পর্যালোচনা

দুঃসাহসী এক নৌ কমান্ডোর যুদ্ধ স্মৃতি

দৃশ্য অদৃশ্য ঘটনায় বৈচিত্রে ভরপুর মানুষের জীবন। আর লিখিত অলিখিত ঘটনার মালা গেঁথেই জীবনতরী চলে এগিয়ে। তবে স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও আমাদের অনেক স্মৃতি রয়েছে অলিখিত। স্বাধিকারের  কত স্মৃতি কত কথা জানি না তার হিসাব নেই। এমন অনেক স্মৃতিই তলিয়ে যাচ্ছে কালের গর্ভে। গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার যথাযথ আর্কাইভও হয়নি। বিশেষ করে একাত্তরের যুদ্ধের কত স্মৃতি হারিয়ে যাচ্ছে, আবার কিছুটা পাচ্ছি ব্যক্তি উদ্যোগের কারণে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ সময় পরেও স্মৃতিবিজড়িত মানুষের দেখা মিললে উঠে আসছে অজানা অধ্যায়। তেমনি একজন মো. এনামুল হক, যিনি বহু ঘটনার সাক্ষী। তিনি অপারেশন জ্যাকপটসহ একাধিক অপারেশনে অংশ নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডোর একজন। 

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নৌকমান্ডোদের প্রথম অভিযান 'অপারেশন জ্যাকপট'। বলা হয়ে থাকে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ নৌ অপারেশনগুলোর একটি। এটি ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নৌ কমান্ডোদের এক মরণকামড়। এটি চালানো হয় একাত্তর সালের ১৬ আগস্ট, দিনের শুরুতে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর- এই চার স্থানে একযোগে। আত্মঘাতী নৌকমান্ডো দলের সফল এ অপারেশনে পাকিস্তান থেকে আসা অস্ত্রবোঝাই জাহাজসহ বিভিন্ন দেশের খাদ্য ও তেলবাহী ২৬টি জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া হয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডোর মো. এনামুল হকের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় লেখা 'অপারেশন জ্যাকপট: এক নৌকমান্ডোর অহংকার' বই। ২০২৩ একুশে বইমেলায় প্রকাশ করেছে নিমপিয়া পাবলিকেশন, প্রচ্ছদ করেন আনিসুজ্জামান সোহেল। বইটি পড়ে ও তার সঙ্গে আলাপের সময় তিনি ফিরে যান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে। মার্চের ঢাকা, ২৫ মার্চ কালরাত্রি, মুক্তিযুদ্ধ, নৌকমান্ডো গঠন, প্রশিক্ষণ, অপারেশন জ্যাকপট- আরও কত কথা। বাবার চাকরিসূত্রে তিনি শৈশবে কক্সবাজারে ছিলেন। সে সময় বন্ধুদের নিয়ে সাগরে যেতেন সাঁতার কাটতে। তারুণ্যের আনন্দময় সেই অভিজ্ঞতা মুক্তিযুদ্ধে তার নৌকমান্ডো হওয়ার পথ সহজ করে দেয়। অপারেশন জ্যাকপটে নিশ্চিত মৃত্যুর আশঙ্কা থেকেও পিছে হটেননি। বরং প্রশিক্ষণের শুরুতে অঙ্গিকারনামায় লিখেন, আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে সম্মত হয়েই এই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করছি। যুদ্ধে আমার মৃত্যু ঘটলে কেউ দায়ী থাকবে না।'

