জনআস্থা ফেরাতে যুগোপযোগী পুলিশ অধ্যাদেশ প্রণয়ন একান্ত জরুরি

খসড়া পুলিশ অধ্যাদেশ ২০০৭ এর যে ধারাগুলো সরকার কাঠামো এবং জনস্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সেসব ধারা পরিবর্তন কিংবা পরিমার্জন অথবা উভয়ই সম্পন্ন করে যুগোপযোগী ও যথোপযুক্ত একটি পুলিশ অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুত এবং সেটি প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ একান্ত জরুরি।
ছবি: সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে ৫ আগস্ট 'মার্চ টু ঢাকা' শিরোনামের এক গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই সমাচারটি ওই দিন বিকেলে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দেশবাসীকে অবহিত করেন। প্রেক্ষাপট দ্রুত পালটে যায়। এরপর সরকারের দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গী অঘটনপটিয়সী পুলিশ সদস্যরা জনরোষের কবলে পড়েন। তারা বিভিন্ন স্থানে হামলা, আক্রমণ ও হত্যার শিকার হন। অসংখ্য থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অস্ত্র লুট করা হয়েছে।

এসবের ফলে পুলিশের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছিল। নন-ক্যাডার পুলিশ সদস্যরা আঙুল তুলেছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দিকে। কর্তৃত্ববাদী সরকারের অন্যায্য উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ এবং এদের শাসনের ডানা নির্ভার রাখাটাই তাদের প্রধান কাজ ছিল। সেভাবেই সরকারের একটি গোষ্ঠী পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রমোশন, পদায়ন ও বদলির বিষয়টি সম্পন্ন করত—যা সংশ্লিষ্ট মহলে 'দরগা' নামে পরিচিত। সম্প্রতি পুলিশ সদস্যরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেনের কাছে ১১ দফা দাবি পেশ করেন।

বিস্ময়কর বিষয় হলো—প্রতিটি সরকারই বিরোধী দল এবং ভিন্নমত দমনে অসংখ্য আইন প্রণয়ন ও সংশোধন করেছে। অথচ পুলিশ পরিচালিত হচ্ছে ১৮৬১ সালে প্রণীত আইন অনুযায়ী। এই আইনটি ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৭ সালের 'সিপাহী বিপ্লব'র পরিপ্রেক্ষিতে প্রণয়ন করেছিল। মঙ্গল পাণ্ডে নামে একজন সিপাহী তার কমান্ডিং অফিসারকে একটি প্রশ্ন করেছিলেন। কমান্ডিং অফিসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করেন। সিপাহী বিপ্লবের সূচনা ঘটেছে সেখানেই। ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় জনগণের ওপর অন্যায্য ও নির্দয়ভাবে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে শাসন ও শোষণ নির্বিঘ্ন রাখতেই পুলিশ অ্যাক্ট ১৮৬১ প্রণয়ন করেছিল। মূলত এই আইনটি ছিল বাংলায় মুঘল শাসনব্যবস্থা থেকে ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় উত্তরণের চূড়ান্ত পদক্ষেপ। আইনটি প্রণয়নের পর থেকেই প্রতিটি সরকার পুলিশকে তার পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে।

ওয়ান-ইলাভেনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৮৬১ সালে প্রণীত পুলিশ আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২০০৭ সালের মার্চ থেকে পুলিশ রিফর্ম প্রজেক্টের (পিআরপি) সহায়তায় প্রস্তাবিত পুলিশ অর্ডিন্যান্স ২০০৭ এর খসড়া প্রস্তুত করা হয়। প্রস্তাবিত খসড়ায় মোট ১৫টি অধ্যায়, ১৬৩টি ধারা ও পাঁচটি তফসিল রয়েছে। অধ্যাদেশের খসড়া প্রণয়ন কমিটির ১৫ জন সদস্যের ১২ জনই ছিলেন পুলিশ বিভাগের। এই অধ্যাদেশে ১৮৬১ সালের আইনের সীমাবদ্ধতার নিরিখে কী কী সংস্কার প্রয়োজন তার সুপারিশ করা হয়েছে।

