বৈষম্যবিরোধীরাই বৈষম্যে অভিযুক্ত!

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার তথা বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে শিক্ষার্থীরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তারাই এখন তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ আনছেন।

২৬ ফেব্রুয়ারি (বুধবার) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি অংশের নেতৃত্বে 'গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ' নামে একটি নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানেই শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন বৈষম্যের অভিযোগ তুলে। তাদের অভিযোগ, কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিপত্য। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেভাবে প্রতিনিধিত্ব নেই। এই ইস্যু নিয়ে তারা বিভিন্ন স্লোগান দেন এবং একপর্যায়ে ‍দুপক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়। দুজন সমন্বয়ককে হাসপাতালেও নিতে হয়। বিক্ষোভের মধ্যেই মধুর ক্যান্টিনের ভেতরে ঢুকে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়।

এর প্রতিবাদে ওইদিন রাতে রাজধানীর বাংলামোটর এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, জুলাই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও নতুন ছাত্র সংগঠনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিক্ষোভকারীদের একজন মাসরাফি সরকার গণমাধ্যমকে বলেছেন, 'গণঅভ্যুত্থানের সময় আমরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছি। নয় দফার ক্ষেত্রে আমাদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। অথচ এখন সব কমিটি করা হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক। এটা হয় না, এটা অনেক বড় বৈষম্য।'

প্রসঙ্গত, নতুন এই ছাত্র সংগঠনের স্লোগান 'শিক্ষা ঐক্য মুক্তি'। কিন্তু দেখা গেলো, সংগঠনের আত্মপ্রকাশের দিনেই তাদের মধ্যে অনৈক্যের সুর এবং যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে তারা একটি অভূতপূর্ব আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে একটি সরকারের পতন ঘটিয়েছেন, এবার তারা নিজেরাই সেই বৈষম্যের শিকার বলে অভিযোগ তুললেন সতীর্থদের বিরুদ্ধে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রাধান্যের বিষয়টি নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ও অসন্তোষ শুরু থেকেই। অস্বীকার করা যাবে না, জুলাই অভ্যুত্থানের শেষদিকে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে দেওয়া হয়, তখন এই আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে ছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনে নিহতদের তালিকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি।

২.

গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জন্য যে ১১টি কমিশন গঠন করা হয়েছে, সেখানে শিক্ষক আছেন মোট ১৪ জন। তার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নয়জন, যাদের মধ্যে পাঁচজনই আবার আইন বিভাগের। বাকি চারজন অন্যান্য বিভাগের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে অন্য যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আছেন সেগুলো হচ্ছে—জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন।

এই ঘটনাটিও কোটা ও বৈষম্যের একটি বড় উদাহরণ। অনেকেই এই প্রশ্ন তুলেছেন যে, ১৪ জন শিক্ষকের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই নয়জন এবং তার মধ্যে পাঁচজনই কী করে আইন বিভাগের হন? সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল এই বিভাগের শিক্ষক বলে? শুধু সংস্কার কমিশন নয়, সরকারের উপদেষ্টা পরিষদসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও একটি বিশেষ জেলার লোককে যে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, সেটি ওপেন সিক্রেট। বিগত সরকারের আমলেও একটি বিশেষ জেলার লোককে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রবণতাটি দৃষ্টিকটূভাবে বহাল ছিল। তার মানে শত শত মানুষ প্রাণ দেওয়ার পরেও কোটা ও বৈষম্য থেকে মুক্ত হওয়া গেল না?

৩.

বলা হয় মর্নিং শোজ দ্য ডে। বৈষম্যের অভিযোগে হাতাহাতি, মারামারি আর সড়ক অবরোধের মধ্য দিয়ে যে সংগঠন যাত্রা শুরু করলো এবং যারা এই সংগঠনের নেতৃত্বে এলেন, তারা যে নতুন বাংলাদেশ এবং নতুন বন্দোবস্তের কথা বলেন—সেটি কী করে নিশ্চিত করবেন?

কমিটি গঠনের সময় পদ পাওয়া নিয়ে হাতাহাতি ও মারামারি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভেতরে দেখা যায়। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এই প্রবণতা থেকে যারা বের হতে পারলেন না, তারা কী করে নতুন বাংলাদেশ গড়বেন—সেই প্রশ্ন জনমনে রয়েছে। বরং যারা একটি বিরাট অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা যদি নতুন সংগঠন গড়ে তোলার প্রক্রিয়াটি আনন্দমুখর, গণতান্ত্রিক, নিজে পদ না নিয়ে অন্যের জন্য পদ ছেড়ে দিতে পারতেন, তাহলে দেশবাসী বুঝতে পারতো যে, তারা সত্যিই একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে চান। কিন্তু তারা সেটি পারেননি।

এই সংগঠন গড়ে তোলায় আরও একটি প্রশ্ন সামনে আসছে, সেটি হলো—বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি মিলে যেদিন (২৮ ফেব্রুয়ারি) একটি নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করলো, তার ঠিক দুদিন আগেই কেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি অংশ আলাদা হয়ে নতুন এই সংগঠন গড়ে তুলল? তারা কি মূল দলের ছাত্র সংগঠন হিসেবে কাজ করবে? বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কাজ কি তাদের চেয়ে আলাদা হবে নাকি ভবিষ্যতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিলুপ্ত ঘোষণা করা হবে?

জনমনে আরও যে প্রশ্নটি রয়েছে সেটি হলো, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে। এই ইস্যুতে খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) ছাত্রদলের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ পর্যন্ত হয়েছে। যে ঘটনার ধারাবাহিতায় কুয়েট বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ সেই ছাত্ররাই এখন আলাদা যে ছাত্র সংগঠন গড়ে তুললেন, তারা কি রাজনীতি করবেন না? তারা কি ক্যাম্পাসে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন না? যেকোনো ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসে সক্রিয় থাকলে সেটি কি রাজনীতিমুক্ত থাকবে?

৪.

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভেতরে অন্তর্কোন্দল এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ শুরু থেকেই লক্ষ্যণীয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েছেন। বিভিন্ন ঘটনায় অনেক সদস্যকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে।

সম্প্রতি চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে নগরীর লালদীঘি ময়দানে সমাবেশ ডাকা হলেও একটি পক্ষ দাবি করে যে, সমাবেশটি তাদের নয়। বিষয়টি নিয়ে দুই পক্ষই পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। পক্ষ দুটির মধ্যে একটিতে রয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্র থেকে দেওয়া চট্টগ্রামের কমিটির নেতাকর্মীরা, অন্যটিতে রয়েছেন এই কমিটি থেকে পদত্যাগ করা ও কমিটিকে প্রত্যাখ্যানকারীরা। সুতরাং যে সংগঠনটি দেশের অন্যান্য ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের কাছে একটি মডেল বা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারতো, সেটি হয়নি। বরং সংগঠনের অনেক নেতাকর্মীর কথাবার্তার ঢং, আচরণ, শব্দচয়ন মানুষ পছন্দ করে না। সুতরাং তারা যে নতুন বাংলাদেশ ও নতুন বন্দোবস্তের কথা বলেন, সেটি বিশ্বাস করা কঠিন।

৫.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেদিন এই ঘটনা ঘটলো সেদিনই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন জুলাই অভ্যুত্থানে আহতরা। তারা আন্দোলনে আহতদের সবাইকে মাসিক ভাতার আওতায় আনাসহ তিন দফা দাবি জানান।

সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে যারা আহত হয়েছেন, তাদের এ, বি ও সি—এই তিনটি শ্রেণিতে (ক্যাটাগরি) ভাগ করে সরকারি সুবিধা দেওয়া হবে।

প্রথম ক্যাটাগরিতে গুরুতর আহত ব্যক্তিদের এককালীন পাঁচ লাখ টাকা এবং প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়ার কথা বলা হয়। দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে এক অঙ্গহানি হয়েছে এমন অবস্থায় যারা আছেন, তাদের এককালীন তিন লাখ টাকা এবং মাসে ১৫ হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়ার কথা। আর সিদ্ধান্ত অনুসারে তৃতীয় ক্যাটাগরিতে সামান্য আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন, ভালো হয়ে গেছেন—তারা অগ্রাধিকারভিত্তিতে চাকরি ও পুনর্বাসনে অগ্রাধিকার পাবেন। কিন্তু ভাতা পাবেন না।

কিন্তু বুধবার সকালে আহতদের একটি অংশ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়ে আহতদের তিনটি শ্রেণি ভেঙে দুটি শ্রেণি করার দাবি তোলেন। তারা প্রথম দুটি শ্রেণির আহতদের এককালীন অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি সবাইকে ভাতার আওতায় আনার দাবি করেন। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সামনে অবস্থান গ্রহণকারীদের কেউ কেউ সরকারের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ আনেন।

৬.

যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে জুলাই অভ্যুত্থান হলো এবং যারা এই আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন, তারাই যখন বৈষম্যের শিকার বলে অভিযোগ তোলেন এবং অভিযুক্ত হন—সেটি অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দেয়।

প্রথম প্রশ্ন হলো, নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য চিন্তা ও কর্মে যে নতুনত্বের ছাপ থাকা দরকার ছিল; কথাবার্তা, আচার-আচরণ ও অভিব্যক্তিতে যে ধরনের বিনয় ও মাধুর্য কাঙ্ক্ষিত—সেটি কেন তাদের মধ্যে অনুপস্থিত? কেন তারা পুরোনো ধারার রাজনীতি পদ-পদবি ও চেয়ারের জন্য মারামারি করবেন? এই সংগঠনের নেতারাও কি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের মতো এসব পদকে টাকা কামানোর মেশিন হিসেবে বিবেচনা করেন? যদি এসব পদ টাকা কামানোর মেশিন না হয় তাহলে এর নেতৃত্বে যেতে এত প্রতিযোগিতা কেন? কেন তারা একজন আরেকজনকে চেয়ার ছেড়ে দিয়ে উদাহরণ তৈরি করতে পারেন না? কেন তারা এমন কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলেন না যাতে দেশের মানুষের মনে এই প্রতীতী জন্মায় যে, সত্যিই তারা একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যোগ্যতা রাখেন? আরও অনেক প্রশ্ন জনমনে আছে। সব প্রশ্ন হয়তো এখনই করা যাচ্ছে না। কিন্তু ভবিষ্যতে ধীরে ধীরে প্রশ্নগুলো সামনে আসবে।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments

The Daily Star  | English
Kamal Hossain calls for protecting nation

Kamal Hossain urges vigilance against obstacles to nation-building effort

"The main goal of the freedom — gained through the great Liberation War — was to establish democracy, justice, human rights and build a society free from exploitation. But we have failed to achieve that in the last 54 years," says Dr Kamal

1h ago