।

এভাবে ঠেকে ঠেকে শিখেছে কীভাবে বিপদ এড়ানো যায়। সমুদ্রে গ্যাসবাহী ট্যাংকার রয়েছে, কেমিক্যালবাহী ট্যাংকার রয়েছে, আর রয়েছে পেট্রোলিয়াম ট্যাংকার বা তেলের জাহাজ। এখনো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জাহাজ হচ্ছে অয়েল ট্যাংকার। কিন্তু এখন দুর্ঘটনা ঘটে না বললেই চলে। বরং বলা যায়, ট্যাংকার অন্যতম নিরাপদ জাহাজ। কারণ, এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি, এর নাবিকরাও সবচেয়ে বেশি সচেতন।

আমার সন্তান যদি মেধাবী নাও হয়, তবুও পড়াশুনার ব্যাপারে সবচেয়ে মেধাবী বা ভালো ফলাফল করা একজনকে অনুসরণ করে, বা তাকে রোল মডেল হিসেবে গ্রহণ করে। জাহাজের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, ট্যাংকারগুলো যে ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে, অন্য জাহাজগুলোও সেটা অনুসরণ করে।

ট্যাংকারে যে ধরনের সতর্কতা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, অন্য জাহাজে সেটা হয়ত কয়েক বছর পরে শুরু হয়। কেবল সতর্কতা অবলম্বন করে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনাকেও যে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ করা যায়, তেলবাহী জাহাজগুলো তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।

মাঝ সমুদ্রে কোনো ফায়ার সার্ভিস নেই, হেলিকপ্টার নেই। তারপরেও মাত্র ২০-২৫ জন নাবিকের ওপর ভরসা করে কোটি কোটি লিটার তেল নিরাপদে পরিবহন করা হয় এসব ট্যাংকারে। সে তুলনায় ঢাকা শহরের একটি ভবন, কারখানা, কিংবা মার্কেটকে অগ্নিনিরাপত্তা নিরাপত্তা দেওয়া অনেক সহজ।

আজ এই সহজ পদ্ধতিগুলো নিয়েই সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।

ডিজাইন অ্যান্ড প্লানিং ষ্টেজ: জায়গার বিভক্তি

আগুন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির কয়েকটি ধাপ রয়েছে। যেকোনো সময়ে, যেকোনো জায়গা থেকে আগুনের উৎপত্তি হতে পারে এবং হয়। একটি বড় মার্কেটে আগুন লাগলেও তার সূত্রপাত হয় কোনো একটি দোকান থেকে।

আগুন যতই ছড়িয়ে পরে, তাকে নেভানো ততোই কঠিন হয়ে দাঁড়ায় এবং জানমালের ক্ষতি ততোই বাড়তে থাকে। দেখা যায়, একটি বহুতল ভবনের একটি ফ্লোরের কোনো এক কোণে একটি জ্বলন্ত সিগারেট থেকে পুরো ২৪তলা ভবনে আগুন লেগে গেছে। যদি সিগারেটটিকে সময় মতো একটি বালতি দিয়ে ঢেকে দেওয়া যেত, তাহলে আগুনের সূত্রপাতই হতো না।

এ জন্য একটি স্থাপনার নকশা করার সময় সেটি কী কাজে ব্যবহৃত হবে তার পরিপ্রেক্ষিতে আগেই কম্পার্টমেন্টেশন করা হয়। মানে পুরো ভবনে কোথায় কী থাকবে, কোথায় সেলাই হবে, কোথায় বয়লার চলবে, কোথায় জ্বালানি তেল থাকবে, কোথায় ওয়াশিং হবে, কোথায় আয়রনিং হবে—এমন কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়।

ধরে নিলাম, জ্বলন্ত সিগারেটটি কারো চোখে পরেনি, তাই নেভানো হয়নি, আগুন লেগে গেছে। যে রুমটিতে আগুন লেগেছে, সেই রুমটি যদি বন্ধ করে দেওয়া যেত, তাহলে আর পাশের রুমে আগুন ছড়িয়ে পড়তো না। যদি সেটাও সম্ভব না হয়, তাহলে যে ফ্লোরে আগুন লেগেছে, সেটাকে যদি আলাদা করে দেওয়া যেত, সেখান থেকে অন্য ফ্লোরে আগুন ছড়াতো না।

