পুলিশের চাকরি এবং দ্বিচারিতা

পুলিশ
ছবি: টিটু দাস/স্টার

কখনো কখনো মানুষ তার নিজের মধ্যে লালিত দ্বিচারিতা সম্পর্কে অবগত নয় অথবা অবগত হয়েও না বুঝার একটা ভান করে, যাতে এটা থেকে সুবিধা নিতে পারে। আমরা আমাদের স্ট্যান্ডার্ডটা ঠিক করি নিজের সুবিধার ওপর ভিত্তি করে এবং সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ঘটনাটা প্রবহমান।

সমাজের অদ্ভুত এক সিস্টেম হচ্ছে, আমরা চিন্তা করি এক রকম, কিন্তু কাজ করি আরেক রকম। আমরা কী পরিমাণ দ্বিচারিতা পোষণ করি তার বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যাবে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর দিকে লক্ষ্য করলেই।

সারা দেশে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। একটা জেলার বাস্তব উদাহরণ দিয়ে শুরু করি। দিনাজপুর জেলায় ৮৭টি পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন আট হাজার ছয় জন। অর্থাৎ একটি পদের বিপরীতে ৯২ জনের বেশি প্রার্থী। তৃতীয় শ্রেণির একটি চাকরির জন্য এই অবস্থা! তাও আবার প্রার্থীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ নারী।

কত স্বপ্ন নিয়ে, আশা নিয়ে এই পরীক্ষার জন্য আবেদন করেছেন তারা। যেকোনো ভাবেই টিকে থাকতে হবে—এমন মরিয়া প্রার্থী রয়েছেন পুরুষ ও নারী উভয়ের মধ্যেই। শারীরিক সক্ষমতা যাচাই পরীক্ষায় এক নারী পরীক্ষার্থী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দৌড় শেষ করতে না পারায় তাকে কোয়ালিফাই করা হয়নি। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা। তাকে রাখতেই হবে। বলছিলেন—

: স্যার, গত দুই বছর আমি লিখিত পরীক্ষা দিয়েছি। আমি ফেল করতে পারি না।

: কিন্তু, আপনি দৌড়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আসতে পারেননি।

: স্যার আমাকে পাস করে দেন। আমার বাবা-মায়ের অনেক স্বপ্ন, আমি বড় হয়ে পুলিশ হবো। আমি নিজেকে সেই ভাবেই গড়ে তুলেছি স্যার। আমাকে পাস করে দেন স্যার।

: আপনি সময় মতো আসতে পারেননি। আপনাকে কীভাবে পাস করাব বলেন?

: আমার স্বপ্নটা ভেঙে দিয়েন না স্যার। আমি প্রয়োজনে আবার দৌড় দেবো স্যার।

চিন্তা করতে পারেন, একটা মেয়ে একবার এক হাজার মিটার দৌড়ে এসে আবার এক হাজার মিটার দৌড় দেওয়ার জন্য অনুরোধকে ছাড়িয়ে রীতিমতো পীড়াপীড়ি করছে।

এটা তো শুধু একটা ঘটনা, এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। এক ছেলে তো ডিসকোয়ালিফাই হয়েছে শুনে মাঠেই অজ্ঞান হয়ে গেছে। তাকে পুলিশ হতেই হবে। জ্ঞান ফেরার পর তার প্রথম কথা ছিল, 'আমার অনেক স্বপ্ন আমি পুলিশ হবো স্যার। আমাকে বাদ দিয়েন না স্যার।' তিনি বলছিলেন, 'আমার বাবা আমার মাকে ছেড়েছে, আমি নানার বাড়ি মানুষ হয়েছি, তিনবেলা খেতেও পারি নাই স্যার। স্বপ্ন ছিল পুলিশ হবো। আমাকে নেন স্যার, আমাকে নেন স্যার।'

