সংবাদপত্রের পাতায় চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের ঈদ

চুয়াত্তরের অক্টোবরে দৈনিক ইত্তেফাকের একটি প্রতিবেদন। ছবি: সংগৃহীত

বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তরের পর সবচেয়ে বড় দুর্ভিক্ষ হিসেবে ধরা হয় চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ সে বছর বন্যার কবলে পড়ে। খাবার ও কাজের সন্ধানে মানুষ শহরের দিকে ছুটতে থাকে। শুরু হয় অনাহারে মৃত্যুর মিছিল। এর সঙ্গে মহামারি যুক্ত হয়ে পরিস্থিতি হয়ে ওঠে আরও নাজুক। এছাড়া তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের খাদ্য ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি এবং মুষ্টিমেয় কিছু লোকের সীমাহীন লোভ মানুষের দুর্ভোগ বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। 

নিয়ম করে চুয়াত্তরেও ঈদ এসেছিল। কিন্তু দুর্ভিক্ষের মাঝে অনাহারী-অর্ধাহারী মানুষের কাছে সে ঈদ উৎসবমুখর ছিল না। সেই ঐতিহাসিক ঈদের দিনটি ঠিক কেমন কেটেছিল তা জানার অভিপ্রায়ে ওই সময়কার চারটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের তথ্য ও ছবি নিয়ে তৈরি হয়েছে এই লেখা।

সংবাদপত্রগুলো হলো- দৈনিক আজাদ, দৈনিক গণকণ্ঠ, দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক বাংলা।

দিনক্ষণ ও প্রেক্ষাপট

চুয়াত্তরের রমজান ছিল পূর্ণ ৩০ দিনের। শাওয়াল মাসের ১ তারিখ, অর্থাৎ ঈদের দিন ছিল— ১৮ অক্টোবর, শুক্রবার।

ঈদের দুয়েকদিন আগ থেকেই দৈনিক পত্রিকাগুলোতে লেখা শুরু হয় ঈদ নিয়ে। ১৭ অক্টোবর আজাদ 'আগামীকাল ঈদ' শিরোনামের প্রতিবেদনে লেখে, 'কালের চক্রের স্বাভাবিক ঘূর্ণনে প্রতিবারের মতো এবারও ঈদ উৎসব এসেছে ঠিকই, কিন্তু এ বছর সারা দেশের চেহারা হলুদ বিবর্ণ। চারিদিকে দারিদ্রতা ক্ষুধা ও মৃত্যু বিভীষিকার মধ্যে এবার বাংলাদেশে ঈদ উৎসব উদযাপিত হতে যাচ্ছে।

১৫ অক্টোবর গণকণ্ঠ 'এবারের ঈদ: একদিকে দুর্ভিক্ষ অন্যদিকে কালো টাকার দাপট' শিরোনামের প্রতিবেদনে  বিত্তবান এবং দুর্ভিক্ষের কষাঘাতে জর্জরিত জনতার মধ্যকার বৈষম্য তুলে ধরে।

১৭ অক্টোবর দৈনিক বাংলা'র সম্পাদকীয়তে বলা হয়, 'এমন নিরানন্দ পরিবেশে খুব কমই এসেছে ঈদ। সারাদেশ জুড়ে ক্ষুধা এবং বুভুক্ষার যন্ত্রণা। এবারের ঈদ আনন্দের বদলে বিষন্নতাকেই বড় করে তুলে ধরবে এদের জীবনে। অনিশেষিত দুঃখ এবং অক্ষমতা অশ্রু হয়ে ঝরবে অগণন চোখে। অথচ এই বিষন্ন পরিবেশেও ঈদের জৌলুসের এবং সমারোহের অভাব ঘটবে না অনেকের জীবনে। ঈদ আসবার অনেক আগে থেকেই কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করেছে এরা শাড়িতে, গয়নায় এবং ভুরিভোজের আয়োজনে। এদের হাবভাব দেখে মনে হবে না দেশে কোন কিছুর অভাব আছে,  দুর্গতির মধ্যে বাস করছে কোটি কোটি মানুষ।'

অর্থাৎ বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে ঈদ যে বেশিরভাগ মানুষের জীবনেই বয়ে আনতে পারেনি সুখের বার্তা তা চিত্রায়নের চেষ্টা ছিল পত্রিকার পাতায়। পাশাপাশি দুর্ভিক্ষের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতেও যে একদল মানুষ কালো টাকার গরমে ঈদের কেনাকাটা, আয়োজন উদযাপনে কমতি রাখছে না, তার‌ উপস্থিতিও ছিল।

দৈনিক বাংলা। ২১ অক্টোবরের পত্রিকা। ছবি: সংগৃহীত

ঈদের দিনের চিত্র

দুর্ভিক্ষের ঈদ কেমন হবে তা সহজেই অনুমেয়। তৎকালীন একাধিক দৈনিকের পাতায় ফুটেও উঠেছে কিছু বিভীষিকাময় চিত্র।

দৈনিক আজাদ'র বরাতে জানা যায়, সেবার ঈদুল ফিতরে দুয়েকটি আবাসিক এলাকা ব্যতীত অন্যান্য এলাকার মানুষের গায়ে নতুন জামা-কাপড় দেখা যায়নি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুসলমান জনসাধারণের অধিকাংশ‌ই কাপড়ের অভাবে ঈদের জামাতে অংশ নিতে পারেননি। এ থেকেই বোঝা যায় কতটা নির্মম ঈদ গেছে সেবার!

সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খাবারের আশায় রাজধানীতে ছুটে আসা বুভুক্ষু জনতা ঈদের দিনেও নেমেছিল ভিক্ষাবৃত্তিতে। ঈদের নামাজ শেষে মুসুল্লিদের হাতের দিকে তাকিয়ে ছিল ক্ষুধার্ত জনতা। কিন্তু কতজনকেই বা দিয়ে সন্তুষ্ট করা যায়!

ঝালকাঠিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দেড় হাজার শিক্ষক ঈদের পূর্ববর্তী দুই মাস বেতন পাননি। সেই দুর্ভিক্ষের সময়, খাদ্যদ্রব্যের মূল্যের চূড়ান্ত ঊর্ধ্বগতিতে দুই মাসের বেতন না পাওয়ায় কেমন কেটেছে সেই ১৫০০ শিক্ষকের ঈদ? এমন আরও কত শিক্ষক বেতন না পেয়ে অনাহারে অর্ধাহারে মারা গেছেন কে জানে!

চুয়াত্তরের ২১ অক্টোবরের ইত্তেফাক। ছবি: সংগৃহীত

ঈদের দিনে প্রাণহানি

গণকণ্ঠ'র প্রতিবেদন অনুসারে, কেবল রাজধানীতেই ঈদের দিন অনাহারে নয়জন মারা যায়। এর ভেতর ছিল একজন পুরুষ, ছয়জন নারী ও দুই শিশু। আর ঈদের আগে-পরে তিনদিনে মোট ৪১ জনের মৃত্যু হয় ঢাকাতে।

এর বাইরে দিনাজপুর, বগুড়াসহ দেশের প্রান্তিক অঞ্চলে কলেরা, পেটের পীড়া ও অনাহারে ঈদের দিন মারা যান বহুসংখ্যক মানুষ। উত্তরবঙ্গে ঈদের দিনে অনাহারে মৃত্যু হয় ২০ জনের। ফরিদপুরে ঈদের পুরো সপ্তাহজুড়ে মারা যান শতাধিক।

ঈদের নামাজ

সরকারি উদ্যোগে চুয়াত্তরে প্রধান ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় পল্টন ময়দানে। ইমামতি করেন মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগিশ। রাষ্ট্রপতি মুহম্মদ‌উল্লাহ্ পল্টনে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডি ক্লাব ময়দানের জামাতে অংশ নেন। এছাড়া বায়তুল মোকাররম, আরমানিটোলা ময়দান, লালবাগ শাহী মসজিদ, লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি ময়দান, পুরান ঢাকার বাংলাদেশ মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, জহুরুল হক হল এবং কেন্দ্রীয় খেলার মাঠেও ব্যবস্থা হয় ঈদের জামাতের। এর ভেতর কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের জামাতে নারীদের জন্য‌ পর্দার আড়ালে জামাতে অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল।

আজাদ ও ইত্তেফাক'র প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার মাওলানা ভাসানীর চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করায় তিনি ঈদের নামাজ আদায় করতে পারেননি। ঈদ উপলক্ষে তার পাহারায় দায়িত্বরত পুলিশের সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয়।

১৫ অক্টোবরের গণকণ্ঠ। ছবি: সংগৃহীত

খাদ্য বিতরণ

ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে রাজধানীর গেন্ডারিয়া, সদরঘাট, নারিন্দা, সিদ্দিক বাজার, যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও, মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, রাজারবাগ, নিউমার্কেট, ইসলামপুর, কমলাপুর, কলাবাগান, মগবাজার, বায়তুল মোকাররম, নয়াপল্টন ও কাঁঠাল বাগান এলাকায় ঈদের জামাতের পর জনসাধারণের মধ্যে খিচুড়ি ও গরুর মাংস বিতরণ করা হয়। ঢাকার ঐতিহাসিক নবাববাড়িতেও নবাববাড়ি কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে খিচুড়ি বিতরণ করা হয়।