তাই অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থার শুরু হয় বিভক্তি দিয়ে। একটি স্থাপনাকে বিভিন্ন টুকরায় ভাগ করে ফেলা হয়। যে অংশগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কিংবা সংবেদনশীল, তাদেরকে আরও ছোট ছোট ভাগে ভাগ করা হয়। আবার যে অংশে আগুন লাগার সম্ভাবনা কম, সে অংশটি হয়ত বড় হতে পারে।

এরকম বিভক্তির মানে হলো, দুটো অংশের মধ্যে এমন পার্টিশন থাকবে, যাতে এক অংশ থেকে আরেক অংশে আগুন যাওয়ার উপায় না থাকে এবং পথ দ্রুত বন্ধ করার পদ্ধতি থাকে। যে অংশ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বা আগুন লাগার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, তার সঙ্গে অন্য অংশের পার্টিশন হবে আরও বেশি মজবুত ও অগ্নি প্রতিরোধক।

একটি ভবন, জাহাজ, কারখানা—যাই হোক না কেন, যেখানে যে ধরনের কাজ হবে, তার ভিত্তিতে তার অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থার নকশা বা পরিকল্পনা করা হবে। যেমন: যখন কোনো বহুতল ভবনে শুধু অফিস-আদালত থাকবে, তখন তার বিভক্তি তেমন না থাকলেও চলবে। কারণ, এসব কাজে আগুন লাগার ঝুঁকি কম। তারপরেও আগুন লাগলে যাতে ছড়িয়ে না যেতে পারে, তার জন্য ভবনটি বড় বড় কয়েকটি এলাকায় বিভক্ত করা হবে।

আবার যদি গার্মেন্টস হয়, কিংবা রেস্টুরেন্ট—তাহলে নকশা হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

যেমন: একটি ভবনের একটি ফ্লোরে কয়েকটি রেস্টুরেন্ট। সেখানে এমন ব্যবস্থা থাকবে যে প্রত্যেকটি আলাদা করে দেওয়া যাবে। যাতে এক রেস্টুরেন্টে আগুন লাগলে তা অপরটিতে ছড়াতে না পারে।  রেস্টুরেন্টে হয়ত কয়েকটা রুম রয়েছে। কিন্তু সেখানে আগুন লাগার সম্ভাবনা কম। তাই সবগুলো রুম এক জোনে থাকলেও সমস্যা নেই। কিন্তু, যে পাশে রান্নাঘর, যেখানে সবসময় আগুন জ্বলছে, চুলায় উত্তপ্ত কড়াইতে তেল ফুটছে—সেখানে আগুন লেগে যেতে পারে।

এ ক্ষেত্রে রান্নাঘরকে আলাদা করতে হবে, যাতে সেখানে আগুন লাগলে ছড়িয়ে না পড়ে। রান্নাঘরের চারদিকের দেয়াল ও দরজা এমন হতে হবে যে দরজা বন্ধ করে দিলে ভেতরে দীর্ঘক্ষণ আগুন জ্বললেও তা বাইরে আসবে না। রান্নার জন্য যে তেল মজুদ করা হয়, সেগুলো অবশ্যই আলাদা রুমে রাখতে হবে।

রান্নায় যদি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যাবহার করা হয়, তা একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে রাখতে হবে। যে পাইপ দিয়ে গ্যাস সরবরাহ হবে, তা অবশ্যই অনুমোদিত ও এসব কাজে ব্যবহারের জন্য প্রযোজ্য হতে হবে।

বহুতল ভবনের প্রতিটি ফ্লোর আবার বিভক্ত হতে হবে, যাতে এক ফ্লোর থেকে আগুন কোনো ভাবেই অন্য ফ্লোরে না যেতে পারে। এটা করা কোনো রকেট সাইন্স নয়। শুধু প্রতিটি সিঁড়ি থেকে ফ্লোরে ঢোকার জন্য ফায়ার-প্রুফ দরজা লাগাতে হবে, যা আগুন লাগলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়।

এসব বিভক্তির জন্য যেসব দেয়াল বা পার্টিশন দেওয়া হবে এবং তাতে যে ধরনের দরজা-জানালা থাকবে, তাদের নির্দিষ্ট সক্ষমতা থাকবে। কোনোটা হয়ত সাধারণ ভারী দরজা হলেই চলবে, আবার কোনো ক্ষেত্রে অগ্নি নিরোধক দরজা থাকতে হবে।

