আর কতবার এই জনপদের মানুষ প্রতারিত হবে?

উপরে থুথু মারলে নিজের গায়েই পড়ে—কথাটা নির্মম সত্য। সত্য হলেও সত্যটার মুখোমুখি হতেই হয়।

সম্প্রতি রাত ৩টায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলন আরও একবার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, একমাত্র প্রধান উপদেষ্টা ছাড়া আর সব উপদেষ্টা হয় টিনের চশমা পরে ঘুরে বেড়ান, নতুবা ঘুমিয়ে থাকেন।

গত ৫৪ বছর ধরে আমরা এমন সংবাদ সম্মেলন দেখে এবং একই পৌনঃপুনিক বক্তব্য শুনে অভ্যস্ত—আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে এবং আরও উন্নতি হবে।

আপনার উচিত ছিল তাৎক্ষণিক পদত্যাগ করা। তা না করে ফ্যাসিস্টদের মতো বক্তব্য দিতে আপনার তো লজ্জা হওয়ার কথা। চরমভাবে ব্যর্থ হওয়ার পরেও আপনি সংবাদ সম্মেলন করেন! ধিক্ আপনাকে।

একটা কথা সত্যি বলেছেন, আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের লুট করা টাকায় এই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো হচ্ছে, দেশে একটা গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করার প্রয়াস চলছে। শক্ত হাতে এই পরিস্থিতি দমন করার পরিবর্তে আপনাদের শিথিলতা আমাদের ভাবায়। অদ্ভুতভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরাও এ বিষয়ে নিশ্চুপ।

আমাদের মনে হাজারো প্রশ্ন জাগে।

সিরিয়ায় বাসার আল আসাদের পতনের দুই সপ্তাহের মধ্যে তার অনুসারীদের মধ্যে কম করে হলেও ১৫ জনের বিচার সম্পন্ন হয়েছে, তাদেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। আর আমাদের এখানে?

ছয় মাস পার হয়ে যাওয়ার পরও কারো বিচার আপনারা সম্পন্ন করতে পারেননি। এমনকি যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা জেলে রাজকীয় জীবনযাপন করছে।

অতি আশ্চর্যের বিষয় হলো, যেসব রাজনৈতিক দলের নেতারা গত ১৬ বছর নিজবাড়িতে থাকতে পারেনি; গুম, খুন, মিথ্যা মামলায় জর্জরিত ছিল; তারা একবারের জন্যও বলে না যে ফ্যাসিস্টদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। তারা একবারও বলে না যে জুলাই হত্যাকারীদের বিচার অতিদ্রুত সম্পন্ন করতে হবে, আহতদের সুচিকিৎসার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে হবে। তাদের একটাই কথা, অতিদ্রুত নির্বাচন দিতে হবে।

অবস্থাটা এমন, ভয়ানক পেট খারাপ নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরে তিনি প্রেসক্রিপশন দিলেন, 'অতিদ্রুত নির্বাচন দিতে হবে'।

প্রতিটি খাতে অরাজকতা, অনিয়ম আর যা ইচ্ছা তাই চলছে। পান থেকে চুন খসলেই রাস্তা অবরোধ, ভাঙচুর এবং পরিশেষে সরকার দাবি মেনে নেয়। এভাবেই যদি সব দাবি মানবেন, তাহলে কেন এত জনদুর্ভোগ? ছাত্র-জনতা আপনাদের ক্ষমতায় বসিয়েছে ক্ষমতার প্রয়োগ দেখার জন্য।

৩৬ জুলাইয়ের পর পর ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে গেল। তাকে পালাতে সহায়তা করল সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী। আমাদের প্রশ্ন, কেন তারা সহায়তা করল?

আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকে (উদাহরণস্বরূপ: হাছান মাহমুদ, জুনাইদ আহমেদ পলক) দেখলাম, বিমানবন্দর থেকে আটক হয়েছে; এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই দেখা গেল, হাছান মাহমুদ বেলজিয়ামে বহাল তবিয়তে আছেন। জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বেশিরভাগই পালিয়ে গেল। কীভাবে? আমরা সেটা জানতে চাই।

আইএসপিআরের বিবৃতিতে জানা গেল, ৬০০ জনের বেশি সামরিক, বেসামরিক, সরকারি, বেসরকারি নাগরিককে হত্যায় যারা জড়িত, সেনাবাহিনী তাদের আশ্রয় দিয়েছে। তারা কারা? আজ পর্যন্ত তা জানা গেল না। জানানো হলো না। সেই একই কায়দা—জনগণকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করাই দেখছি।

অতঃপর একে একে সবই পালালো। নানা কথা ছড়াচ্ছে এই পালানো নিয়ে। এতে যেমন সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, তেমনি অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আমরা জনগণ সত্য-মিথ্যা জানি না। কেননা শত বছর ধরেই দেখছি, এই দেশে জনগণের কোনো মূল্যই নেই।

আমরা জানি দেশে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে। এমন ঘটনা পৃথিবীতে বিরল। আমরা জেনেছি, নতুন এক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে। অথচ সেইদিকে কারো নজর আছে বলে মনে হয় না।

প্রথম দিকে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের কথা বললেও এখন পর্যন্ত কোনো দলের সংস্কার আমরা প্রত্যক্ষ করিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কি এই 'নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত' বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দিয়েছে? সবাই দায়সারা গোছের কথাই বলে, কাজের কাজ কিছুই দেখি না। কেউই সেলফ লুকিং গ্লাসে নিজেকে দেখে না, আত্মসমালোচনার ধার ধারে না—একমাত্র প্রধান উপদেষ্টা ছাড়া।

আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ৪৭' পরবর্তী সময় থেকে এমনভাবে গড়ে উঠেছে, যেখানে বেশিরভাগ সময়ই সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা খুবই কম, কিছুক্ষেত্রে একেবারেই নেই।

৫২'র ভাষা আন্দোলন, যার সূত্রপাত বলতে হয় ১৯৪৮ সাল থেকেই। পাকিস্তান গণপরিষদে প্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদার দাবি তোলেন ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত এবং পূর্ব পাকিস্তান সংসদের কার্যক্রম বাংলায় করার দাবি তোলেন মওলানা ভাসানী। পূর্ব বাংলার মানুষের মুখের ভাষা বাংলা—এই প্রথম জনমানুষের কথা উচ্চারিত হয় এই দুজনের মুখ থেকেই। এ দেশের মানুষ কখনো কারও প্রভুত্ব মেনে নেয়নি। অথচ প্রথিতযশা রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের দাবির কথা মুখে বললেও যার যার সুপ্ত 'ব্যক্তি এজেন্ডা' বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই কাজ করছেন।

১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) সম্মেলনে প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয় স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার। অথচ, তৎকালীন ইত্তেফাক পত্রিকা পরেরদিন হেডলাইন করলো, 'রাষ্ট্রদ্রোহী মওলানা'। যদিও আমরা জানি, সেইসময়ে ইত্তেফাক ছিল আওয়ামী লীগেরই মুখপাত্র। ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানের সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতের বিচারে মওলানা ভাসানী, কাজী জাফর আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, মোস্তফা জামাল হায়দার, মাহবুবুল্লাহসহ আরও অনেকের সশ্রম কারাদণ্ডসহ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার রায় হয়।

১৯৭০ সালের নভেম্বরে পূর্ব বাংলার উপকূল অঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়। একমাত্র মওলানা ভাসানীই অসুস্থ অবস্থায় ছুটে গেলেন সেই মানুষের কাছে। পাকিস্তান থেকে কোনো সাহায্য আসেনি দুর্গত এলাকায়। সেখান থেকেই তিনি বললেন, ওরা কেউ আসেনি। ১৯৭০ সালে বাংলার ভাগ্য নির্ধারক নির্বাচনের তারিখ ডিসেম্বরের ১০। আওয়ামী লীগ থেকে শেখ মুজিব বললেন, ঘূর্ণিঝড়ের অজুহাতে নির্বাচন পেছানো যাবে না, পেছানো হলে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলা হবে।

