যৌন নির্যাতনের শিশুর ছবি ও পরিচয় প্রকাশও অপরাধ

বাংলাদেশে ফেসবুকে, এমনকি কিছু মূলধারার গণমাধ্যমেও কখনো কখনো যৌন নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশ করা হচ্ছে। মাগুরার যৌন নিপীড়নের শিকার (ধর্ষিত শব্দটি কলংকলেপনমূলক, তাই ব্যবহার করছি না) ছোট্ট শিশুটির ক্ষেত্রেও তার নাম, পরিচয় এবং ছবি প্রকাশ করা হয়েছে কিছু গণমাধ্যমে।
কেউ সরাসরি নাম প্রকাশ করেছে, কেউ মায়ের নাম উল্লেখ করেছে, আবার কেউ শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদমুখর স্লোগান উদ্ধৃত করতে গিয়ে ওই শিশু ভিকটিমের নাম প্রকাশ করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার নাম, ছবি, ভিডিও—সবকিছুই প্রচারিত-প্রকাশিত হচ্ছে।
বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক! মহামান্য হাইকোর্ট ৯ মার্চ এ উদ্বেগকে আমলে নিয়ে মাগুরায় যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া ওই শিশুর সব ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে অপসারণের নির্দেশ দিয়েছেন। হাইকোর্ট বারবার সতর্কও করা সত্ত্বেও বন্ধ হচ্ছে না শিশু ভিকটিমের পরিচয় প্রকাশ-প্রচার। আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যৌন নিপীড়নের ভিকটিমদের ছবি এবং পরিচয় মিডিয়ায় প্রকাশ বন্ধ করতে সরকারকে প্রযোজনীয় ব্যবস্থা নিতে এর আগে ৮ মার্চ ২০২১ নির্দেশনা দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।
২০২১ সালের আগস্টে 'হিউম্যানিটিজ অ্যান্ড সোস্যাল সায়েন্সেস কমিউনিকেশনস' জার্নালে বাংলাদেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন বিষয়ক সংবাদের নৈতিক মান মূল্যায়ন সংক্রান্ত এক গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ছয়টি দৈনিকে প্রকাশিত শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের ১০৯৩টি সংবাদ/প্রতিবেদন পরিমাণগত আধেয় বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করে গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়। গবেষণাটি প্রমাণ পায় যে ৪০ শতাংশের বেশি সংবাদে নৈতিক মান অনুসারিত হয়নি। শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো পত্রিকায় বেশি অনৈতিকভাবে রিপোর্ট করা হয়েছে ব্যাখ্যামূলক বা গভীরতম থিমেটিক স্টোরির তুলনায় (৪২.৮% বনাম ১১.৬%)। ৩৭ শতাংশ সংবাদ ভিকটিমদের অন্তত একটি পরিচয় প্রকাশ করেছে। এসব পরিচয় এসেছে ভিকটিমের নাম, পিতা-মাতার নাম, পরিবারের সদস্যের নাম অথবা বিদ্যালয়ের নামের মাধ্যমে। ২৩ শতাংশ সংবাদে যৌন নির্যাতনের ঘটনার অতিরিক্ত বর্ণনা ছিল।
গবেষণায় সিদ্ধান্তে বলেছে, "বাংলাদেশি পত্রিকাগুলি প্রায়ই শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন সম্পর্কিত খবর নৈতিক রিপোর্টিংয়ের মান বজায় না রেখে প্রকাশ করে এবং এভাবে শিশুদের অধিকার উপেক্ষা করে।" যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুর ছবি ও পরিচয় প্রকাশ না করার পেছনে নৈতিক, আইনি, মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক অনেক বিষয় রয়েছে। এসব বিষয় সাংবাদিক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের বিবেচনা করা জরুরি।
আইনি বাধ্যবাধকতা ও নৈতিকতা
বাংলাদেশসহ অধিকাংশ দেশে যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুর পরিচয় প্রকাশ করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর ও অনুসমর্থনকারী প্রথম রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিচার ব্যবস্থা বা গণমাধ্যমেও ভিকটিম শিশুর নাম, ছবি বা এমন কোনো তথ্য প্রকাশ করা যাবে না, যা তাকে চিহ্নিত করতে সহায়তা করে। উক্ত সনদে এই গোপনীয়তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্য হলো শিশুটির মানসিক ও সামাজিক সুরক্ষা বজায় রাখা।
বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর ধারা ১৪-এ স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ধারা ১৪ (১) এ বলা হয়েছে: "এই আইনে বর্ণিত অপরাধের শিকার হইয়াছেন এইরূপ নারী বা শিশুর ব্যাপারে সংঘটিত অপরাধ বা তত্সম্পর্কিত আইনগত কার্যধারার সংবাদ বা তথ্য বা নাম-ঠিকানা বা অন্যবিধ তথ্য কোন সংবাদপত্রে বা অন্য কোন সংবাদ মাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ বা পরিবেশন করা যাইবে যাহাতে উক্ত নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ না পায়।"
১৪ (২) উপ-ধারায় বলা হয়েছে: "১৪ (১) এর বিধান লংঘন করা হইলে উক্ত লংঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের প্রত্যেকে অনধিক দুই বৎসর কারাদণ্ডে বা অনূর্ধ্ব এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।"
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটি নারী ও শিশুদের সুরক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধান, যা মিডিয়া মেনে চলতে বাধ্য। আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতা বিভিন্ন নীতিমালায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কোনো যৌন সহিংসতার শিকার শিশুর ছবি বা পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না। সাংবাদিকতার নীতিমালা প্রনয়ণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল যে সাংবাদিকদের জন্য আচরণবিধি তৈরি করেছে তাতে ভিকটিম শিশুর পরিচয় ও ছবি প্রকাশের ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি।
শুধু শিশু ভিকটিমের পরিচয় গোপন রাখা নয়, নারী ভিকটিমের নাম, পরিচয় ও ছবি প্রকাশ করা যাবে না। এমনকি, শিশু অপরাধী হলেও তার নাম-পরিচয় প্রকাশে বাধা ও শাস্তির বিধান রয়েছে শিশু আইন ২০১৩-এর ধারা ২৮ (১) এবং ধারা ৮১ (১), (২) (৩)-এ।
গোপনীয়তা, নিরাপত্তা ও মানসিক স্বাস্থ্য
যৌন নির্যাতনের শিকার শিশু এবং তার পরিবারের মানসিক ও সামাজিক নিরাপত্তার স্বার্থে পরিচয় গোপন রাখা জরুরি। পরিচয় প্রকাশ হলে শিশু ও তার পরিবার সামাজিক লজ্জা, অপমান ও হুমকির মুখে পড়তে পারে। শিশু ঘটনা ঘটার পর ভয়াবহ ট্রমার মধ্য থাকে এমনিতেই। তার ছবি বা পরিচয় প্রকাশ হলে সে আরও মানসিক চাপে পাড়ে বা আবারও ট্রমাটাইজ হতে পারে, যা তার সুস্থ হওয়ার পথে বড় বাধা হতে পারে।
ইনহোপ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সারাবিশ্বে হটলাইন স্থাপন করে ডিজিটাল জগৎ থেকে শিশুর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের উপাদান সনাক্তকরণ এবং অপসারণে সহায়তা করে থাকে। শিশুর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতন বিষয়ক রিপোর্টিংয়ের একটি নির্দেশিকা রয়েছে সংস্থাটির। ইনহোপ ওই নির্দেশিকায় সাংবাদিকদের জন্য অন্যতম পরামর্শ হচ্ছে: "শিশুর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতন এবং শিশু বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের উপাদান সংক্রান্ত রিপোর্ট করার সময়, গ্রাফিক বা যৌন বর্ণনা অন্তর্ভুক্ত করা এড়িয়ে চলুন। গ্রাফিক বিবরণ ভুক্তভোগীর জন্য উপকারী নয় এবং এমনকি ভুক্তভোগী পুনঃভিকটিম এবং পুনঃট্রমাটাইজড হতে পারে।"
আইন, বিজ্ঞান ও অপরাধ বিজ্ঞানের ভাষায়, শিশুর প্রতি সকল ধরনের যৌন নির্যাতন ও অনাচারই অপরাধ। অপরাধ অপরাধই। এক্ষেত্রে অপরাধের উচুস্তর বা নীচুস্তর নেই। মাগুরার শিশুটির বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের ঘটনাটি গণমাধ্যমে যৌন বর্ণনা অন্য শিশুকে আতংঙ্কিত করে। ওই শিশুর বিরুদ্ধে ঘটিত বিভৎস কাহিনী শুনে বা ছবি দেখে অন্য শিশুও ট্রমাটাইজ হতে পারে। শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
ইনহোপের ওই নির্দেশিকাসহ সকল মিডিয়া লিটারেচারের পরামর্শ হচ্ছে, গণমাধ্যমে যৌন নির্যাতনের ঘটনার বর্ণনা ভয় উৎপাদন করবে না বরং প্রতিকার-প্রতিরোধের অনুসঙ্গ থাকবে ঘটনার বয়ানে। ভাষার ব্যবহারে সেনসেশন সৃজন বা ঘটনার অতিরঞ্জিত করা থেকে বিরত থাকতে হবে যাতে করে ভিকটিম আবার ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। শিশুর ওপর যৌন নির্যাতনের মতো ভয়াবহ অপরাধের ক্ষেত্রে শুধু নাম-পরিচয় গোপন রাখা নয়, সংবাদকথনেও মুন্সিয়ানার পরিচয় দিতে হয় যাতে আরেকজন শিশু আতঙ্কিত না হয়ে ওঠে এবং তার মনোজগতের বিকাশে বাধা না আসে।
