রাজনৈতিক দলে সংস্কারের জরুরি আলাপ কেউই করছে না

সরকার প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই জাতীয় এজেন্ডায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেয়েছে সংস্কার। পুরো দেশই এটা চায়। সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক বিষয় হলো, রাজনৈতিক দলগুলো—যারা সাধারণত নিজেদের প্রস্তাব ছাড়া অন্য কোনো কিছুকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন করে না—তারাও সংস্কার কমিশনগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে এবং ঐকমত্যে পৌঁছাতে আলোচনা করছে।
তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এখনো আলোচনার বাইরে। সেটা হলো, রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার। একটি রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রই নির্ধারণ করে দেয় যে তারা কী ধরনের গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে। সমাজেও এর প্রভাব ব্যাপক। যে দল ক্ষমতায় আসে, সেটির বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমেই নির্ধারিত হয় সংসদ, বিচার বিভাগ ও সাংবিধানিক অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে কাজ করবে। আমলাতন্ত্র, প্রায় সব সরকারি প্রতিষ্ঠান, বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, বড় ব্যবসায়িক চুক্তিগুলোতেও এর ব্যাপক প্রভাব আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—সব ধরনের কার্যক্রম সংবিধান অনুযায়ী হচ্ছে কি না, সেটা তারাই তদারকি করেন।
এটা অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, আমাদের গণতন্ত্র ও সুশাসনে দুরবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষত দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও জবাবদিহিতার অভাব।
১৯৯১ সালে এরশাদের পতন ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৩৩ বছর এ দেশ শাসন করেছে বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দুই বছর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল। বিএনপি ১০ বছরের বেশি সময় এ দেশ শাসন করেছে, যার এক মেয়াদে সঙ্গে ছিল জামায়াত। আওয়ামী লীগ শাসন করেছে ২১ বছর, যার ১৫ বছরই ছিল একটানা। এই সময় তাদের শরিক দলের নেতাদের অনেকে মন্ত্রিত্ব পেলেও নীতিনির্ধারণে তাদের ভূমিকা ছিল না বললেই চলে।
আজ সবাই বিএনপির দিকে তাকিয়ে, তাদের নিয়ে আলোচনায় এবং দলটিকে আরও ভালোভাবে বোঝার চেষ্টায়। ইতিহাস তাদের জন্য এমন দ্বার উন্মোচন করে দেবে, তাও আবার এত দ্রুত—সেটা কেউ কল্পনাও করেনি। এখন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি সবচেয়ে বেশি আসন পাবে, সেটাই ধরে নেওয়া যায়। কেবলমাত্র নিজেদের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার কারণেই এমনটা হবে, তা নয়। এমন কিছু হবে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণেও। এ জন্যই আজ আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু বিএনপি এবং দলটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা তারেক রহমান। কেননা দলটি আমাদের ভবিষ্যতের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে।
বিএনপির জন্য একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক, উদ্ভাবনী ভাবনাসম্পন্ন ও ভবিষ্যতমুখী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের এখনই উপযুক্ত সময়। তাদের হতে হবে জনআকাঙ্ক্ষা, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের নতুন প্রত্যাশা ও একবিংশ শতকের চাহিদার সঙ্গে মানানসই।
জনগণের মনে এখন প্রশ্ন—বিএনপি কী ধরনের সরকার হবে? তারা কি বর্তমান সময়ের, বিশেষত তরুণদের প্রত্যাশা সম্পর্কে সচেতন? এই দল কতটা গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা, ন্যায্যতা ও উন্মুক্ততার চর্চা করবে? তারা কি মুক্ত গণমাধ্যমকে সহ্য করবে?
সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটি আলোচিত তা হলো—তারেক রহমান কেমন নেতা হবেন?
