সংবিধান পুনর্লিখনের প্রয়োজন কী ও ম্যান্ডেট কার

নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তারা সংবিধান সংশোধনের কিছু মৌলিক বিষয়ে একমত হবে এবং সবার মতামতের ভিত্তিতেই সেই পরিবর্তনগুলো আসবে—এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করা জরুরি।

কয়েক দিন ধরেই সংবিধান পুনর্লিখন বা নতুন করে লেখার বিষয়টি নিয়ে অ্যাকাডেমিক পরিসরে আলোচনা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো—

১. সংবিধান কি চাইলেই নতুন করে লেখা যায়?

২. মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পরে গণপরিষদে যে সংবিধান রচনা করা হয়েছিল, সেই সংবিধান এখন পুনর্লিখনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে কেন?

৩. দেশের মানুষ কি মনে করে যে সংবিধান নতুন করে লেখা প্রয়োজন?

৪. সংবিধানের ঠিক কোথায় কোথায় পরিবর্তন প্রয়োজন এবং সেই পরিবর্তন বা সংশোধনের জন্য কি গণপরিষদ গঠন জরুরি?

৫. জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সংসদেই কি সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা সম্ভব নয়?

৬. যে সংবিধানের আলোকে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নিয়েছে, সেই সরকার কি সংবিধান পুনর্লিখন করতে পারে?

অন্তর্বর্তী সরকার কী শপথ নিয়েছে?

গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তারা বিদ্যমান সংবিধানের আলোকেই শপথ নিয়েছেন।

বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্বর্তী, মধ্যবর্তী কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিধান না থাকলেও রাষ্ট্রের জরুরি প্রয়োজনে (স্টেট নেসেসিটি) এরকম একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যায় বলে সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজ্ঞ এমনকি সর্বোচ্চ আদালতও স্বীকৃতি দিয়েছেন। যদিও ভবিষ্যতে কেউ এই সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা প্রশ্ন তুলবেন কি না, তা এখনই বলা কঠিন। সেটি অন্য প্রশ্ন।

অন্তর্বর্তী সরকার বলে কোনো বিধান যেহেতু সংবিধানে নেই, তাই এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টারা প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের জন্য নির্ধারিত শপথবাক্য পাঠ করেছেন। যেমন তারা শপথে বলেছেন: 'আমি সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা) করিতেছি যে, আমি আইন অনুযায়ী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টা পদের কর্তব্য বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব; আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব; আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান করিব। (তৃতীয় তফসিল, ১৪৮ অনুচ্ছেদ)।' তার মানে তারা প্রত্যেকে বিদ্যমান সংবিধান রক্ষারই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

গণপরিষদ বিতর্ক

১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ববঙ্গের (পূর্ব পাকিস্তান যেটি পরবর্তীতে বাংলাদেশে) বিজয়ী জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যরা পাকিস্তানের সংবিধানের আলোকে শপথ নেননি। বরং তারা নতুন করে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং তার আলোকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সংবিধান লিখেছিলেন। এই ম্যান্ডেট তাদের ছিল। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকার যে সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়েছেন এবং যে সংবিধান রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ—তারা কী করে এই সংবিধান নতুন করে লেখার কথা বলেন? সরকারের তরফে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলা না হলেও সরকারের নীতিনির্ধারক ও থিংকট্যাংকদের কেউ কেউ এ নিয়ে কথা বলা শুরু করেছেন। এই তর্কটা প্রয়োজনীয়ও বটে।

প্রথমে কী সংশোধন করতে হবে?

প্রশ্ন হলো সংবিধানের ঠিক কোথায় কোথায় পরিবর্তন প্রয়োজন? ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় বাহাত্তরের মূল সংবিধানের মূলনীতিসহ আরও অনেক অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনা হলেও নতুন অনেক কিছু যুক্ত করা হয়। যেমন: ৭ (ক) অনুচ্ছেদ যুক্ত করে সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশ (৫০টির বেশি) অনুচ্ছেদকে সংশোধন অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।

সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদকেই সংশোধন অযোগ্য ঘোষণার এখতিয়ার কোনো সংসদের নেই। কেননা পরবর্তী সংসদ যদি দেশ ও মানুষের প্রয়োজনে এবং জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সংবিধানে কোনো পরিবর্তন করতে চায়, সেই সুযোগ থাকা উচিত। একটি সংসদ আরেকটি সংসদের এখতিয়ার সীমিত বা সীমাবদ্ধ করে দিতে পারে না।

তাছাড়া কোন সংশোধনীটি গৃহীত হবে কিংবা কোন সংশোধনীটি দেশ ও জনগণের জন্য প্রয়োজন—সেটি নিয়ে বিতর্ক করার মতো শক্তিশালী বিরোধী দল সংসদে থাকতে হয়। গত চার মেয়াদে সংসদে সেরকম কোনো বিরোধী দল ছিল না। বরং দশম ও একাদশ সংসদে ছিল একটি অনুগত বিরোধী দল—যাদেরকে 'সরকারি বিরোধী' দল বলাই সঙ্গত। আর সবশেষ গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পরে গঠিত সংসদের বিরোধী দল ছিল আরও বেশি দুর্বল। সুতরাং এরকম দুর্বল বিরোধী দলসম্বলিত সংসদের সরকারি দল যা খুশি করতে পারে। সংবিধানকে নিজেদের ইচ্ছেমতো এবং নিজেদের রাজনৈতিক অভিলাষমতো সংশোধন ও পরিবর্তন করতে পারে। সুতরাং কোনো সংসদে সরকারি দল চাইলেই যাতে নিজেদের স্বার্থে সংবিধান পরিবর্তন করতে না পারে, সেজন্য এমন একটি শক্তিশালী বিরোধী দল প্রয়োজন, যারা দেশ ও জনগণের স্বার্থবিরোধী সংবিধানের যেকোনো অনুচ্ছেদ পরিবর্তন এমনকি যেকোনো আইন প্রণয়নও ঠেকিয়ে দিতে পারে।

অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে পুলিশ-প্রশাসন সংস্কারের মধ্য দিয়ে এমন একটি নির্বাচনি ব্যবস্থা গড়ে তোলা; এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সহায়তা করা, যার মধ্য দিয়ে কোনো দল এককভাবে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ না পায়। অর্থাৎ বাংলাদেশে সত্যিকারার্থে একটি অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য ও প্রভাবমুক্ত নির্বাচন হলে এই সময়ে কোনো দলের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কঠিন।

যেমন: প্রথমেই সংবিধানের ৭ (ক) অনুচ্ছেদটি বাতিল করতে হবে। এরপরে সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহ থাকবে কী থাকবে না; মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা রেখে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের সাংঘর্ষিক বিধানটি রাখা হবে কি না, সেই প্রশ্নের সুরাহা করতে হবে।

সংবিধানের কোথায় পরিবর্তন প্রয়োজন?

১. দেশের নাম, নাগরিকত্ব, রাষ্ট্রভাষা, রাজধানী পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন আছে? জাতীয় সংগীত, পতাকা ও প্রতীক কি বদলানোর প্রয়োজন আছে বা সেটি কি সম্ভব? ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই জাতীয় সংগীত বদলানোর সুর তুলেছেন। এটা কতখানি যৌক্তিক এবং পৃথিবীর কোনো দেশে জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করা হয়েছে কি না, সেটা নিয়ে তর্ক হতে পারে। কোনো একটি দেশের রাষ্ট্রকাঠামো যদি আমূল বদলে যায়, ধরা যাক সেখানে ইসলামি বিপ্লব হলো বা কমিউনিস্ট বিপ্লব হলো, তখন এই পরিবর্তনগুলোর দাবি উঠতে পারে। কিন্তু ৫ আগস্ট কি বাংলাদেশে এরকম কোনো ইসলামিক বা কমিউনিস্ট বিপ্লব হয়েছে?

২. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ও প্রধান বিচারপতির কার্যালয় এবং সকল সরকারি ও আধা-সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রধান ও শাখা কার্যালয়, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনসমূহে সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের বিধান যুক্ত করা হয়েছে ২০১১ সালে। সদ্যবিদায়ী আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সংবিধানের এই বিধানের হয়তো বিরোধী। এটা কি তারা পরিবর্তন করতে চায়? যদি চায় সেখানেও রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকতে হবে।

৩. মালিকানার নীতি, কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি, গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা, পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, সুযোগের সমতা, অধিকার ও কর্তব্যরূপে কর্ম, নাগরিক ও সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য, নির্বাহী বিভাগ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, বিশেষ শৈল্পিক কিংবা ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বা তাৎপর্যমণ্ডিত স্মৃতিনিদর্শন সংরক্ষণ ইত্যাদি পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

৪. উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি নামে একটি নতুন দফা যুক্ত করা হয়েছে ২০১১ সালে। এটি নিয়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের আপত্তি আছে। কেননা তারা নিজেদেরকে 'আদিবাসী' বলে দাবি করেন এবং এই শব্দের সাংবিধানিক স্বীকৃতি চান। এখন এটা নিয়ে বরং আলোচনা হতে পারে যে, সংবিধানের এই বিধানটি কি এরকমই থাকবে নাকি এখানে শাব্দিক পরিবর্তন আনা হবে? কিন্তু এই পরিবর্তনের জন্যও সংবিধান পুনর্লিখনের কোনো প্রয়োজন নেই।

৫. পররাষ্ট্র নীতি তথা অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে, সে বিষয়ে ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা—এই সকল নীতি হইবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি। প্রশ্ন হলো, রাজনৈতিক দলগুলো কি মনে করে যে এখানে পরিবর্তন আনতে হবে?

৬. সংবিধান যেসব বিষয়কে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেখানে কি কোনো পরিবর্তন লাগবে? যেমন সেখানে বলা হয়েছে সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী; কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না; রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারীপুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন; নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না; প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে ইত্যাদি। এসব অনুচ্ছেদ বা বিধান নিয়ে কারো কোনো আপত্তি আছে?

৭. বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে রক্ষণের যে বিধান রয়েছে, সেটিও যথেষ্ট আধুনিক ও যৌক্তিক। তবে নিবর্তনমূলক আটকের যে বিধান রয়েছে, সেটি নিয়ে নিশ্চয়ই তর্ক হওয়া উচিত। কিন্তু সেজন্য সংবিধান পুনর্লিখনের কোনো প্রয়োজন নেই।

৮. নাগরিকের চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা অনুচ্ছেদেও যা বলা হয়েছে, তা নিয়ে খুব বেশি সমালোচনার সুযোগ নেই। তবে অনেক সময় শব্দের অর্থ বা বাক্যের বিন্যাসের কারণে অর্থের হেরফের হতে পারে। সেটি ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্ট রয়েছে।

৯. বাক-স্বাধীনতা সারা পৃথিবীতেই শর্তসাপেক্ষ। অ্যাবসোলিউট স্বাধীনতা নৈরাজ্যের জন্ম দেয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের যে স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, তা নিয়ে খুব বেশি তর্কের সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। বরং এই অনুচ্ছেদের পরিপন্থি যেসব আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার নিরাপত্তা আইন ইত্যাদি সংশোধন করা জরুরি।

১০. কোনো নাগরিকের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হলে তিনি যে উচ্চ আদালতে গিয়ে প্রতিকার পেতে পারেন, এই বিধানটিও পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন নেই। তবে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিদের দায়মুক্তির অনুচ্ছেদটির পর্যালোচনা হতেই পারে।

১১. সম্পত্তিতে নাগরিকের কতটুকু অধিকার থাকবে, সেটি বেশ পুরোনো তর্ক। একজন মানুষের টাকা থাকলেই তিনি নিজের ইচ্ছেমতো একরের পর একর জমি কিনতে পারবেন কি না; বাংলাদেশের মতো একটি ছোট আয়তনের এবং বিপুল জনসংখ্যার ভারে নুয়ে পড়া দেশে ব্যক্তির সম্পত্তি অর্জনের সীমারেখা ঠিক করে দেওয়া উচিত কি না, সেটি নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত এবং সংবিধানের এই বিধানটি পরিবর্তন করা উচিত।

১২. নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কীভাবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর তথা নির্বাহী বিভাগের খবরদারিমুক্ত রাখা যায়; বিচার বিভাগকে কীভাবে দলীয়করণের ঊর্ধ্বে রাখা যায়—যাতে নাগরিকরা দল-মত নির্বিশেষে ন্যায়বিচার পেতে পারেন, সেজন্য সংবিধানে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা দরকার।

সংবিধানের প্রধান দুর্বলতা কোথায়?

বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা নিঃসন্দেহের রাষ্ট্র ক্ষমতার ভারসাম্য। অর্থাৎ এখানে প্রধানমন্ত্রীকে এককভাবে এতটাই ক্ষমতাবান করা হয়েছে যে, তিনি চাইলে যা খুশি করতে পারেন এবং তার এই সাংবিধানিক ক্ষমতাই তার কর্তৃত্ববাদী বা স্বৈরাচারে পরিণত হওয়ার সহায়ক। সে কারণে দীর্ঘদিন ধরেই সংবিধান সংশোধন করে কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত করার দাবি আছে। যেমন:

১. একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না।

২. একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান হতে পারবেন না।

৩. সংসদীয় শাসনব্যবস্থা হলেও রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য থাকবে।

৪. রাষ্ট্রপতি হবেন নির্দলীয়। কোনো দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন, এমন কেউ রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না।

৫. আইনপ্রণেতা বা সংসদ সদস্য হতে গেলে তাকে সংবিধান ও আইন-কানুন বুঝতে পারার মতো শিক্ষিত হতে হবে। সেজন্য একটি শিক্ষাগত যোগ্যতাও ঠিক করে দেওয়া যেতে পারে।

কীভাবে সংবিধান সংশোধন হবে?

বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে সংবিধান সংশোধন করতে হলে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোট প্রয়োজন। প্রশ্ন হলো, যদি কোনো দল দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, তাহলে তারা সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনবে কী করে? তার উত্তর হলো, নির্বাচনের আগেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংবিধানের কোন কোন জায়গায় পরিবর্তন বা সংশোধন করা হবে, সে বিষয়ে একটি লিখিত ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে। অর্থাৎ যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন, তারা অপরাপর দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা ও মতামতের ভিত্তিতেই সংশোধনী আনবে। অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই ঐক্য গড়ে তুলতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে।

অন্তর্বর্তী সরকারের এখতিয়ার কী?

সাধারণ যুক্তি ও সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে সংবিধান পুনর্লিখন তো দূরে থাক, সংবিধানের একটি শব্দ পরিবর্তনের এখতিয়ারও অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। তবে তারা দেশ ও জনগণের প্রয়োজনে সংবিধানের কোথায় কোথায় পরিবর্তন প্রয়োজন, সে বিষয়ে সংলাপ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তারা সংবিধান সংশোধনের কিছু মৌলিক বিষয়ে একমত হবে এবং সবার মতামতের ভিত্তিতেই সেই পরিবর্তনগুলো আসবে—এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করা জরুরি। সেজন্য গণপরিষদ নির্বাচন নিয়ে সংবিধান পুনর্লিখনের কোনো প্রয়োজন নেই। সংবিধানে যে পরিবর্তন লাগবে, সেটি নির্বাচিত সরকারই রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিকে সম্পন্ন করতে পারবে। তাছাড়া সংবিধানের আলোকে শপথ নিয়ে যারা সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধানে প্রতিজ্ঞা করেছেন, তারা কী করে সংবিধান পুনর্লিখন বা নতুন করে লেখার জন্য গণপরিষদ নির্বাচন দেবেন, সেটি অনেক বড় সাংবিধানিক প্রশ্ন।

সুতরাং এ বিষয়ে সকলেরই একমত হওয়া প্রয়োজন যে, সংবিধান পুনর্লিখন নয়, বরং দেশ ও জনগণের স্বার্থে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা এবং একটি বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার দায়িত্ব আসলে নির্বাচিত সরকারের। বিরাজনীতিকরণ নয়, বরং অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে এমনকি একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিশ্চিত করা, যাতে কেউ পরবর্তীতে সরকার গঠন করে স্বৈরাচারী বা স্বেচ্ছাচারী হতে না পারে।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments