পাণ্ডুলিপিতে পুলিশিং কার স্বার্থে

একুশের আত্মত্যাগ বাঙালির শত বছরের অহংকার। আর নিশ্চিতভাবেই অমর একুশে গ্রন্থমেলা সৃজনশীলতা, মেধা-মননের প্রকাশ ও বিকাশের বিশেষ উপলক্ষ। লেখক-পাঠকের জন্য এই মেলা এক তীর্থস্থান, মিলনমেলা। তাই ফেব্রুয়ারি এলেই মনে গৌরবের আনন্দ কাজ করে। নগরবাসীও একটা উপলক্ষে মেতে থাকার সুযোগ পান।

কিন্তু এই মেলা শুরুর আগের দিন সন্ধ্যায় দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইনে একটি খবর পড়ে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। বই প্রকাশের আগে বাংলা একাডেমিকে পাণ্ডুলিপি যাচাই করার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। কী অর্বাচীন, স্বৈরতান্ত্রিক, কঠোর কর্তৃত্বপরায়ণ ও ফ্যাসিবাদী পরামর্শ!

এ বছর ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে অমর একুশে গ্রন্থ মেলা আয়োজিত হচ্ছে। প্রায় ১৬ বছরের এক কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের অবসান হয়েছে। ভয়ের সংস্কৃতিকে পরাজিত করে নাগরিকরা ফিরে পেয়েছেন মনের ভাব ও ভাষা প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা। এমন প্রেক্ষাপটে এই মেলা নিয়ে দেশবাসীর প্রত্যাশাও বেশি।

আমার মতো অনেকেরই কামনা, ২০২৫ সালের গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হবে ভয়ভীতিহীন মুক্ত পরিবেশে, যেখানে লেখকের অবাধ স্বাধীনতা থাকবে। থাকবে না কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত কর্তৃত্ব। কিন্তু হায়! সেই প্রত্যাশায় পানি ঢেলে দিল বাংলাদেশ পুলিশ। মেলার ঠিক আগের দিন বিকেলে এক ব্রিফিং এ পুলিশের তরফ থেকে গ্রন্থ প্রকাশের আগেই পাণ্ডুলিপি নিরীক্ষার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

দৈনিক প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, 'অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে এমন বিষয়বস্তু ঠেকাতে মেলায় বই প্রকাশের আগেই পাণ্ডুলিপি যাচাই করতে বাংলা একাডেমিকে বলেছে পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশ  চাইছে, ২০২৬ সালের একুশে বইমেলা থেকে এই ব্যবস্থা চালু করা হোক।'

ওই ব্রিফিংয়ে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, তারা বাংলা একাডেমিকে অনুরোধ করেছেন উস্কানিমূলক লেখা আছে এমন বই যাতে মেলায় না আসে। যার জন্য তিনি গ্রন্থ স্ক্যানিং ও ভেটিং করার পরামর্শ দিয়েছেন।

কী কাণ্ডজ্ঞানহীন পরামর্শ। ডিএমপি কমিশনারের কি কোনো ধারণা আছে, প্রতি বছর গ্রন্থমেলায় কত বই প্রকাশিত হয়? আর 'উস্কানিমূলক' শব্দটির ব্যাখ্যা কী? কার বিরুদ্ধে উস্কানি, কীসের বিরুদ্ধে উস্কানি? আমার মাথায় আসে না কোন প্রেক্ষাপটে পুলিশের এমন পরামর্শ দেওয়া অতি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়লো।

প্রথম আলোর সংবাদ অনুযায়ী, ওই ব্রিফিংয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার এসএন নজরুল ইসলাম উল্লেখ করেছেন, তারা বাংলা একাডেমিকে পরামর্শ দিয়েছেন বই প্রকাশের আগেই পাণ্ডুলিপি নিরীক্ষা করতে হবে। যাতে 'দেশদ্রোহী কোনো প্রকাশনা বা সরকারকে অস্থির করে এমন কোনো ধরনের প্রকাশনা যেন মেলায় না আসে।'

কি ভীতিকর পরামর্শ! নাগরিকের সৃজনশীলতা ও মত প্রকাশের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রকাশ্য হুমকি। বাংলাদেশ পুলিশ, বিশেষ করে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপলব্ধি করা উচিত, একজন স্বৈরাচারের পতন ও তার আমলে লুণ্ঠিত হওয়া মত প্রকাশের স্বাধীনতা ফেরত পেতেই ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মাত্র কয়েক মাস আগেই গণবিস্ফোরণ হয়েছিল। এই বাংলা একাডেমির পাশের রাস্তাতেই ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়েছিলেন। রক্তমাখা রাজপথে গলার শিরা টানটান করে শ্লোগান দিয়েছিলেন—কর্তৃত্বপরায়ণ, একনায়ক শেখ হাসিনার পতন চাই। আর সে সময় এই পুলিশ বাহিনী কী করেছিল সেটাও দেশবাসী এতো তাড়াতাড়ি ভুলে যায়নি। নতুন বাংলাদেশের পুলিশের উচিত, নাগরিকের মত প্রকাশকে ইতিবাচকভাবে উৎসাহিত করা, ভয়ের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়া নয়।

তবে হ্যাঁ, উদ্দেশ্যমূলকভাবে কেউ যাতে মহান মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ, কোনো ধর্মের অবমাননা ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে কলঙ্কিত করার অপরাধমূলক চেষ্টা করতে না পারে, সে বিষয়ে বাংলা একাডেমিকে অবশ্যই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি সহনশীলতা, প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে বলে আশা রাখলাম।

তবে এ ক্ষেত্রে পুলিশের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি ও কর্তৃত্বপরায়ণ পরামর্শ কাম্য নয়—কোনো অবস্থাতেই নয়। সৃজনশীল লেখক ও নাগরিকের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করার উপলক্ষ তৈরিতে জুলাই অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়নি, বিষয়টি সবার মনে রাখা উচিত।

২০২৫ সালের বইমেলা শুরু হচ্ছে 'জুলাই গণঅভ্যুত্থান: নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ' প্রতিপাদ্য নিয়ে। এই নতুন বাংলাদেশে যাতে সৃজনশীল লেখক ও গবেষকদের ভয়ের সংস্কৃতির শিকার হতে না হয় সেই আশাবাদ রাখলাম।

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

Comments

The Daily Star  | English

Stuck in red, shipbreaking slow to turn green

Bangladesh began the green transition in 2017, when PHP Ship Recycling Yard became the first entity in the country to receive international green certification.

14h ago