ফায়ার ডিটেকশন

কম্পার্টমেন্টেশন নকশা করার পর পরবর্তী ধাপ হলো ফায়ার ডিটেকশন।

আগুন লাগার প্রথম পর্যায়ে কিংবা লাগার মতো ঝুঁকি সৃষ্টি হলেই অ্যালার্ম বাজতে হবে। একটি এলাকায় কী ধরনের আগুন লাগতে পারে, সে হিসেবে এক বা একাধিক ডিটেকশন সিস্টেম থাকতে পারে। যেমন: গ্যাস সিলিন্ডার মজুদ করা কোনো রুমে যদি গ্যাস লিক হয়, তা আগুন লাগার পরিস্থিতি তৈরি করবে। এমন জায়গায় গ্যাস লিক হলে সেখানে বাতি জ্বালানোর জন্য সুইচ অন করলেই আগুন লাগতে পারে। তাই এখানে গ্যাস ডিটেক্টর লাগাতে হবে, যা গ্যাস লিক হলে অ্যালার্ম বাজিয়ে দেবে। তখন সেই রুমটিকে দরজা-জানালা খুলে ভেন্টিলেট করে আগে গ্যাস মুক্ত করতে হবে। এটা হলো প্রিভেন্টিভ ডিটেকশন।

সাধারণত গ্যাসের চুলার জন্য ফ্ল্যাশব্যাক এরেস্টের প্রয়োজন নেই, কিন্তু যখন এরকম বড় স্থাপনায় গ্যাসের প্রচুর ব্যাবহার হয় এবং অনেক বোতল সংরক্ষিত থাকে, তখন ফ্ল্যাশব্যাক এরেস্টর লাগানো প্রয়োজন। ফ্ল্যাশব্যাক এরেস্টর হলো এমন একটি ডিভাইস, যা চুলা থেকে আগুন উল্টো দিকে, মানে সিলিন্ডারের দিকে যেতে বাঁধা দেয়। তা না হলে দেখা যায়, চুলা থেকে আগুন উল্টো দিকে পরিবাহিত হয়ে গ্যাস সিলিন্ডারে চলে যায় এবং সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়।

এরপরে রয়েছে রিয়েক্টিভ ডিটেকশন—মানে, আগুন লেগে গেছে, কিন্তু সেখানে কোনো মানুষ না থাকলেও যাতে খবর পাওয়া যায়। সাধারণত হিট, ফ্লেম ও স্মোক ডিটেক্টর ব্যবহৃত হয়। তাপ একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে হিট ডিটেক্টর বেজে ওঠে। আগুনের শিখা দেখা গেলে ফ্লেম ডিটেক্টর, আর ধোঁয়ার সৃষ্টি হলে স্মোক ডিটেক্টর কাজ করে। কোন কম্পার্টমেন্টে কী ধরনের আগুনের সৃষ্টি হতে পারে তা অনুমান করে এসব ডিটেক্টর বসানো হয়।

অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থাপনা

অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা বলতে আমরা বুঝি ফায়ার এক্সটিংগুইশার এবং ফায়ার হোস। এগুলো অবশ্যই অগ্নি নির্বাপক, কিন্তু মোটেও সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা নয়।

শুরুতেই কম্পার্টমেন্টেশনের কথা উল্লেখ করেছি। আগুন লাগার পর প্রথম প্রতিরোধ ব্যবস্থা হচ্ছে, কম্পার্টমেন্ট সব আলাদা করে দেওয়া। যেসব ভবনে ফায়ার ডোর খোলা থাকে, তাতে অটোম্যাটিক ম্যাগনেটিক লক থাকতে হয়। ফায়ার অ্যালার্ম বাজার সঙ্গে সঙ্গেই এসব ম্যাগনেট রিলিজ হয়ে যায়, দরজা সব বন্ধ হয়ে যায়।

আগুন ত্রিভুজ বা ফায়ার ট্রায়াঙ্গল সম্বন্ধে আমরা সবাই জানি। আগুন লাগার জন্য প্রয়োজন হয় তাপ, জ্বালানি ও বাতাস বা অক্সিজেন। এই তিনটির যেকোনো একটি সরিয়ে নিলেই আগুন নিভে যাবে। সাধারণত কখনোই কোনো একটিকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে নেওয়া যায় না। তাই চেষ্টা করা হয়, যতটুকু সম্ভব সরিয়ে নেওয়ার।