কোন বয়সে কেন যুদ্ধে গেলেন, সে প্রশ্নের জবাবে আসে-'আমি তখন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। ছাত্ররাজনীতি করি। পাকিস্তানিদের শোষণ নিপীড়ন খুব কাছে থেকে দেখেছি। সেই দ্রোহ থেকে যুদ্ধে যাবার প্রেরণা।' তবে ২৫শে মার্চ রাতে হঠাৎই শুনতে পাই গুলির আওয়াজ। চারদিকে বারুদের গন্ধ। আব্বা ভয়ে আজান দেওয়া শুরু করলেন। আম্মা মেঝেতে চাদর বিছিয়ে সবাইকে শুয়ে পড়তে বললেন। পরবর্তী তিন দিন চলল কারফিউ। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারি না। কারফিউ তুলে নিলে ঢাকার অবস্থা দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। বাহিরে যা দেখলাম তা বলার মতো না। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রোকেয়া হলের সামনে দেখলাম মেয়েদের শাড়ি, ব্লাউজ, ওড়না ঝুলছে। হলের ওপরে দেখি জানালায়ও একই অবস্থা। বুঝতে বাকি রইলো না এই হামলা হানাদারদের। জগন্নাথ হলের দিকে দেখি, লোকজন জড়ো হয়ে বলাবলি করছে হামলার ভয়াবহতা নিয়ে। একজন বলছে 'ছাত্রদের মেরেছে, কয়েকজনকে জীবন্ত পুঁতে ফেলেছে।' তার একদিন  পর গ্রামে চলে যাই। গ্রামের খবির, কুদ্দুস, রফিককে নিয়ে মিটিং করলাম। সিদ্ধান্ত হলো ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নেব।'

দীর্ঘ পথ, নানান জটিলতায় ভারতে যায়। সেখানে ট্রেনিং হয়। এ প্রসঙ্গে জানান অন্যরকম এক তথ্য। এনামুল হকের ভাষ্য- একদিন ক্যাম্পে কয়েকজন ভারতীয় অফিসার হুইসেল বাজিয়ে আমাদের কাছে ডাকলেন। প্রশ্ন করলেন, তোমাদের মধ্যে কে কে সমুদ্রে সাঁতার কেটেছ। আমি হাত তুলি। বললেন, বড় নদীতে কার কার সাঁতার কাটার অভিজ্ঞতা আছে, আরও কয়েকজন হাত তুলেন। এভাবে ১৭ জনকে বাছাই করা হলো। পরে সেখান থেকে আরেক ক্যাম্পে নিয়ে আমাদের সঙ্গে এক এক করে কথা বললেন একজন ক্যাপ্টেন। আমাকে বললেন, এটা সুইসাইডাল স্কোয়াড- এখানে মৃত্যু নিশ্চিত। তখনও আমরা জানি না আমাদের কী করতে হবে। আমাকে ক্যাপ্টেন বললেন, বরং তুমি ক্যাম্পে ফিরে যাও ট্রেনিং নিয়ে দেশের ভেতরে গিয়ে যুদ্ধ করবে। আমি বললাম, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই যুদ্ধে এসেছি। স্যার আমার আরও ভাই আছে। আমি ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয়। যুদ্ধে শহীদ হলেও আমার পরিবারের খুব বেশি ক্ষতি হবে না। আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে চাই। এরপর আমাদের পাঁচজনকে নির্বাচিত করে ভাগীরথী নদীর পাড়ে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হলো।' 

কথাগুলো শুনে ও বইতে পড়তেই বুক কেঁপে উঠলো। কী দুঃসাহসীভাবে না তিনি যুদ্ধের সমকাল কাটিয়েছেন এবং লিখেছেন। এইভাবে অসংখ্য যোদ্ধার ত্যাগে, নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা। উপরোক্ত কথা কেবল এনামুল হকের কথা নয়, আমাদের ইতিহাসেরও অংশ। যা প্রজন্মের জানা প্রয়োজন।