ব্রিটিশ রাজত্বে ভারতের জনগণ ছিলেন প্রজা আর পাকিস্তানিদের কাছ থেকে মুক্ত হয়ে এদেশের মানুষ প্রজা থেকে নাগরিক হয়েছে। ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানের ৭ (১) নম্বর অনুচ্ছেদে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে, 'প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ'। অথচ স্বাধীন দেশের পুলিশ পরিচালিত হচ্ছে ১৬৩ বছর পূর্বের ঔপনিবেশিক আইন দ্বারা। এভাবেই প্রতিটি সরকার পুলিশকে দলীয় ও রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে। পুলিশ 'দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন' নয়, বরং দুষ্টকেই সহায়তা করেছে। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে ব্যবহৃত পুলিশ বাহিনী একান্তভাবেই সরকারের অনুকম্পাপ্রত্যাশী এক সংস্থায় পরিণত হয়েছে।

প্রস্তাবিত পুলিশ অধ্যাদেশ ২০০৭ এ ব্রিটিশ সরকার প্রণীত আইনের ১০টি অসঙ্গতি উল্লেখ করা হয়েছে এবং পূর্বে প্রণীত আইন থেকে পুলিশ বাহিনীকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনার লক্ষ্যে ১৩টি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রাখা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, পুলিশ হবে পেশাদারিত্বসম্পন্ন, জনবান্ধব, সেবাধর্মী ও সকল অবৈধ প্রভাবমুক্ত একটি সংস্থা। সরকার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের আইনানুগ নিয়ন্ত্রণাধীনে পুলিশ বাহিনী পরিচালিত হবে। সরকার অথবা কোনো ব্যক্তি পুলিশকে আইন-বহির্ভূত কোনো কাজের নির্দেশ দিতে পারবে না। জনগণের সব গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও এর যথাযথ সংরক্ষণ পুলিশের জন্য বাধ্যতামূলক। সমাজের দুর্বল গোষ্ঠী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, নারী ও শিশুর অধিকার রক্ষাসহ এদের প্রতি যেকোনো অপরাধমূলক আচরণ প্রতিরোধে পুলিশকে অধিকতর মনোযোগী ও বিশেষভাবে সচেতন থাকার নির্দেশ রয়েছে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশ।

পুলিশ ফোর্সের পরিবর্তে হবে পুলিশ সার্ভিস। পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) অভিধা হবে পুলিশ প্রধান। জাতীয় পুলিশ কমিশন হবে ১১ সদস্যের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন এই কমিশনের চেয়ারম্যান। সরকার ও বিরোধীদলের দুইজন করে চারজন সংসদ সদস্য, সুশীল সমাজের তিনজন প্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে কর্মরত একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশ প্রধান এই কমিশনের সদস্য থাকবেন। কমিশন পুলিশ প্রধানকে নিয়োগ দেবে। সরকার নির্দিষ্ট মেয়াদের পূর্বে কমিশনের সম্মতি ছাড়া পুলিশ প্রধানকে অপসারিত অথবা অন্যত্র পদায়ন করতে পারবে না। প্রস্তাবিত আইনে জ্যেষ্ঠতা, মেধা, সততা, নিষ্ঠা, প্রশিক্ষণ ও কর্ম দক্ষতা বিবেচনা করে নম্বরভিত্তিক মেধা তালিকা প্রণয়নপূর্বক পুলিশ কর্মকর্তাদের উচ্চপদে পদোন্নতির বিধান রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের ৮৩ ধারায় অপরাধের সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের শাস্তি দেওয়ার জন্য পুলিশ ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান রয়েছে এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখার জন্য ৮২ ধারায় 'কোড অব কন্ডাক্ট' অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

