কেন বাংলা একাডেমিতে ২৫ বছর নির্বাচন হয় না

ইলাস্ট্রেশন: সালমান সাকিব শাহরিয়ার

যে উদ্দেশ্যে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল আমলাতন্ত্রের বেড়াজালে তা এখন প্রশ্নের মুখে। বই প্রকাশে রাজনৈতিক স্বার্থ ব্যবহার, পুরস্কারে ব্যক্তিগত সম্পর্কের অভিযোগ, জনবল ও আর্থিক সংকট যেমন আছে- তেমনি স্বায়ত্বশাসিত হওয়ার কথা থাকলেও মূলত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে সাধারণ একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

অন্যদিকে দীর্ঘদিন বাংলা একাডেমি চলছে নির্বাহী পরিষদ পদাধিকারবলের ও মনোনীত সদস্যদের দিয়ে। ফেলো ও সাধারণ পরিষদের মাধ্যমে নির্বাহী পরিষদ গঠনে আইন থাকলেও ২৫ বছর ধরে নির্বাচনই হয় না। ফলে একাডেমিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা-পরামর্শ, বার্ষিক প্রতিবেদন অনুমোদনসহ নির্বাহী পরিষদের কাজ গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে হচ্ছে না এবং এর মাঝে নানান অনিয়মের সুযোগ বাড়ছে।

বাংলা একাডেমির তথ্যমতে, নির্বাহী পরিষদের সবশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। তবে বাংলা একাডেমি আইন (২০১৩) অনুযায়ী, এই নির্বাচন ৩ বছর পরপর হলে সে হিসেবে এই পর্যন্ত ৮টি নির্বাচন হওয়ার কথা।

বাংলা একাডেমি আইনের ২৩ নম্বর ধারাটি নির্বাহী পরিষদ বিষয়ে। এর ১ নম্বর উপধারা অনুযায়ী, মোট ১৯ সদস্য নিয়ে নির্বাহী পরিষদ গঠিত-পরিচালিত হবে। ৩ নম্বর উপধারায় আছে, নির্বাচিত সদস্যরা নির্বাচিত হওয়ার পর অনুষ্ঠিত নির্বাহী পরিষদের প্রথম সভার তারিখ হতে ৩ বছর মেয়াদের জন্য পরিষদের সদস্য হবেন। তাঁরা দুই মেয়াদের বেশি সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হতে পারবেন না।

নিয়ম অনুযায়ী, নির্বাচনের মাধ্যমে একাডেমির ফেলোরা ৩জন ফেলো ও সাধারণ পরিষদের সদস্যরা ৪জনকে নির্বাচিত করবেন। এই ৭জনই নির্বাহী পরিষদের নির্বাচিত সদস্য। কিন্তু এই ৭ নির্বাচিত সদস্য না থাকায় অনেক দিন ধরে নির্বাহী পরিষদ চলছে শুধু পদাধিকারবলের ও মনোনীত ১২ সদস্য দিয়ে। এই ১২ জনের মধ্যে দুজন পদাধিকারবলের সদস্য। ২জন নির্বাহী পরিষদ মনোনীত সদস্য। আর ৮জন সরকার মনোনীত সদস্য। অনেক দিন ধরে এই ১২ জনই নির্বাহী পরিষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন।

বাংলা একাডেমি আইনে নির্বাহী পরিষদের কার্যাবলির উল্লেখ আছে। এগুলো হলো একাডেমিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও পরামর্শ প্রদান। একাডেমির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রয়োজনে নীতিনির্ধারণ। সাহিত্য, সংস্কৃতি, গবেষণা ও প্রযুক্তিসংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ। বার্ষিক প্রতিবেদন অনুমোদন। সরকার বা সাধারণ পরিষদ প্রদত্ত অন্য কোনো দায়িত্ব পালন। ২ নম্বর উপধারায় বলা আছে, নির্বাহী পরিষদ তার কার্যাবলির জন্য সাধারণ পরিষদের কাছে দায়ী থাকবে।

এরশাদ পতনের পর সবাই প্রতিশ্রুতি দিলেও কেউ যথাযথ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রাখেনি। তাই তারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমলাতান্ত্রিক করে তুলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির নির্বাচন হয় কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। তেমনি বাংলা একাডেমিতে কর্মচারীদের নির্বাচন হলেও ফেলো সদস্যদের নির্বাচন দেওয়া হয় না। কারণ তাদের  বক্তব্য বা মতামতকে ভয় পায় সরকার।

