প্রতিদিনের খবর দুঃখজনক ও হতাশাব্যঞ্জক

ছবি: স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা নিয়ে আমরা গর্ব করে থাকি। সে গর্ব সঙ্গতও বটে। কিন্তু এখন তো ওই গৌরব অতীতের স্মৃতিমাত্র। সেখানে এমনসব ঘটনা ঘটে, যাতে মনে হয় পরিবেশটা শিক্ষিত মানুষদের বস্তিসদৃশ হবার দিকে নিরন্তর ধাবমান। কয়টা আর প্রকাশ হয়। বিশেষ করে ছাত্ররাজনীতির নৈরাজ্য তো আছেই!

সারাদেশে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে গৃহবিবাদ চলছেই। গৃহে গৃহে যেমন, তেমনি দলের ভেতরও। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের ভেতর বিরোধ ঘন ঘনই সংঘর্ষের চেহারা নেয়। দেশিয় অস্ত্রের ব্যবহার ঘটে। দেশিয় অস্ত্রের ব্যবহারটা তবু ভালো; জাতীয়তাবাদী তো বটেই, তুলনায় কম বিপজ্জনকও বৈকি। তরুণরা তো লড়তে চায়। প্রতিপক্ষ না পেলে কী করা যাবে, বাধ্য হয়ে নিজেদের মধ্যেই সংঘর্ষ বাধায়। জাতীয় নির্বাচনে যেমন প্রতিপক্ষের অনুপস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত নিজেদের দলের 'স্বতন্ত্রদের' বিরুদ্ধেই লড়তে হলো।

কিশোররা অসুবিধায় রয়েছে। কিশোরীদের সমস্যা দ্বিগুণ। তারা বাইরে বের হলেই অসুবিধায় পড়ে, ঘরের ভেতর আবদ্ধ থাকাটাও মোটেই সুখকর হয় না। ঢাকা শহরেরই এক পাড়ার তিন কিশোরী নিজেদের মধ্যে সলাপরামর্শ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল, নতুন জীবনের সন্ধানে কোরিয়ায় যাবে বলে। কোরিয়ার একটি 'শিল্পী' দল ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদির মাধ্যমে গানবাজনা দিয়ে ওই কিশোরীদের মুগ্ধ করে এবং দালালের পাল্লায় পড়ে ঘর থেকে কিছু টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে তারা বের হয়ে পড়েছিল মুক্তির সন্ধানে। মরুভূমিতে সেটা যে ছিল মরীচিকা, তা টের পাওয়ার আগেই অবশ্য পুলিশ তাদের উদ্ধার করেছে অভিভাবকদের নালিশের ভিত্তিতে।

খবরগুলো সবই দুঃখজনক ও হতাশাব্যঞ্জক। ভালো খবর কী নেই? অবশ্যই আছে। কিন্তু ভালো খবর তো খবর হয় না। বায়ু স্বাভাবিক রয়েছে এটা কোনো খবর নয়, বায়ু এমন দূষিত হয়ে পড়েছে যে, মানুষের পক্ষে সুস্থ থাকাটাই এখন অসম্ভব, এটা অবশ্যই খবর। ঢাকা শহর বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত, এটা ঐতিহাসিক এবং বর্তমানেও বাস্তবিক সত্য; সেই নদীর পানি স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে, এটা কোনো খবর নয়; কিন্তু ওই পানি দেখে এখন যে আলকাতরা বলে ভ্রম উৎপাদিত হবে, এটা তো খবর না হয়ে পারে না। অন্যায় আছে, প্রতিরোধ যে নেই তাও নয়, আছে; তবে তা কার্যকর নয় এবং ক্ষেত্র-বিশেষে এমনকী বিপজ্জনকও হয়ে পড়ে। যেমন: মুন্সিগঞ্জ জেলার এই ঘটনাটি। সেখানে মেয়েদের একটি স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলছিল; পাশের গ্রামের কয়েকটি ছেলে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করছে দেখে তিনজন স্থানীয় কিশোর প্রতিবাদ জানায়।

বাকবিতণ্ডা চলে। স্থানীয় লোকজন তাদের থামিয়ে যার যার যার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। পরের দিন প্রতিবাদকারীদের দুজন সরকারি বিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের কাছে বসে গল্প করছিল, এই সময়ে উত্ত্যক্তকারী (তারা আসলে একটি কিশোর গ্যাং-এর সদস্য) 'অপমানের' প্রতিশোধ নেবার মানসে ওই দুজনের ওপর হামলা চালায়। একজন পালিয়ে জান বাঁচাতে সক্ষম হলেও, অপরজন ব্যর্থ হয়। ছুরিকাঘাতে তাকে রক্তাক্ত করে কিশোর গ্যাং-এর সদস্যরা পাশের একটি খালে ফেলে দেয়। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই ছেলেটির মৃত্যু ঘটে। খালে হয়তো পানি ছিল না, তবে অন্তত লাশ ফেলার জন্য এখনো খাল কাজে লাগে দেখা যাচ্ছে। স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, কিশোর গ্যাংগুলোর অত্যাচারে তারা অতিষ্ঠ। ওই কিশোররা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-ফ্যাসাদ তো করেই, মানুষকে জ্বালাতন করাই তাদের প্রধান কাজ।