প্রস্তাবিত অধ্যাদেশটির মাধ্যমে পুলিশ সরকার কাঠামোর বাইরে থেকে যাচ্ছে। অধ্যাদেশের অসংখ্য ধারায় সরকারকেই পুলিশ প্রধানের সঙ্গে পরামর্শ করে নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। সরকার ও পুলিশ প্রধানের মধ্যে দ্বিমত সৃষ্টি হলে পুলিশ কমিশনের সিদ্ধান্তই কার্যকর হবে। সরকারের সার্বিক কাজ রাষ্ট্র পরিচালনা করা আর পুলিশের কাজ জনগণের জীবন ও সম্পদ হেফাজত করা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সমুন্নত রাখা। সরকারকে কেন পুলিশ প্রধানের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে? বিষয়টি বোধগম্য নয়। এই ধারাগুলো রুলস অব বিজনেস ১৯৯৬ এর অ্যালোকেশন অব বিজনেসে (রুল-৩) তফসিল বর্ণিত কার্যপদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এমনকি ৭ (৩) ধারায় স্বরাষ্ট্র সচিবের সব ক্ষমতা পুলিশ প্রধানের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে।

জাতীয় পুলিশ কমিশনে মধ্যবিত্ত ও শ্রমিক শ্রেণির কোনো প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়নি। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা পুলিশ সুপারের সম্পর্কের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। অধ্যাদেশের ৮২ ধারা অনুযায়ী বলা হয়েছে, দণ্ডবিধি ২৬৮-২৯৪ ধারার অপরাধের বিচার এসপি অথবা এএসপি করতে পারবেন। অথচ পুলিশের কাজ অভিযুক্তকে শনাক্ত করা। অভিযুক্তের বিচার করা নয়।

অধ্যাদেশে বলা হয়েছে পুলিশ গুরুতর অপরাধ করলে সাধারণ মানুষ পুলিশ কমপ্লেইনস কমিশনে অভিযোগ করতে পারবে। তবে অভিযোগ তদন্তের যে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বয়ান রয়েছে, তাতে পুলিশের অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাবে এবং সাধারণ মানুষ সুবিচার পাবে না। এই অধ্যাদেশের ১৪৪ ও ১৪৫ ধারায় বলা হয়েছে, সরল বিশ্বাসে কর্তব্য সম্পাদনের কারণে কোনো পুলিশ অফিসার দণ্ডিত হবেন না এবং তার বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। সরল বিশ্বাসের বিষয়টি সাত বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। এই ধারা দুটিতে দায় মোচনের বিষয়টি সুস্পষ্ট। এ রকম অসংখ্য সামঞ্জস্যহীন ও অযৌক্তিক ধারায় সন্নিবেশিত অধ্যাদেশটি।

২০০৭ এর খসড়া অধ্যাদেশে স্বাধীনতার নামে পুলিশকে অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অধ্যাদেশের খসড়া প্রণয়নের পরে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন সরাসরি এর বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। পুলিশের বিভাগীয় কর্মকর্তারা অধ্যাদেশের অসঙ্গতিগুলো নির্দিষ্ট করে দেখিয়ে দেন। সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এসব কারণেই অধ্যাদেশটি আলোকিত অন্ধকার হয়ে রয়ে গেছে। তবে মন্দের ভালো যে, একটি অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুত রয়েছে।

খসড়া পুলিশ অধ্যাদেশ ২০০৭ এর যে ধারাগুলো সরকার কাঠামো এবং জনস্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সেসব ধারা পরিবর্তন কিংবা পরিমার্জন অথবা উভয়ই সম্পন্ন করে যুগোপযোগী ও যথোপযুক্ত একটি পুলিশ অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুত এবং সেটি প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ একান্ত জরুরি। কেননা কোনো রাজনৈতিক সরকার কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রবহমান রাখার প্রয়োজনে এমন আইন কখনো প্রণয়ন করবে না। এই মহৎ কর্মযজ্ঞটি রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই সম্পাদন করতে হবে।

ডক্টর সৈয়দা আইরিন জামান: নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কলামিস্ট

[email protected]

Comments