একটি অপারেশনের কথা আসে এইভাবে-  দলনেতা নির্দেশ দিলেন মোংলা বন্দরের জাহাজগুলোতে মাইন লাগাতে হবে। আমরা রওনা হলাম, ভোরে আজান হচ্ছে। নদীতে প্রবল স্রোত। পাকিস্তানিরা গানবোট নিয়ে টহল দিচ্ছে। ওই সময়ে আমাদের আশ্রয় দিল কচুরিপানা। তবে স্রোতের টানে একসাথে থাকতে পারিনি। বেগতিক অবস্থায় আমরা মাইন সেট করে জোয়ারে গা ভাসালাম। যত তাড়াতাড়ি পারি দূরে যেতে হবে, পাড়ে উঠতে হবে। প্রাণপণ সাঁতরাতে থাকি। পাকিস্তানিরা গানবোট নিয়ে আসছে দেখে আমরা পানিতে ডুব দেই। উঠে দেখে গানবোট দূরে চলে গেছে। আবার সাঁতরাই। প্রথম যখন নাইন বিস্ফোরিত হয় তখন ভোর ৬টা। বিকট শব্দে একের পর এক লিম্পেট মাইন বিস্ফোরিত হতে থাকলে পাকিস্তানীরা বিভ্রান্ত হতে গুলি করতে থাকে। অকস্মাৎ আক্রমণে তারা হতবিহবল হয়ে পড়ে।' 

এইভাবে বইতে উঠে এসেছে এনামুল হকের যুদ্ধের জীবন। তার আগে তুলে ধরেন পারিবারিক জীবন, তার শিক্ষার সময়, শিক্ষক সহপাঠীদের গল্প, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, বঙ্গবন্ধুর কথা। দেশপ্রেমে মরিয়া হয়ে বিপজ্জনক ও আত্মঘাতী অপারেশনের মাধ্যমে সবুজ পতাকার ঐতিহাসিক অর্জন। ফলে আলোচ্য বইয়ের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহুমাত্রিক। একজন সাধারণ পরিবারের এনামুল হকের নিজের ও পরিবারের অসাধারণ অবদানে কীভাবে ব্যক্তিগত বিষয় ব্যক্তির ঊর্ধ্বে দেশ থাকে তা বুঝতে বইটির নিবিড়ি পাঠ আবশ্যক।

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন ভূমিকায় লিখেন, 'এনামের লেখায় নৌকমান্ডোদের অপারেশন জ্যাকপটের প্রায় আদ্যোপান্ত উঠে এসেছে। গদ্য লেখায় এনামের এই প্রয়াস প্রথম। কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও বিষয়ের কারণে প্রকাশনটি বিপুলভাবে পঠিত হবে।' প্রসঙ্গত আমি বলব, বইটি পড়ে দেখা যায়- 'অপারেশন জ্যাকপট' এনামুল হকের সম্পৃক্ততায় এই অভিযানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জলপথে চলাচল অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত করিয়ে দেয়। পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাসে এমন দুঃসাহসিকতার নজির বিরল। ফলে আলোচ্য বই তাই ব্যক্তির বয়ানে ইতিহাসের দলিল। তবে, এ ধরণের বইয়ের আন্তরিক সম্পাদকীয়তা ও সম্পাদনা প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি। এর দায় অবশ্য লেখকের যতটা, প্রকাশকেরও।

উল্লেখ্য এনামুল হকের জন্ম ১৯৫৪ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকায়। গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুর উপজেলায়। বাবা বজলুল হক, মা জাহেদা খাতুন। পড়াশোনা জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যুদ্ধের পরে পড়াশোনার পাশাপাশি করেছেন শিল্পসাধনা। চিত্রণ ফিল্ম সোসাসাটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। যুক্ত হন অধ্যাপক নজরুল ইসলামের সঙ্গে নগর গবেষণা কেন্দ্রে। পরে বাংলা একাডেমির অধীনে লোক ঐতিহ্য নিয়েও কাজ করেছেন। বর্তমানে প্রবাসজীবন যাপন করেছেন।  সুযোগ পেলে স্বপ্নের দেশে আসেন এই বীরমুক্তিযোদ্ধা।

Comments

The Daily Star  | English

Four die in bike collision at Jajira end of Padma Bridge

Four people died in a head-on collision between two motorcycles near the Padma Bridge's South Toll Plaza area in Jajira upazila of Shariatpur yesterday night

48m ago