যতবার মওলানা ভাসানী বাংলার স্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করেছেন, ততবারই পক্ষান্তরে শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছেন। অথচ তখন চারিদিকে জনমানুষের স্লোগান উঠেছিল, 'ব্যালট বাক্সে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো', 'পিণ্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা'।

এসব ইতিহাস জনমানুষের লড়াইয়ের ইতিহাস, জনগণের মুক্তির ইতিহাস। এগুলো অতি কৌশলে মুছে ফেলা হয়েছে, রচিত হয়েছে ব্যক্তির ইতিহাস, তৈরি করা হয়েছে কাল্টের রাজনীতি। সেইসব কলুষিত অধ্যায়ের বিরুদ্ধে জুলাই চার্টার, জুলাই আন্দোলন। এ কারণেই সর্বস্তরের জনগণ রাস্তায় নেমেছিল। আমরা ভেবেছিলাম, এই বুঝি আমাদের, সাধারণ জনগণের রাজনীতি আসবে; হয়তো এবার জনমানুষের কল্যাণের কথা বলবে; জনমানুষের চাওয়ার প্রতিফলন ঘটবে।

যে মানুষটাকে ধরে-বেঁধে বসানো হলো, সেই মানুষটা ব্যক্তিগত লোভহীন একজন মানুষ, ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বের একজন মানুষ। সেজন্যই হয়তো আমরা প্রত্যক্ষ করছি, এই মানুষটিকে টেনে নামানোর নানারকম ষড়যন্ত্ৰ, নানাবিধ চেষ্টা। পতিত ফ্যাসিস্ট, পালিয়ে যাওয়া ফ্যাসিস্টদের পদাঙ্কই যেন অনুসৃত হচ্ছে। একমাত্র প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস ছাড়া উপদেষ্টা পরিষদের বেশিরভাগই মনে হচ্ছে মানুষের পালস বুঝতে অক্ষম।

এখনো মানুষ চায় নিরাপত্তা, নাগালের মধ্যে দ্রব্যমূল্য, হত্যাকারীদের দ্রুত বিচার ও শাস্তি। সেইসঙ্গে মানুষ জানতে চায়, হত্যাকারীরা কীভাবে পালিয়ে গেল? মানুষ জানতে চায় ফ্যাসিস্টরা এখনো কীভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে সর্বত্র দেশকে অস্থিতিশীল করার সাহস পাচ্ছে?

যদি মানুষের এই চাওয়াগুলো মোকাবিলা না করতে পারেন, দয়া করে সসম্মানে পদত্যাগ করুন। তা না হলে শক্ত হাতে পরিস্থিতি মোকাবিলা করুন। জনগণ 'এখনো' আপনাদের সঙ্গেই আছে।

দেশটাকে আবারও সঠিকভাবে গড়ে তুলতে জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের রাজনৈতিক গুণীজন, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষ—সবাই যত দ্রুত এগুলো অন্তরে ধারণ করবেন, ততই সবার জন্য মঙ্গল।

ছিনতাইকারী, ডাকাতদের প্রতিহত করা শুরু করেছে সাধারণ মানুষ। তারা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে। মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে শুরু করেছে। সকলের সম্মিলিত শক্তি কতটা হতে পারে সেটা আমরা সবাই জেনেছি। সেই শক্তি যদি আবার জাগ্রত হয়, তাহলে কোনো হুমকি-ধামকি মানুষ আর সহ্য করবে না। গণঘেরাও কর্মসূচি শুরু হয়ে যাবে, তখন কিন্তু বাদ যাবে না কেউই।

আর কতবার এই জনপদের মানুষ প্রতারিত হবে? 'স্বর্গের প্রতারণা বারবার এইভাবে মেনেছে মানুষ।' (সেলিম আল দীনের শকুন্তলা)

তথ্যসূত্র: মেজবাহ কামাল সম্পাদিত 'স্বাধীনতা যুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা'

মাসুম বাসার: অভিনয়শিল্পী

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
donald trump tariff policy impact on america

Is the US winning under Donald 'Tariff' Trump?

President Trump has now been president for almost 100 days.

6h ago