সেকেন্ড রিপাবলিক: নাগরিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রকল্প

অবশেষে জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন দলের আবির্ভাব ঘটেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র ও তরুণ নেতাদের উদ্যোগে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে এ দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। লাখো জনতার সমাবেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, কূটনীতিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম পাঠ করেন ঘোষণাপত্র। ঘোষণাপত্রে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) রাষ্ট্রকল্প ফুটে ওঠে। তবে সেকেন্ড রিপাবলিক ও গণপরিষদের দাবিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করার জন্যই নাকি গণপরিষদের দাবি সামনে আনা হয়েছে। এর মধ্যে দলটির কোনো কোনো নেতা 'গভীর ষড়যন্ত্র' খুঁজে পেতে চেয়েছেন। কেউ আবার দলের কর্মী-সংগঠকদের সাবধান ও সতর্ক থাকতে বলেছেন।
যেকোনো নতুন দলের নতুন দাবি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে কিছু পাল্টাপাল্টি বাক্য বিনিময় হবে—এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তবে নতুন দলের আগমনের প্রেক্ষাপটে যে ভাষায় বিএনপির অনেক নেতাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা গেল, তা দুঃখজনকই বলতে হবে। গণপরিষদের দাবির ব্যাপারে বিএনপির ভিন্নমত থাকতে পারে। কিন্তু ঠিক কেন ও কীভাবে গণপরিষদের দাবি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করার দুরভিসন্ধি হয়, তা স্পষ্ট নয়। আসলে নতুন দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, রাষ্ট্র কাঠামোর গণতান্ত্রিক সংস্কার না করে শুধু নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে গণতন্ত্র নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। নির্বাচনীব্যবস্থা বাংলাদেশে অতীতেও ছিল। কিন্তু কোনো দলকেই বাধ্য করা ছাড়া ক্ষমতাচ্যুত করা যায়নি। নির্বাচিত সরকারগুলোর হাত ধরেই এ দেশে অনির্বাচিত সরকার এসেছে। এ কারণে অনেক বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক ভিত্তি এবং সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রকে বহাল রেখে সংসদ নির্বাচন 'নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র' ছাড়া আর কিছু নয়।
বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব স্পষ্টতই 'গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া' বলতে কেবল ও কেবলমাত্র সংসদ নির্বাচনকে বুঝিয়ে থাকেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামোকে তারা হয় আমলে নিতে চান না, অথবা এর সুবিধা ভোগ করতে চান। এ কারণে এমনকি গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান অথবা নিদেনপক্ষে সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবিও তাদের কাছে 'ষড়যন্ত্র' ঠেকে।
সম্প্রতি প্রথিতযশা সম্পাদক নূরুল কবীর এক সম্পাদকীয়তে লিখেছেন, নির্বাচিত গণপরিষদের মাধ্যমে সংবিধান পরিবর্তন এবং গণভোটের মাধ্যমে জনগণ কর্তৃক সেই খসড়া সংবিধানের অনুমোদনই রাজনৈতিকভাবে সঠিক পন্থা। এ প্রক্রিয়ায় যদি প্রকৃতঅর্থেই একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন এবং রাষ্ট্র সংস্কার করা সম্ভব হয়, তাহলে সেটাই 'সেকেন্ড রিপাবলিক' হবে বলে নূরুল কবীর মনে করেন। সেকেন্ড রিপাবলিকের দাবির মধ্যে 'ষড়যন্ত্র' আবিষ্কার করা রাজনৈতিক বোঝাপড়ার ঘাটতি বলেও তিনি মত রাখেন। (সম্পাদকীয়, নিউ এজ, ২ মার্চ, ২০২৫)
এ পর্যায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে—নতুন দল এনসিপির সেকেন্ড রিপাবলিকের রূপকল্প আসলে কেমন?
