কেন আবু সাঈদকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হলো?

কেবলমাত্র অহমিকা ও নিশ্চিত দায়মুক্তি ছাড়া আর কোনোভাবেই এই হত্যাকাণ্ডকে ন্যায্যতা দেওয়া সম্ভব না।

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে কেন গুলি করে হত্যা করল পুলিশ? তিনি সেখানে একা দাঁড়িয়ে ছিলেন; দুই হাত প্রসারিত করে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার হাতে ছিল কেবল একটি লাঠি, কোনো অস্ত্র নয়।

তিনি কোনো সহিংস কর্মকাণ্ডেও জড়িত ছিলেন না। যে মুহূর্তে তাকে গুলি করা হয়েছে, তখন তিনি পুলিশের জন্য হুমকিও ছিলেন না এবং পুলিশের থেকে বেশ দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন—আনুমানিক ৫০-৬০ ফুট দূরত্বে।

তারপরও পুলিশ তাকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে।

এর আগে আমরা দেখেছি, পুলিশ কীভাবে সহনশীলতার পরিচয় দিচ্ছে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বেশ কয়েকবার দিয়েছেন। তিনি বারবার দাবি করেছেন যে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কোনো সহিংসতায় না জড়াতে এবং বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে এমন কিছু না করতে যাতে কোনো ধরনের সহিংসতা হতে পারে।

তারপরও পুলিশ একজন নিরস্ত্র শিক্ষার্থীকে গুলি করলো, যে কিনা নিজের মতো দাঁড়িয়েছিল কারো প্রতি হুমকি তৈরি না করে।

অত্যন্ত দরিদ্র বাবা-মায়ের নয় সন্তানের একজন ছিলেন সাঈদ। নয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ ও মেধাবী। পরিবারের মধ্যে প্রথম কোনো ব্যক্তি হিসেবে যখন তিনি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হন, তার ভাইবোনরা এতই উচ্ছ্বসিত ছিলেন যে নিজেদের পড়াশোনার খরচ থেকে বাঁচিয়েও আবু সাঈদের পড়াশোনার খরচের ব্যবস্থা করতেন।

তার বৃদ্ধ ও অসুস্থ বাবা জানান, আশা ছিল আবু সাঈদ সরকারি চাকরি পেলে তাদের পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। এটাই আবু সাঈদের  জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। এই কারণেই তিনি কোটা সংস্কারের দাবি জানাচ্ছিলেন এবং এই আন্দোলনে যোগ দেন।

তার বাবার কথা থেকে এটা স্পষ্ট যে কেবলমাত্র কোটা পদ্ধতি সংস্কার করার জন্যই আবু সাঈদ আন্দোলন করেছেন, যাতে তার ও তার মতো আরও অনেক শিক্ষার্থীর মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে, এমন কোনো উদ্দেশ্য তার ছিল না।

দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আবু সাঈদকে হত্যার আগের দিন সোমবার দুপুর ১২টা ৩৭ মিনিটে তিনি শহীদ অধ্যাপক শামসুজ্জোহার উক্তি নিয়ে একটি ফটো কার্ড শেয়ার করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই তরুণ শিক্ষক ১৯৬৯ সালে ছাত্র আন্দোলনকারীদের রক্ষা করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।

আবু সাঈদ তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, 'স্যার, এই মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার স্যার! আপনার সমসাময়িক সময়ে যারা ছিল সবাই তো মরে গেছে, কিন্তু আপনি মরেও অমর। আপনার সমাধি, আমাদের প্রেরণা। আপনার চেতনায় আমরা উদ্ভাসিত।'

অধ্যাপক শামসুজ্জোহা আমাদের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নায়ক হয়ে ওঠেন। এই মানুষটি স্বাধীনতা পরবর্তী পাঁচ দশক ধরে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছেন।

আবু সাঈদকে শটগান দিয়ে গুলি করে মারা হয়। তার মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে, কিন্তু তার প্রতিবেদন এখনও প্রকাশ করা হয়নি। এরই মধ্যে তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে।

আন্দোলনের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে এর জন্য সম্ভবত সময় লাগবে। আমরা অবিলম্বে আবু সাঈদ হত্যার পৃথক তদন্ত এবং দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করছি।

আন্দোলনে বা বিক্ষোভে কাউকে হত্যা করার ঘটনা এই প্রথম ঘটলো না। কিন্তু এমন হত্যাকাণ্ড—যেখানে নিরস্ত্র মানুষটিকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে হত্যা করা হলো—সম্পূর্ণ নতুন আমাদের জন্য। এ জন্য অবিলম্বে এর তদন্ত প্রয়োজন।

কেবলমাত্র অহমিকা ও নিশ্চিত দায়মুক্তি ছাড়া আর কোনোভাবেই এই হত্যাকাণ্ডকে ন্যায্যতা দেওয়া সম্ভব না—যেটা পুলিশ বছরের পর বছর ধরে উপভোগ করছে।

সেইসঙ্গে আবু সাঈদের পরিবারের কাছে পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইলে তাদের ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত হতে পারে।

Comments