২০২৩ সালের ২৮ জানুয়ারি কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার বাংলা একাডেমির পুরস্কার ফেরত পাঠান। কারণ বলেছিলেন, প্রতিষ্ঠানের গণতন্ত্রহীনতা, আমলাতান্ত্রিকতা, দুই দশকের বেশি সময় ধরে নির্বাহী পরিষদের নির্বাচন না করে ইচ্ছেমতো একাডেমি চালানোর জন্য প্রতিষ্ঠানটি গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।'

১৯৯৯ সালে বাংলা একাডেমি নির্বাচনে অংশ নেওয়া অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, বাংলা একাডেমি একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শুরু হয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তার চরিত্র নষ্ট করে দিয়েছে সরকার। বিশেষ করে এরশাদ পতনের পর সবাই প্রতিশ্রুতি দিলেও কেউ যথাযথ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রাখেনি। তাই তারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমলাতান্ত্রিক করে তুলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির নির্বাচন হয় কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। তেমনি বাংলা একাডেমিতে কর্মচারীদের নির্বাচন হলেও ফেলো সদস্যদের নির্বাচন দেওয়া হয় না। কারণ তাদের  বক্তব্য বা মতামতকে ভয় পায় সরকার। সরকার এমন প্রতিষ্ঠানগুলো পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলা একাডেমিসহ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আবশ্যক।

এই বছরের শুরুতে প্রথম আলোকে এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেছিলেন, তিনি ২০২১ সালে একাডেমিতে আসার পরই নির্বাচনের প্রস্তাব দেন। নির্বাচনের নীতিমালার খসড়া করে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় নির্বাচনের বিধিমালা তৈরির জন্য কমিটি গঠন করেছে।

তার পরে কি হয়েছে জানতে চাইলে ডেইলি স্টারকে সাবেক এই মহাপরিচালক বলেন, নির্বাচন হয়ে যাওয়ার কথা। বিধিমালা তৈরি করে যেহেতু একাডেমি দিয়েছেন মন্ত্রণালয়কে, এখন খুব বেশি কাজ নেই। কেবল সমন্বয় করে বাস্তবায়ন করার পালা।

একাডেমি জীবন সদস্য, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহমেদ মাওলা বলেন, বাংলা একাডেমি জাতীয় মননের প্রতীক। গত স্বৈরাচারের আমলেও নির্বাচন ছাড়া নির্বাহী পরিষদ গঠিত হয়েছে। ভোটাধিকার থেকে আমরা বঞ্চিত। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার বিজয়ের পরে একইভাবে নির্বাহী পরিষদ গঠিত হবে? আমরা বৈষম্যহীন সমাজ ও দেশ গড়ার কাজে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রচেষ্টা বাংলা একাডেমিতেও দেখতে চাই।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম বলেন, আমাদের পরিকল্পনা আছে নির্বাচন দেওয়ার। এই বছর হয়তো হবে না। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির পরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে, সেভাবে আলাপ চলছে।

সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. আতাউর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, কেন  নির্বাচন হয়নি বিষয়টি আমি ভালো করে জানি না। বাংলা একাডেমি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, তারা চাইলে এসব কাজ করতে পারে, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের  কোন বাঁধা নেই।

ভারপ্রাপ্ত এই সচিবকে প্রশ্ন করা হয়, বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাউকে না কাউকে প্রায় অতিথি হতে দেখা যায়, এটা নিয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা আছে? জবাবে বলেন, বাংলা একাডেমি যে কোনো অনুষ্ঠান তার নিজের মতো করে করতে পারে। কাকে রাখবে কাকে রাখবে না তা তাদের নিজস্ব বিষয়। তবু তারা ডাকলে আমরা না করতে পারি না। তবে অনুষ্ঠানে মন্ত্রণালয়ের সরাসরি সহযোগিতা থাকলে একজন প্রতিনিধি রাখতে পারে।

Comments

The Daily Star  | English

Choking waters: The dangerous decline of oxygen in Dhaka’s peripheral rivers

Bangladesh, often described as a land of rivers, is criss-crossed by more than 230 major and minor waterways.

16h ago