প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের পর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান আন্দোলনে পূর্ব বাংলা অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেও পাকিস্তান রাষ্ট্রে তারাই শোষণ, বৈষম্য ও জুলুমের শিকার হয়। ফলে দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশের জনগণ একদলীয় বাকশাল, সামরিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে।
আশির দশকে সামরিক স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনে 'স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক' স্লোগান লিখে বুকের তাজা রক্তে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে এ দেশের ছাত্র-জনতা। স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনে ঘোষিত তিন জোটের রূপরেখাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট দলগুলো। সাময়িকভাবে নির্বাচনীব্যবস্থা হাসিল করা গেছে ঠিকই, কিন্তু প্রতিশ্রুত স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অধরাই থেকে গেছে। এর একটি বড় কারণ ১৯৭২ সালে প্রণীত একদলীয় ও স্বৈরতান্ত্রিক সংবিধানকে পরিবর্তনের কথা রাজনৈতিক দলগুলো কখনো বিবেচনা করেনি। বরং সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নামে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনেই নির্বাচনী রাজনীতি এগিয়ে নিয়েছে। এই ভুলের কারণে এমনকি নির্বাচনী ব্যবস্থাটুকুও নিরঙ্কুশ ও নিরবচ্ছিন্ন থাকেনি। নির্বাচিত সরকারের হাত ধরেই অগণতান্ত্রিক ও অনির্বাচিত সরকার দেশ শাসন করেছে। এক-এগারোর বিরাজনীতিকরণ এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এক-এগারোর সম্প্রসারণ আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে রাষ্ট্র গঠনের ব্যর্থতার আলোকেই বোঝা দরকার।
বিগত ১৫ বছর বাংলাদেশে এক নজিরবিহীন ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর চূড়ান্ত ধ্বংস নিশ্চিত করেছেন গণহত্যাকারী হাসিনা। গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র, আমলাতন্ত্র, মিডিয়া, সাংস্কৃতিক জগত ও অলিগার্ক ব্যবসায়ীদের নিয়ে হাসিনা গড়ে তুলেছিলেন এক ক্রিমিনাল সিন্ডিকেট। বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও অর্থপাচার রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির রূপ লাভ করে। লুটপাটের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করা হয়; ব্যাংকিং খাত থেকে শুরু করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সব ক্ষেত্রেই মেগা দুর্নীতির রেকর্ড গড়ে তোলে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন ক্রিমিনাল সিন্ডিকেট।
এই দীর্ঘ জুলুম ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে জনগণের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ সঠিক নেতৃত্ব ও রাজনীতির অপেক্ষায় ছিল। ২০২৪ সালে জানুয়ারির আগে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনে জনগণ সাড়া দেয়নি। তবে জনগণ ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচনকেও প্রত্যাখ্যান করেছে। ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার কারণে জনগণ অবগত যে, ভোটের দাবিতে আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে এবং ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে না। তাই ভোটের দাবিতে আন্দোলন রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজের শক্তিতেই করতে হবে। তারা সফল হতে পারলে জনগণ অবশ্যই ভোট দেবে। কিন্তু এ দাবিতে রাজনৈতিক দলগুলোর ডাকে জনগণ রাস্তায় নেমে জীবন দেবে না।
