গণমাধ্যম সংস্কারে দরকার তারানাথ তান্ত্রিক
রাজনৈতিক প্রভাবপুষ্ট, দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ একটি আমলাতান্ত্রিক আমলনামা দৈনিক সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যার পরিসংখ্যান। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর নিয়মিত জালিয়াতিপূর্ণ এই তালিকা প্রকাশ করে থাকে। সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলোয় ডিএফপির অবিশ্বাস্য তথ্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর ৩ সেপ্টেম্বরের তালিকাটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। আশা করি এটি সংস্থাটির কালিমামোচনের শুভ উদ্যোগের প্রথম ধাপ।
এক সময় যমুনা টেলিভিশনের নিউজ টিমের অংশ হিসেবে সচিবালয় বিট কাভার করেছি। এ সময় সচিবালয়ে কর্মরত সাংবাদিকদের আড্ডাস্থল ছিল ছয় ও সাত নম্বর ভবনের পূর্বদিকের কাঁঠালতলা। সেখানে সাংবাদিকরা জড়ো হতেন, আড্ডা দিতেন, একসঙ্গে কাজে যেতেন। এ সময় মাঝেমাঝে এখানে খুবই অপরিচিত সাংবাদিকের দেখা মিলত। তারা কোথায় কাজ করেন, জানতে চাইলে এমন সংবাদপত্রের নাম বলতেন যেটা আমি বাপের জনমেও শুনিনি! হকারের কাছে এগুলোর কপি পাওয়া তো দূরের কথা! সেগুলো ছিল অনেকটা আন্ডারগ্রাউন্ড সংবাদপত্র। তবে এসব সংবাদমাধ্যমের অনেক সাংবাদিককে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়েও দেখা যেতো। বিষয়টি আমার কাছে রহস্যজনক মনে হয়েছিল।
এরপর একটি নিবন্ধের রসদের জন্য ২০১৮ সালে ঢুঁ মেরেছিলাম বাংলাদেশ সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা দপ্তরের ওয়েবসাইটে। সেখানে পেয়েছিলাম নিবন্ধনকৃত পত্র-পত্রিকার তালিকা ও সার্কুলেশন সংক্রান্ত তথ্য, যা ছিল ডাহা মিথ্যা, সত্যের অপলাপ। সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান কীভাবে দুই চোখে টিনের চশমা পরে এই তালিকা প্রকাশ করত, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। নিশ্চিতভাবেই এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক কুপ্রভাব, আমলাতান্ত্রিক অবৈধ যোগসাজশ, সর্বোপরি দুর্নীতি। যে বাস্তবতায় মর্জিমাফিক একটি তালিকা তৈরি করে নিত প্রভাবশালীরা।
পৃথিবীতে চূড়ান্তরূপে আদর্শ বা যথাযথ গণমাধ্যম বলে কিছু নেই। এ ছাড়া সংবাদপত্রের ওপর থাকে রাজনৈতিক অর্থনীতির চাপ। তাত্ত্বিক নোয়াম চমস্কি এ বিষয়গুলো বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এ ছাড়া গণমাধ্যমের একটি বড় লক্ষ্য থাকে মানুষের চিন্তার জগতকে প্রভাবিত করা। মনোভাব তৈরি করা। এ রকম নানা সব জটিল সমীকরণের ভেতরে গণমাধ্যম প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে গণমানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রথম সারির গণমাধ্যম দৈনিক প্রথম আলো। দুই দশকের বেশি সময় ধরে সংবাদপত্রটি পেশাদার সাংবাদিকতার মাধ্যমে মানুষের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করেছে, এখনো করছে। তবে সংবাদপত্রটি যে ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে, তা নয়। তবে এই গণমাধ্যমটি যে দেশসেরা একটি প্রতিষ্ঠান, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তারপরও অদৃশ্য সুতোর টানে ডিএফপির তালিকায় বিস্ময়করভাবে প্রথম আলো চলে যেত দ্বিতীয় স্থানে। শেখ হাসিনার পুরো শাসনামলে এই ধারা অব্যাহত ছিল। সংবাদপত্রটির প্রতি শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত রাগ, ক্ষোভ ও আক্রোশ এখানে কাজ করত, তা বলাই বাহুল্য।
প্রথম আলোকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা দপ্তর থেকে প্রকাশিত তালিকায় বিস্ময়করভাবে প্রথম অবস্থানে থাকত দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন। সংবাদপত্রটির প্রতি আমার ব্যক্তিগত কোনো আক্রোশ নেই। বসুন্ধরা গ্রুপের এই সংবাদপত্রটি কী ধরনের পেশাদার সাংবাদিকতা করে, আর যার বিপরীতে সংবাদপত্রটির পাঠকপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা কেমন, তার একটি মাত্র উদাহরণ দিই। ২০১১ সালের ৫ জুলাই দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন 'যুদ্ধাপরাধী বাবার পরিবেশবাদী কন্যা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান' শিরোনামের একটি সংবাদ প্রকাশ করেছিল। সংবাদটি ছিল ব্যক্তিগত আক্রোশ ও বিষোদগারে পরিপূর্ণ। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান একজন দেশসেরা পরিবেশ বিষয়ক আইনজীবী। যার প্রতিষ্ঠান বেলার সঙ্গে বসুন্ধরা গ্রুপ বিশেষ করে বসুন্ধরার বিভিন্ন আবাসিক প্রকল্পের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। চলছিল মামলা মোকদ্দমা। তাই গ্রুপটি দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে ব্যবহার করে। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। আগ্রহী পাঠক পরে প্রতিবেদনটির খোঁজ করতে পারেন।
শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর দেশের গণমাধ্যম সংস্কারে দেশবরেণ্য সাংবাদিক কামাল আহমেদের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। আশা করছি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীন এই ধরনের ভূতুড়ে তালিকা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থার সুপারিশ করবে কমিটি। দেবে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও। এ ছাড়া দেশের গণমাধ্যমের লাইসেন্সপ্রাপ্তি ও সরকারি বিজ্ঞাপনের বিষয়েও যথাযথ সুপারিশ আসবে বলে আমার প্রত্যাশা।
আরেকটি ছোট্ট বিষয়। গত আগস্টে প্রকাশিত সরকারি তালিকা অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রচার সংখ্যায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে থাকা ইংরেজি জাতীয় দৈনিকগুলোর নাম যথাক্রমে দ্য ডেইলি ট্রাইব্যুনাল, দ্য ডেইলি ইন্ডাস্ট্রি ও দ্য বাংলাদেশ নিউজ। এই তালিকায় দ্য ডেইলি স্টারের অবস্থান চতুর্থতে! তাই প্রশ্ন ওঠে, মহামান্যরা কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় এই তালিকা বানাতেন।
সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার সন্তান আরেকজন গুণী সাহিত্যিক তারাদাশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি আলোচিত চরিত্র তারানাথ তান্ত্রিক। যিনি মূলত ভূত-প্রেতসহ নানা অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে একজন মানবতাবাদী তান্ত্রিক হিসেবে মানুষের উপকার করে থাকেন। তারানাথ তান্ত্রিকের অনেক গল্প ভীষণ রোমাঞ্চকর। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের এই ভূত-প্রেতসহ নানা অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে নতুন কমিশন তারানাথ তান্ত্রিকের মতো ভূমিকা রাখুক, ভূত তাড়াক—সেই কামনা রইল।
রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
Comments