আয়নাঘরের আলামত মুছল কে?

চিলির রাজধানী সান্তিয়াগো শহরে ভিল্লা গ্রিমানডি নামের একটি ভবন আছে। এই দালানটি ছিল চিলির সামরিক স্বৈরশাসক অগাস্তো পিনোশের কুখ্যাত গোয়েন্দা বাহিনীর একটি দপ্তর। এখানে জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্মম নির্যাতনের পর রাজনৈতিক নেতা ও ভিন্নমতাবলম্বীদের বিনাবিচারে বন্দি রাখা হতো। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাবে এই ভবনে ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ২৪০ জন আর কখনই ফেরত আসেননি।

নিষ্ঠুর স্বৈরাচার পিনোশের এই বন্দিশালার প্রধান ছিলেন মার্সেলো মোরেন ব্রিটো নামের এক সেনা কর্মকর্তা। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য যার সাজা হয়েছিল ৩০০ বছরের। পিনোশের পতনের পর ভিল্লা গ্রিমানডি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় চিলি সরকার। বর্তমানে এই ভবনটি একটি স্মৃতি সংগ্রহশালা, যেখানে লিপিবদ্ধ আছে পিনোশের নিষ্ঠুরতার হাজারো কাহিনী। এ ছাড়া পিনোশের আমলে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারে এই ভবন ও ভবন থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন আলামত ব্যবহার করা হয়েছে। আজও এই ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে কালের নিষ্ঠুর সাক্ষী হয়ে, পিনোশের নির্মমতার প্রতীক হিসেবে।

ল্যাটিন আমেরিকার দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ের এই বাড়িটির কথা মনে পড়ল একটি সংবাদ পড়ে। গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার কুখ্যাত আয়ানাঘরের অনেক মূল্যবান আলামত ইতোমধ্যেই নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। দেশের প্রথম সারির সংবাদপত্র সমকালের তথ্য অনুযায়ী, আয়নাঘরের ভুক্তভোগীরা এই গোপন কারাগারের সংরক্ষণ চাইলেও ইতোমধ্যেই এর কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারি জানিয়েছে, গোপন বন্দিশালার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রমাণ নষ্ট করা হয়েছে। দেয়ালের লেখাগুলো রঙ করে মুছে দেওয়া হয়েছে।

শেখ হাসিনা সরকারের গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের আইকন 'আয়নাঘর', যার দেয়ালে দেয়ালে খোদাই করা ছিল শত শত মানুষের নরক-যন্ত্রণার স্মৃতিচিহ্ন, অব্যক্ত বেদনার অভিব্যক্তি। সেগুলো গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির গুরুত্বপূর্ণ আলামত হতে পারত। এই সংবেদনশীল চিহ্নগুলো বাহারি রঙে ঢেকে দেওয়া হলো কোন বিবেচনায়? কার ইশারায়? কার স্বার্থে? এ কেমন নিষ্ঠুর অর্বাচীন সিদ্ধান্ত।

একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন, মানবাধিকার সমুন্নত রক্ষার লড়াই একদিনের নয়। একটি কর্তৃত্ব-পরায়ণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী সরকার পতনের পর এই লড়াই শেষ হয়ে যায় না। এটি প্রতিদিনের বৈশ্বিক লড়াই, যার জন্য পূর্বে ঘটে যাওয়া নিষ্ঠুর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো জানা, আলামত সংরক্ষণ করা বা আলোচনা খুবই জরুরি। এর মাধ্যমে একটি প্রজন্ম, একটি জাতি সচেতন হতে পারে। যা রুখে দিতে পারে আগামীর সম্ভাব্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের শঙ্কা। এ ছাড়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই নমুনাগুলো দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিচারিক আদালতের আলামতও বটে। সেগুলো নষ্ট করার কারণ কী?

রাফায়েল লেমনিক নামের এক পোলিশ আইনজীবী ছিলেন, যিনি জেনোসাইড নিয়ে যুগান্তকারী কাজ করেছেন। তার প্রচেষ্টাতেই জেনোসাইডের সংজ্ঞা নির্ধারণের পরে জাতিসংঘে জেনোসাইড সম্মেলনে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। যা বর্তমান বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আইন। ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে জেনোসাইড প্রতিরোধ তথা মানুষের মানবাধিকার রক্ষায় একটি স্লোগান গৃহীত হয়েছিল। সেই স্লোগানটি ছিল হল 'নেভার অ্যাগেইন' বা 'আর কখনই নয়'। বিশ্বে মানবাধিকার রক্ষায় এই স্লোগানটি বিভিন্ন শ্রেণির অধিকারকর্মীদের শক্তি ও সাহস যোগায়।

গত ১৬ বছরে বাংলাদেশে যে ঘৃণ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, সেই প্রেক্ষাপটে আমরা বলতে পারি, 'নেভার অ্যাগেইন' বা 'আর কখনই নয়'। আমরা কোনো অবস্থাতেই শেখ হাসিনা সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ওই দিনগুলোতে ফিরে যেতে চাই না। যার জন্য ওই সময়ে ঘটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হওয়া খুব প্রয়োজন। একইসঙ্গে প্রয়োজন গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আলামত, তথ্য-উপাত্ত, নথি ও সাক্ষ্যের সংরক্ষণ।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার গুম-বিরোধী জাতিসংঘের সনদে সই করেছে—এটা খুবই আশাব্যঞ্জক খবর। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিহ্ন মুছে ফেলা নিশ্চিতভাবেই হতাশার ও হঠকারী একটি পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপ কারও জন্যেই ভালো ফল বয়ে আনবে না। বরং ভবিষ্যতে ভিন্ন পরিস্থিতি ও ভিন্ন কাঠামোতে গুম বা অন্য ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনে কেউ কেউ উৎসাহ পেতে পারে। কার একক বা যৌথ সিদ্ধান্তে এই কাজ করা হলো—তা অনুসন্ধান করা যেতে পারে।

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English
Domestic violence killing women in Bangladesh

Domestic violence in Bangladesh: When numbers speak of the silence

When we are informed that 133 women have been killed by their husbands in seven months, it is no longer just a number.

7h ago