মূল ব্যাধিটা কী? সেটা এতোই সরল যে সহজে চোখে পড়ে না। পড়লেও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। মূল ব্যাধির নাম পুঁজিবাদ, বর্তমানে যা ফ্যাসিবাদের রূপ নিয়েছে। পুঁজিবাদ ছাড় দিতে, প্রতারণা করতে, ভয় ও লোভ দেখাতে, নিজেকে লুকিয়ে রাখতে এবং প্রচার মাধ্যমকে ব্যবহার করতে এতটাই দক্ষ যে, তাকে চেনা ভারি মুশকিল; সব শয়তানের সেরা সে, তার চেয়ে চতুর আর কেউ নেই। তাই ধরা পড়ে না।

সেদিন একটি আলোচনা সভায় সভ্যতার অগ্রগতির বিষয়ে কথা হচ্ছিল। প্রাজ্ঞ এক অধ্যাপক বললেন, ইতিহাসের চাকা কখনো থামবে না। ওই চাকা ঘুরতেই থাকবে। খুবই ভালো কথা; থমকে দাঁড়িয়ে পড়বার পাত্র অন্য যে-ই হোক, ইতিহাস অবশ্যই নয়। অধ্যাপক সাহেব বেশ সুন্দরভাবে বললেন, যদি দেখা যায় ইতিহাস পর্বতের শিখরে গিয়ে পৌঁছে গেছে, তবুও তার চাকা কিন্তু ঘুরতেই থাকবে। এরপর যদি ইতিহাস পাহাড়ের অপর দিকে বেয়ে নামতেও থাকে তবেও কিন্তু দেখা যাবে তার চাকা থেমে যায়নি। ঘুরছেই, ঘুরছেই।

আমরাও কিন্তু সে সত্য অমান্য করি না। ইতিহাসের চাকা এখন পর্বতশীর্ষে পৌঁছে গেছে ঠিকই, কিন্তু তার তো এগুবার আর পথ নেই, এবার তো তাকে নামতে হবে নিচের দিকেই। সেটা চলমানতা ঠিকই, কিন্তু অগ্রগমন নয়, অধঃপতন বটে। অধ্যাপক সাহেব বলতে ভুলে গেলেন যে, সভ্যতা বলি কী পুঁজিবাদই বলি কারও জন্যই উপরে ওঠার আর কোনো উপায় নেই, পাহাড়ের উপরে উঠে স্থির হয়ে যে দাঁড়িয়ে থাকবে সেটাও সম্ভব নয়, চাকা এখন তাকে নিচের দিকে নিয়ে যাবে এবং সেটা ঘটবে এমন দুর্বার গতিতে যে, যাত্রীরা হয়তো ছিটকে পড়ে মারাই যাবে।

ওই আলোচনা সভাতেই অপর একজন প্রাজ্ঞ অধ্যাপক বললেন, ভরসা এখন রাষ্ট্রের ওপরই। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রসমূহের সংঘ যাকে তিনি জাতিসংঘ না বলে রাষ্ট্রসংঘ বলার পক্ষপাতী, ভরসা নাকি ওই রাষ্ট্রসংঘই। অথচ বাস্তব সত্য হলো এই যে, রাষ্ট্র হচ্ছে রাষ্ট্রের যারা কর্তা তাদের হাতে বাদ-বাকিদের শোষণ করবার শক্তিশালী যন্ত্র ছাড়া অন্যকিছু নয়। ওই কাজের বাইরে রাষ্ট্র যা করে তা হলো মূল কাজকে অক্ষুণ্ণ রেখেই শুধু নয়, অক্ষুণ্ণ রাখবার প্রয়োজনেই। রাষ্ট্র নয়, নির্ভর করতে হবে সমাজের ওপর এবং সেই সমাজ যদি পিতৃতান্ত্রিক হয় তাহলেও কুলাবে না, তাকে হতে হবে গণতান্ত্রিক এবং এগিয়ে যেতে হবে সমাজতান্ত্রিকতার অভিমুখে।

উন্নতিটা পর্বতের মতো হবে না, হবে নদীর মতো। রাষ্ট্রের চরিত্রকে না বুঝলে, তাকে ভুলভাবে তুলে ধরলে এবং অধঃপতনকে উন্নতির প্রমাণ বলে প্রচার করলে, মানুষকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামীই করা হবে। জলবায়ু বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী মানুষেরা আন্তর্জাতিক সম্মেলন স্থলে সমবেত হয়ে যেভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন তা আশাবাদী অবশ্যই। ব্যবস্থাটা যে পুঁজিবাদ তাও তারা বলেন, কিন্তু পুঁজিবাদের বিকল্প যে সমাজতন্ত্র সেটা বলেন না। গ্রিন পার্টি ধরিত্রীকে সবুজ রাখতে চায়, কিন্তু রাখতে হলে পুঁজিবাদের অগ্নি-উদ্গীরণ থামিয়ে সমাজতন্ত্রের মুক্ত প্রবাহ সম্ভব করে তোলা যে আবশ্যক, সেই উপলব্ধি পর্যন্ত অগ্রসর হয় না। ফলে পথজ্ঞানটা পরিষ্কার থাকে না।

Comments

The Daily Star  | English

Once a lifeline, Labondaho now a curse

Abdul Aziz once harvested rice in abundance from his fields next to Labondaho, once a picturesque river located in Indrapur, Gazipur’s Sreepur. Today, he stands on cracked earth, nursing losses and lamenting poisoned waters.

14h ago