সম্পূর্ণ অপরিচিত ছাত্রনেতাদের ডাকে গত জুলাইয়ে কেন লাখো-কোটি জনগণ রাস্তায় নেমে এলো সেই বাস্তবতা আন্তরিকতার সঙ্গে অনুধাবন করা দরকার। ছাত্রনেতারা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনের দাবিতে জনগণকে রাজপথ দখল করতে বলেননি। তারা ফ্যাসিবাদী রেজিম ও ব্যবস্থার বিলোপের ডাক দিয়েছিলেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানে লাখো তরুণ রাস্তায় নেমে আসে, আর তাদের সমর্থনে দেশের আপামর জনতা তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। এক দফা আন্দোলনের তোপে গত ৫ আগস্ট গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তার দল আওয়ামী লীগ পরিণত হয় গুপ্ত দলে।
ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থান বাংলাদেশের জনগণের সামষ্টিক জীবনে একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটিয়েছে। দেয়ালে দেয়ালে তরুণরা লিখেছেন 'বাংলাদেশ ২.০', 'স্বাধীনতা এনেছি, সংস্কারও আনব'। তরুণদের এই আকুতি ও রূপকল্পগত দৃঢ়তাকে অবজ্ঞা করে নতুন বাংলাদেশে কোনো রাজনীতি দাঁড়াবে না।
জনগণের ঐতিহাসিক আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি নির্বাচিত গণপরিষদ গঠন করার প্রয়োজন পড়বে, যার দায়িত্ব হবে রাষ্ট্রের পুনর্গঠন এবং নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন। নব্বইয়ে প্রতিশ্রুত স্থায়ী গণতান্ত্রিক ধারা চব্বিশে বাস্তবায়ন করতে হবে, যেখানে রাষ্ট্রের নাগরিকদের ভোটাধিকার অবাধ ও সুরক্ষিত থাকবে। প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীই একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হবেন না। সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হবে দুর্নীতিমুক্ত, জবাবদিহিমূলক, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও জনসেবামুখী। আইনের দ্বারা বেআইনি শাসন নয়; বরং প্রকৃত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে সব নাগরিক সমান অধিকার ও মর্যাদা ভোগ করবে। অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার তথা লুটপাট ও বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে সাধারণ জনকল্যাণ নিশ্চিত করা হবে। সমাজ হবে দায় ও দরদের, যেখানে জনগোষ্ঠীর কোনো অংশকেই অপরায়ণের শিকার হতে হবে না। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে সমান গুরুত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
এই পুনর্গঠিত রাষ্ট্রই হবে দ্বিতীয় রিপাবলিক। এর মানে অতীতে সব গৌরবজনক ইতিহাস ও লড়াই-সংগ্রামকে অস্বীকার করা নয়। বরং এ জনপদের ঐতিহাসিক লড়াই ও বীরোচিত সংগ্রামকে চব্বিশের ঐতিহাসিক মুহূর্তে একীভূতকরণ। সাতচল্লিশ, একাত্তর ও নব্বইয়ের অধরা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ঐতিহাসিক দায় চব্বিশের ওপর বর্তায়। একে স্রেফ ক্ষমতার হাত বদলের মুহূর্তে সংকুচিত করা হবে শহিদের রক্তের সঙ্গে চরম বেঈমানি।
যারা সংসদ নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে, তারা কেন গণপরিষদ নির্বাচনের প্রস্তাবে 'ষড়যন্ত্র' খুঁজে পাচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়। এনসিপি এমন এক নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছে যার মধ্য দিয়ে নির্বাচিতরা প্রথমে সংবিধান প্রণয়ন অথবা সংস্কার করবে, তারপর সেই প্রণীত বা সংস্কারকৃত সংবিধানের অধীনে দেশ পরিচালনা করবে তথা সংসদ হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকবে। বিদ্যমান বাস্তবতায় এনসিপির এ প্রস্তাব ঐতিহাসিক। এর মাধ্যমে ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার যেমন হবে, রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনের দাবিও পূরণ করা সম্ভব হবে। সংস্কার ও নির্বাচন উভয়কে সমান গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়নের এর চেয়ে বাস্তবসম্মত ফর্মুলা আর হয় না। নতুন দাবি ও প্রস্তাবের মধ্যে ষড়যন্ত্র না খুঁজে নতুন দলের উত্থাপিত প্রস্তাবের মধ্যে হাজির থাকা মধ্যস্থতার সূত্র মোতাবেক ঐক্যের পরিবেশ সৃষ্টিতে রাজনৈতিক দলগুলো এগিয়ে আসবে—এমন প্রত্যাশা করা যেতেই পারে।
সারোয়ার তুষার: লেখক ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক
Comments