পুলিশ রাষ্ট্রের প্রয়োজনে, জনগণের প্রয়োজনে দায়িত্ব পালন করে। তবে হ্যাঁ, এখানে এমন অনেক ঘটনাই ঘটেছে যে, পুলিশ তার দায়িত্ব যথাযথভাবে হয়তো পালন করেনি। কিন্তু সম্প্রতি পুলিশের ওপর যে জঘন্যতম হামলা হয়েছে, তার অধিকাংশ হয়েছে সাধারণ পুলিশ সদস্য ও তাদের পরিবারের ওপর। যেসব মাস্টারমাইন্ড পুলিশ সদস্যরা রাজনৈতিক পদলেহন করেছে বা সরকারের সুবিধাভোগী ছিল, তারা কিন্তু আক্রান্ত হয়নি। তারা পলাতক। ঠিকই নিজেদেরকে বাঁচিয়ে হয় দেশত্যাগ করেছে, নয়তো দেশের ভেতরেই পালিয়ে আছে। তাদের বিচার হওয়া উচিত ছিল সবার আগে।

এই মাস্টারমাইন্ডরাই নিরীহ ছাত্র-জনতা হত্যার জন্য দায়ী। তারাই উপর থেকে কমান্ড পেয়ে সেটা পালন করতে বাধ্য করেছে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের। মাঠপর্যায়ের এই সাধারণ পুলিশ সদস্যরা কিন্তু আপনার আমার মতোই সাধারণ পরিবার থেকে এসেছে। হয়তো প্রফেশনাল আচরণ করতে পারেনি, কিন্তু তারা মাস্টারমাইন্ড না, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী না। তারা কেবল পরিবার-পরিজন নিয়ে দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করতেই এই চাকরিটা করে এবং চাকরির জন্যই বাধ্য হয়ে উপরের আদেশ পালন করেছেন।

নিকট অতীতে শ্রীলঙ্কায় যে গণঅভ্যুত্থান হলো এবং সেদেশের সরকার পতন ঘটল, সেখানে একজন পুলিশ সদস্যও আক্রান্ত হয়নি। পুলিশের কোনো ইমেজ সংকট হয়নি।

কিন্তু, বাংলাদেশে ঠিক উল্টোটা ঘটেছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, বিগত সময়গুলোতে প্রায় প্রতিটি সরকার নিজেদের প্রয়োজনে পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে। রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে পুলিশকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়নি। একটা পেশাদার বাহিনী হিসেবে পুলিশকে কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি।

শুধু পুলিশ না, অন্যান্য সংস্থাকেও সরকার ব্যবহার করেছে নির্যাতনের একটা টুল হিসেবে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন এমনভাবে ঘটেছিল যে, আইনের কোনো বালাই ছিল না। আইনকেও নির্যাতন একটা উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং সেটা নিজেদের মতো চালিত করা হয়েছে। পুলিশকে আদর্শ থেকে বিচ্যুত করা হয়েছে।

কেবল গুটিকয়েক কর্মকর্তার জন্য পুলিশের এই অবস্থা। এখানে যদি কেউ দায়ী থাকে, তাহলে দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক পদলেহনকারী, দুর্নীতিবাজ এই সব পুলিশ কর্মকর্তারাই দায়ী। কিন্তু সর্বোচ্চ ভোগান্তির শিকার হয়েছে সাধারণ পুলিশ সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। তাদের সঙ্গে বর্বর আচরণ করা হয়েছে, নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে!

অথচ এই একটা পুলিশের চাকরির জন্যই আমাদের কত প্রাণান্ত চেষ্টা।

পুলিশ সদস্যরা সমাজ থেকেই আসে। তারা এই সমাজেরই অংশ। সমাজ যেমন হবে, পুলিশ তেমনই হবে। খারাপ ইনপুট দিয়ে কখনোই ভালো ফল আশা করা যায় না। আমরা তখনই ভালো পুলিশ আশা করতে পারব, যখন সমাজের পরিবর্তন হবে।

সম্রাট মো. আবু সুফিয়ান, বিশেষ পুলিশ সুপার, স্পেশাল ব্রাঞ্চ

Comments

The Daily Star  | English

March revenue growth nears 10%, but no cause for cheer

NBR still needs Tk 65,000cr per month to hit IMF target for FY25

10h ago