কলঙ্ক লেপন ও ক্ষতিকর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
অনেক ক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুরা সামাজিকভাবে হেয় হয়। তাকে জীবনের "কলঙ্ক" হিসেবে বয়ে বেড়াতে হয়। 'ধর্ষিতা নারী', 'ধর্ষিতা শিশু'—এমন কলঙ্ক লেপন করে আবারও ভিকটিমাইজ করা হয় তাদের। পুরুষশাসিত সমাজে এমন নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ হলে তার শিক্ষা, সম্পর্ক এবং কর্মজীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। স্কুলপাঠ বন্ধ হয়ে যায় এমন ঘটনাও ঘটে। প্রথম আলোর (২১ জানুয়ারি ২০২২) এক খবরে জানা যায়, রাজশাহীতে আট বছরের এক শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। আসামি গ্রেপ্তার হয়। কিন্তু বিপাকে পড়ে শিশুটির পরিবার। সামাজিকভাবে পরিবারটিকে হেয় করা হয়। এমনকি, শিশুটির আবাসিক মাদ্রাসায় ভর্তি বাতিল করারও অভিযোগ ওঠে।
এমনকি, যৌন নির্যাতিত শিশুর পরিচয় প্রকাশিত হলে পরবর্তীতে বিয়ে দেওয়া কঠিন হয় আমাদের সমাজে। এজন্য যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও অনেকে থানায় অভিযোগ করেন না, নিরবে কাঁদেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি হয়েছিল। পাকিস্তানী সৈন্যরা অনেক নারীকে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। অনেক নারী ও শিশুকে যৌন নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। অনেক নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে ক্যাম্প থেকে পরিবারে ফিরে এসেছে যুদ্ধের পর, কেউবা যুদ্ধ শিশুকে কোলে নিয়ে। এমনও ঘটনা ঘটেছে, ওইসব পরিবারের মধ্যে অনেক পরিবার ওইসব নারী ভিকটিমকে গ্রহণ করেনি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ভয়ে। নিজ কন্যাকে রেখে এসেছে পূর্ণবাসন কেন্দ্রে। স্বাধীনতা যুদ্ধে যৌন নির্যাতিত নারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক আচরণ সংক্রান্ত আমাদের এক গবেষণায় এমন চিত্রই পেয়েছি। আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ওইভাবেই এখনও গ্রথিত রয়েছে, খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে তা বলা যাবে না।
লজ্জা, ভয় ও ট্যাবু আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিতে মিশে আছে। যৌন সহিংসতার ক্ষেত্রে সামাজিক ভয়, লজ্জা ও ট্যাবু আরো বেশি। যৌন নির্যাতন নিয়ে ভিকটিম পরিবারের সমাজে কথা বলা খুবই কঠিন। ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের 'Guidebook For the Media On Sexual Violence Against Children' এই পর্যবেক্ষণই উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, "...a culture of silence and shame suppresses any discussion of children and sexual violence. A false notion of shame is the single largest culprit in perpetuating sexual violence against children in every society."
যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুর পরিচয় প্রকাশ করা মানে তার জন্য আরো নির্যাতন ও ট্রমা হাজির করা। তাই গণমাধ্যম, জনগণ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত তার পরিচয় গোপন রাখা এবং তাকে সহযোগিতা করা, যাতে সে একটি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। কীভাবে শিশু যৌন নির্যাতনের রিপোর্ট করা উচিত তা ইনহোপের মতো নির্দেশিকা,ক্যানবেরা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার পরামর্শ-নির্দেশনা বিবেচনায় নিয়ে দেশের প্রেক্ষিতে শিশুর ওপর যৌন নির্যাতন বিষয়ক রিপোর্টিং গাইডলাইন তৈরি করা প্রয়োজন।
সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সমাজের সকলের উচিত যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুর পরিচয়ের গোপনীয়তা রক্ষা করা, ছবি প্রকাশ-প্রচার থেকে বিরত থাকা যাতে তারা নিরাপদ ও, স্বাভাবিক জীবন ফিরতে পারে।
Comments