জ্বালানি: আগুন লাগার পর জ্বালানি সরিয়ে নেওয়ার আর সুযোগ থাকে না। কারণ তখন জ্বালানিই জ্বলতে থাকে। তবে যদি এক কক্ষে আগুন লাগে এবং তার পাশের কক্ষে বা কাছের এলাকায় তেল, গ্যাসের মতো দাহ্য পদার্থ থাকে, তাহলে সম্ভব হলে সেগুলো দ্রুত সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

তাপ: সবচেয়ে উত্তম উপায় হচ্ছে তাপ সরিয়ে নেওয়া। আগুন লাগলে আমরা পানি দেই। সেটা তাপ সরিয়ে নেওয়ার জন্য। পানি একটা জ্বলন্ত কাঠকে ঠাণ্ডা করে দেয়, তাই সে আর জ্বলতে পারে না। অনেক অগ্নি নির্বাপক পদ্ধতি তাপ কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এ ছাড়া, যেসব অংশে আগুন এখনো লাগেনি, সেসব অংশে বাউন্ডারি কুলিং চলতে থাকে, যাতে আগেই তাপ কমিয়ে রাখা যায়।

বাতাস বা অক্সিজেন: আগুন নেভানোর সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো বাতাস বা অক্সিজেন সরিয়ে নেওয়া। আপাত দৃষ্টিতে ব্যাপারটা অসম্ভব মনে হলেও আধুনিক নকশায় নির্মিত কোনো স্থাপনায় এটা খুবই সহজ।  যদি কোনো একটি স্থাপনার সব ভেন্টিলেটর বন্ধ করে দেওয়া হয়, খুব স্বল্প সময়েই ভেতরের অক্সিজেন শেষ হয়ে আগুন নিভে যাবে। যেসব বড় স্থাপনায় আগুনের ঝুঁকি আছে, তা এমনভাবে ডিজাইন করতে হবে যাতে জরুরি অবস্থায় বায়ু প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া যায়। ভেন্টিলেশন ডাক্ট, শীতাতপ ব্যবস্থার ডাক্টসহ অন্য যেকোনো বাতাস প্রবাহের পথগুলো যাতে রিমোটলি বা দূর থেকে বন্ধ করা যায়—এমন ব্যবস্থা রাখতে হয়।

অগ্নি নির্বাপক বা ফায়ার এক্সটিংগুইশার

ফায়ার এক্সটিংগুইশারও সাধারণত তিনটি পদ্ধতিতে নির্বাপণ করে।

পানি ভর্তি এক্সটিংগুইশার তাপ সরিয়ে নেয় বা ঠাণ্ডা করে দেয়। তাতে আর আগুন জ্বলতে পারে না। ফায়ার হোস দিয়ে পানি মারা হয়, সেটাও একই পদ্ধতিতে কাজ করে।

এ ছাড়া, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় স্বয়ংক্রিয় স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে ট্যাংকের সঙ্গে সংযুক্ত একটি পানির পাইপ বিভিন্ন এলাকার সিলিংয়ে লাগানো থাকে। আগুন লাগলে তার তাপে এসব পাইপের নজেল খুলে যায়, ঝর্ণার মতো চারদিকে পানি নিক্ষিপ্ত হতে থাকে।

কেমিক্যাল এক্সটিংগুইশার কাজ করে একটু ভিন্নভাবে। জ্বালানির সঙ্গে অক্সিজেনের বিক্রিয়া তারা প্রতিহত করে। ফলে একই এক্সটিংগুইশার দিয়ে বিভিন্ন প্রকারের আগুন নেভানো যায়।

ফোম এক্সটিংগুইশার কাজ করে অক্সিজেন আর জ্বালানির মাঝে একটা দেয়ালের মতো। বিশেষ করে যেখানে তৈল জাতীয় পদার্থ থেকে আগুন সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে ফোম এক্সটিংগুইশার সবচেয়ে কার্যকরী।

ফোম এক্সটিংগুইশার ফেনা তৈরি করে তেলের ওপরে কম্বলের মতো একটি আবরণ ফেলে দেয়। ফলে অক্সিজেন আর জ্বালানির সংস্পর্শে আসতে পারে না। একইসঙ্গে সে তেলের তাপমাত্রা কমিয়ে দিতে সাহায্য করে।

বন্ধ কামরায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড এক্সটিংগুইশার খুবই কার্যকর। কোনো আগুন জ্বলার জন্য বাতাসে একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে অক্সিজেন থাকতে হয়। কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছড়িয়ে দেওয়া হলে বাতাসে অক্সিজেনের অনুপাত কমে যায়, তখন আগুন আর জ্বলতে পারে না। উল্লেখ্য, কার্বন-ডাই-অক্সাইড মানুষের জন্য বিষ। অর্থাৎ, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছড়িয়ে পরলে মানুষ দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে। তাই এমন জায়গায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করা যাবে না, যেখানে মানুষ রয়েছে। একটি সার্ভার রুম বা জেনারেটর রুমে আগুন লাগলে সেখানে দরজা-জানালা বন্ধ করে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছেড়ে দিলে নিমেষেই আগুন বন্ধ হয়ে যাবে।

কিছু বিশেষ জায়গায় অনেক ভিন্নধর্মী অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়। যেমন: বাণিজ্যিক রান্নাঘরে বড় কড়াইতে তেল উত্তপ্ত করা হয়। এসব তেল একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় পৌঁছে গেলে নিজে নিজেই আগুন লেগে যায়, পুরো কড়াই জ্বলতে থাকে। এসব রান্নাঘরে চুলার উপরে এক ধরনের পাইপ স্থায়ীভাবে লাগানো থাকে। যাতে আগুন লেগে গেলে একটু দূর থেকে একটি লিভার টেনে উপর থেকে কেমিক্যাল এক্সটিংগুইশ উপাদান, ফোম বা পাউডার ফেলা যায় এবং সহজে আগুন নেভে।

উপযুক্ত সরঞ্জাম থাকলে চুলার উপরের আগুন সহজেই নেভানো যায়। রান্নাঘরে 'ফায়ার ব্লাঙ্কেট' খুবই কার্যকর একটি সরঞ্জাম। যদি একটি মাত্র চুলায় ছোট আগুন লাগে, তখন এই বিশেষ কম্বল উপরে ছড়িয়ে দিলেই আগুন নিভে যায়। এতে যদি ব্যর্থ হয়, তখন উপরের পাইপ থেকে কেমিক্যাল চার্জ করা হলে একসঙ্গে পুরো চুলার আগুন নিভিয়ে দেয়।

এর বাইরে আগুন নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের জন্য অত্যাবশ্যকীয় হলো সবাইকে সতর্ক করা। এ জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়। কিন্তু সবচেয়ে প্রচলিত হলো 'ফায়ার অ্যালার্ম'। যেকোনো স্থাপনার বিভিন্ন স্থানে এসব লাগানো থাকে, যেন কেউ আগুন দেখলেই তাতে চাপ দিলে পুরো এলাকায় ফায়ার অ্যালার্ম বাজে।

আত্মরক্ষা

কোনো জনবহুল এলাকায় আগুন লাগলে অগ্রাধিকার দিতে হয় জীবন রক্ষার ব্যাপারে। আগুন একসঙ্গে পুরো একটি ফ্লোরে লাগে না। অবশ্যই কোনো একটি অংশে লেগে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পরে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, আগুন লাগার পর একটি এলাকা দিয়ে আর পালানোর উপায় থাকে না। এভাবে কোণঠাসা হয়েই অনেক মানুষ মারা যায়।

এ জন্য প্রত্যেকটি বড় স্থাপনায় ফায়ার এক্সিট বা বিকল্প সিঁড়ির ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিকল্প সিঁড়ি এমন হতে হবে যাতে একটি আরেকটির বিপরীতে হয়। যেমন: উত্তর দিকে আগুন লাগলে সেদিকের সিঁড়ি দিয়ে বের হওয়া অসম্ভব হয়ে যায়। তখন বিকল্প সিঁড়িটি হতে হবে দক্ষিণ দিকে।

এর বাইরেও ভবন এমনভাবে ডিজাইন করা যায়, যাতে জানালা দিয়ে বের হয়ে লাগোয়া কোনো কার্নিশে যাওয়া যায়। স্থপতিরা বাস্তবিক প্রয়োগের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্নভাবে আত্মরক্ষার জন্য সুবিধাজনক নকশা করে থাকেন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা

ঢাকা শহরে বঙ্গবাজার কিংবা চাঁদনীচকের মতো আপাত নিরীহ মার্কেটগুলো এবং ঘনবসতিপূর্ণ বসতিগুলো একেকটি মৃত্যুকূপ। একটি কাপড়ের দোকানে আগুন লাগলে তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। এসব জায়গায় দেখা যায়, আগুন লাগার প্রধান কারণ বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট। এমনকি রাতে যখন মার্কেটে কেউ থাকে না, তখনো শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগে।

প্রথম দিকে বলেছি, ট্যাংকারগুলো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এবং অতীতে অনেক অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে নানাবিধ কারণে। কিন্তু, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগার ঘটনা প্রায় বিরল। কিন্তু আমাদের দেশে বস্তি কিংবা ঘিঞ্জি মার্কেটে আগুন লাগার সবচেয়ে বড় কারণ শর্টসার্কিট এবং প্রেক্ষাপট দেখলে মনে হবে যে শর্টসার্কিট রোধ করা অসম্ভব।

কিন্তু আধুনিক কোনো স্থাপনার ক্ষেত্রে শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগাই প্রায় অসম্ভব।

নিম্নমানের বৈদ্যুতিক তার, অপেশাদার ওয়্যারিং, অপরিকল্পিত বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার এবং সর্বোপরি কোনো সেফটি ডিভাইস না থাকাই শর্টসার্কিটের বড় কারণ। এসব মার্কেটের প্যানেলে ইলেকট্রিক ফল্ট অ্যালার্ম থাকে না। যেকোনো ডিস্ট্রিবিউশন বোর্ডে ফল্ট অ্যালার্ম দেখার সুযোগ থাকলে এসব স্থাপনার শর্টসার্কিট থেকে উদ্ভূত আগুন শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব।

সচেতনতা

ট্যাংকারের মতো যেকোনো ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনায় সবচেয়ে বড় ঝুঁকি আগুন ও বিস্ফোরণ। বিগত অর্ধ শতাব্দীতে আগুন ও বিস্ফোরণের ঝুঁকি নির্মূল করার জন্য ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এসব পরিবর্তন একদিনে হয়নি, ধীরে ধীরে হয়েছে।

একেকটা দুর্ঘটনা সবাইকে নতুন শিক্ষা দিয়েছে। তবে প্রথম দিকে মালিকরা এসব সেফটি সিস্টেম প্রয়োগের ব্যাপারে খুবই গড়িমসি করতেন। এর বড় কারণ খরচ। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার যেকোনো প্রযুক্তির প্রয়োগ ছিল ব্যয়বহুল। তাই সবাই চেষ্টা করতো কোনোভাবে ন্যুনতম খরচে কাজ চালানোর জন্য।

কিন্তু ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারল যে সেফটি সিস্টেম ব্যয়বহুল হলেও অগ্নি দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি তারচেয়ে অনেক গুণ বেশি হয়।  কর্মস্থল নিরাপদ করা ব্যয়বহুল হলেও সার্বিকভাবে তা লাভজনক। এই মানসিকতা সৃষ্টি হতে উন্নত বিশ্বেরও সময় লেগেছে।

আমরা একটি গাড়ি মেরামতের পেছনে খরচ করতে অনেক সময় কৃপণতা করলেও ব্রেক ঠিক করতে কেউ দেরী করি না। কারণ, সবাই জানি যে ব্রেক ত্রুটিপূর্ণ থাকলে যে ক্ষতি হবে, তা মেরামতের খরচ থেকে বহুগুণ।

এক ঈদের আগে বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডের পর বলা হয়েছিল ৭০০-৮০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। হয়তো তিন হাজার দোকান ছিল। প্রতিটি দোকান যদি ২০ হাজার টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করত, তাহলে সব মিলিয়ে খরচ হতো ছয় কোটি টাকা। কিন্তু, তাতে রক্ষা পেত ৭০০-৮০০ কোটি টাকার সম্পদ। শুধু বঙ্গবাজার কিংবা বিএনপি বস্তি নয়, বড় বড় আধুনিক ভবন কিংবা ব্যবসা ক্ষেত্রে আধুনিক অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। এর বড় কারণ হচ্ছে নিরাপত্তার পেছনে পয়সা খরচে কৃপণতা। আর কৃপণতার পেছনে কারণ হলো সার্বিক লাভ-লোকসান হিসাব করার অক্ষমতা।