সরকারের কার্যক্রম

ঈদ উপলক্ষে বিশেষ ট্রেন ও লঞ্চের ব্যবস্থা করে জনসাধারণের যাতায়াতকে সুগম করা সরকারের একটি স্বাভাবিক কর্তব্য। কিন্তু ১৯৭৪ সালের ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বিশেষ বা ট্রেন বা লঞ্চের ব্যবস্থা করেনি সরকার।

দৈনিক আজাদ ও গণকণ্ঠের প্রতিবেদন অনুসারে, ঈদের সময় নোয়াখালী ও রংপুরে রেশনের দোকানগুলো বন্ধ ছিল।

আবার সরকারি উদ্যোগে চালু হ‌ওয়া লঙ্গরখানাগুলোতে ঈদ উপলক্ষে যে বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল, তা চাহিদার তুলনায় ছিল খুবই অল্প।

ঈদের দিন সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য বঙ্গভবনের প্রধান ফটক খুলে দেওয়া হয় দুপুর ১২টায়। দুপুর ২টা পর্যন্ত জনসাধারণ বঙ্গভবনে ঢোকার সুযোগ পান।

ওই ঈদে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবন এবং রাষ্ট্রপতির কার্যালয় ও বাসভবনেও বিশেষ কোনো আয়োজন ছিল না।

দুটি গল্প

দৈনিক বাংলার খবর অনুসারে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের দারোয়ান ছিলেন বরিশালের আবদুল আজিজ। সবমিলিয়ে তার বেতন ছিল ৩০০ টাকা। দুই ছেলে, তিন মেয়ে, স্ত্রী ও তিনি নিজে মিলে সাতজনের সংসার। ৩০০ টাকা বেতন পাওয়ার পরও নতুন কাপড় এবং ঈদের বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করতে পারেননি।

তমু মিয়ার একমাত্র সন্তানের বয়স ছিল সাত। সে ঈদের দিন একটি কাগজের টুপি কিনে দেওয়ার বায়না ধরে। তমু মিয়া বায়না শুনে টুপির পরিবর্তে ছেলের গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দেন। ছেলের সাথে সাথে তমু মিয়াও নিজের অসহায়ত্বের যন্ত্রণায় কেঁদে ফেলেন। ইত্তেফাকের খবরে বলা হয়, সাংবাদিককে পেয়ে তমু মিয়া বলেন, 'ঘরে ভাত নাই। শিন্নি পায়েস খাওনের কথা ভাবি নাই। ঈদের দিন দশ পাই দিয়া পোলারে একটা কাগজের টুপিও কিন্যা দিতে পারলাম না।'

ঈদের বাজারে দুর্ভিক্ষের হানা

দুর্ভিক্ষের ঈদের বাজারে দ্রব্যমূল্য কেমন ছিল তা জানাও জরুরি। এ থেকে বোঝা যাবে, জনসাধারণের পক্ষে কেন সেই ঈদে উৎসবে মেতে ওঠা সম্ভব হয়নি।

গণকণ্ঠের প্রতিবেদন অনুসারে, চুয়াত্তরে ঈদের বাজারে নিত্যপণ্যের দাম ছিল কেজিপ্রতি এ রকম- চাল ৮ টাকা, ডাল ৬ টাকা, গম ৫ টাকা, চিনি ১২ টাকা, তেল ৩৬ টাকা, মরিচ ৪৮ টাকা, লবণ ৩ টাকা, গুড় ৭ টাকা, গোল আলু ৩ টাকা, পটল ৪ টাকা, বেগুন আড়াই টাকা, ১ পাউন্ড ডানো দুধ ২২/২৩ টাকা, গরুর দুধ ৫-৬ টাকা।

পোশাকের দাম‌ও ছিল তুলনামূলক বেশি। একটি প্যান্টের পিস ছিল সর্বনিম্ন ১৬০ টাকা; কাপড়ের গজ ১০/১২ টাকা থেকে বেড়ে হয় ১৫/১৬ টাকা; ফুটপাতের শার্ট ৪০/৪২ থেকে বেড়ে হয় ৬০/৬৫ টাকা।

সবমিলিয়ে বলা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশে সবচেয়ে দুর্বিষহ ও যন্ত্রণাদায়ক ঈদ ছিল চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের ঈদ। সে ঈদে উৎসবের বদলে জনগণ পেয়েছিল স্বজনের লাশ। আজ যখন আমরা স্বাভাবিক পরিবেশে আনন্দ উৎসবের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করছি, তখন সেই বিভীষিকাময় ঈদের কথাও স্মরণে রাখা কর্তব্য।

Comments