অগ্নি দুর্ঘটনা পরবর্তী চিত্র

বাংলাদেশে কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পরপর দুটো জিনিস হয়—প্রথমত টকশো এবং দ্বিতীয়ত সরকারি অভিযান।

টকশোগুলোতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো বাস্তবিক এবং প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা ছাড়া কতিপয় মানুষ এ সম্বন্ধে নানাবিধ বাস্তবতা বহির্ভূত মতবাদ দিতে থাকেন, মিডিয়া ট্রায়াল চলমান থাকে।

এরপর গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। কোনো প্রকার পেশাদার তদন্ত ছাড়াই আইন প্রয়োগ শুরু হয়ে অনেকটা মিডিয়া ট্রায়াল সামাল দেওয়ার জন্য।

যেকোনো দুর্ঘটনার পরপরই দেখা যায় ম্যানেজার ও কর্মচারী গ্রেপ্তার হয়েছে। তদন্তের আগে কীভাবে কারো বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেওয়া হয় তা অজানা। এরপর শুরু হয় 'সিলগালা প্রকল্প'। এরপর গঠিত হয় তদন্ত কমিশন, যার প্রতিবেদন তৈরি হতে হতে মানুষ এসব ভুলে যায়, আবার সবকিছু চলে আগের নিয়মে।

দুর্ঘটনা তদন্তের মূল লক্ষ্য হতে হয় রুট-কজ বা মূল কারণ বের করা। এরপর অন্তর্নিহিত কারণের পরিপ্রেক্ষিতে দোষী সাব্যস্ত করা। যেমন: ৮ বছরের একটি শিশু কিংবা রাতকানা একজন মানুষকে যদি সরকারি নিয়মে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার উপযুক্ত বিবেচনা করা হয়, তাহলে তার দ্বারা সংঘটিত কোনো এক্সিডেন্টে তাকে সম্পূর্ণ দায়ী করা যাবে না। যারা পরিণাম বিবেচনা না করে লাইসেন্স ইস্যু করেছে, তাদেরকেও কিছুটা দায়ভার নিতে হবে।

ঠিক একইভাবে কোনো বহুতল ভবনে ডজনখানেক রেস্টুরেন্টের অনুমতি দেওয়া হয়েছে অগ্নিঝুঁকি বিবেচনা না করেই। এ রকম দুর্ঘটনার কারণ কখনোই একজন বা কতিপয় ব্যক্তি নয়, এর জন্য দায়ী পুরো একটি সিস্টেম।

এ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের চেয়েও আগুন মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। যদি ব্যবহারকারীদের বুঝানো যায় যে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা তার জন্য লাভজনক, তাহলে এমনিতেই সে নিজ উদ্যোগে নিজেকে সুরক্ষিত করবে। সবার মানসিকতা হয়ত একদিনে পরিবর্তিত হবে না, তবে যদি নিজের লাভ বুঝে, তখন একজন আরেকজনের ওপর নজরদারী করবে।

এক দোকানদার যদি দেখে পাশের দোকানের জন্য তার দোকান ঝুঁকির মুখে, তাহলে সে নিজে থেকেই তাকে সংশোধনের চেষ্টা চালাবে। আর ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট সংস্থায় অভিযোগ করবে।

আগুন প্রতিরোধ কোনো রকেট সাইন্স নয়, দুর্বোধ্যও না। শুধু সঠিক ব্যবস্থা নিলেই সেটা সম্ভব।

আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ তেলবাহী আমেরিকান ঈগল ট্যাংকারের ক্যাপ্টেন

(লেখকের নোট: লেখাটি কোনো অ্যাকাডেমিক রিসার্চ পেপার নয়। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে নিতান্তই জনসচেতনতামূলক একটি লেখা। সহজ ও খুব সংক্ষিপ্তভাবে লেখা হয়েছে, যাতে ঘরবাড়ি, ছোট স্থাপনার ক্ষেত্রেও কাজে লাগে এবং সবার মাঝে আগুন সম্বন্ধে ধারনা সৃষ্টি হয়। কারো আরও বিস্তারিত জানার আগ্রহ থাকলে যোগাযোগ করতে পারেন [email protected] এই ইমেইলে।)

Comments

The Daily Star  | English

All educational institutions reopen after heatwave-induced closures

After several closures due to the heatwave sweeping the country, all primary and secondary schools, colleges, madrasas, and technical institutions across the country resumed classes today

38m ago