এই প্রশ্নগুলো বিএনপির 'শত্রু'রা নয়, বরং তাদের মঙ্গলকামীরা তুলছেন।
শিক্ষার্থী ও তাদের নতুন নেতৃত্ব যখন বলছে, সংবিধান সংশোধন না করা হলে স্বৈরশাসন আবারও ফিরে আসবে—সেটা সম্পূর্ণ সঠিক। এর সঙ্গে আমরা যোগ করতে চাই, সংবিধান সংশোধন অবশ্যই ন্যায্য, কিন্তু কেবল সেটাই যথেষ্ট নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রেও পরিবর্তন আনতে হবে। বিশেষ করে বিএনপির—কারণ তারা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এবং বলা যায় যে, ক্ষমতার দোরগোড়ায়।
আমরা বিএনপির 'রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের রূপরেখা' শীর্ষক সংস্কার প্রস্তাবের ৩১ দফা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছি। এগুলোকে 'রাষ্ট্র' সংস্কারের প্রস্তাব বলা হলেও এর কিছু বিষয় অত্যন্ত দূরদর্শী ও প্রাসঙ্গিক। সেখানে অনেকগুলো 'কমিশন' গঠনের পরামর্শ আছে। অন্তর্বর্তী সরকারও একই উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তাদের প্রস্তাবের কোথাও দলীয় সংস্কারের বিষয়ে কিছু নেই—যেখানে তাদেরও সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। অতীতে আমরা দেখেছি, দলের ভেতরে গণতন্ত্র ও জবাবদিহিতা ছাড়া শাসন প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্র ও জবাবদিহিতা আনা সম্ভব না। সুতরাং এই বিষয়টি বিএনপির নিশ্চিত করা উচিত।
বাস্তবতা হলো—বিএনপির বর্তমান গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চেয়ারপারসনের হাতে রয়েছে প্রশ্নাতীত ক্ষমতা। চেয়ারম্যানের কর্তব্য, ক্ষমতা ও দায়িত্ব'র এক নম্বর ধারায় বলা হয়েছে—'দলের প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে চেয়ারম্যান দলের সর্বময় কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ, তদারক ও সমন্বয় সাধন করবেন এবং তদুদ্দেশ্যে জাতীয় কাউন্সিল, জাতীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, বিষয় কমিটিসমূহ এবং চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত অন্যান্য কমিটিসমূহের ওপর কর্তৃত্ব করবেন এবং তাদের কার্যাবলীর নিয়ন্ত্রণ, তদারক ও সমন্বয় সাধন করবেন।' চার নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, 'চেয়ারম্যান প্রয়োজন মনে করলে জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জাতীয় স্থায়ী কমিটি, বিষয়ভিত্তিক উপ-কমিটিরসমূহ এবং চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত অন্যান্য কমিটিসমূহ বাতিল করে দিতে এবং পরবর্তী কাউন্সিলের অনুমোদন সাপেক্ষে পুনর্গঠন করতে পারবেন।'
বিএনপির গঠনতন্ত্র চেয়ারপারসনকে একচ্ছত্র ক্ষমতা দিয়েছে, যার ফলে তিনি কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন।
এমন একটি দল কি সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হতে পারে? এই দলের মূল্যবোধ কি গণতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করে? দলের ভেতরে কি কারো ভিন্নমত থাকতে পারে না? এমন একটি দল যদি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তাহলে সেই সরকারের বৈশিষ্ট্য ও কাজের ধরন কী হবে? সেটা হবে একেবারে উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া পদ্ধতিতে পরিচালিত একটি সরকার—যার শীর্ষে থাকবেন কেবল একজন ব্যক্তি।
এমন একটি দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে সংসদ কীভাবে পরিচালিত হবে? সেটা আমরা জানি। কারণ, এমনই একটি দলকে আমরা ইতোমধ্যেই ক্ষমতায় দেখেছি, যাদের শাসনামলে পুরো দেশ চরমভাবে ভুগেছে। যদি দলীয় প্রধানের সিদ্ধান্তে নেতাকর্মীদের প্রশ্ন তোলার সুযোগ না থাকে এবং যদি নেতাকর্মীদের ভবিষ্যৎ পুরোপুরি দলীয় প্রধানের ওপর নির্ভর করে, তাহলে কেউ কি ভিন্নমত পোষণের সাহস দেখাবে? এমন অবারিত ক্ষমতা কি একনায়কতান্ত্রিক মানসিকতার জন্ম দেবে না—যার পরিণতি অদূর ভবিষ্যতেই ঘটতে পারে?
এমন একটি দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে সরকার গঠন করলে সেটা কি এক ব্যক্তির সরকার, এক ব্যক্তির সংসদ, এক ব্যক্তির রাষ্ট্র হয়ে উঠবে না? আমরা তো এমন অভিজ্ঞতা আগেও পেয়েছি, এমন ধরনের শাসনামল পার করেছি এবং তীব্র শোষণের শিকার হয়েছি।
এমন সম্ভাবনা পরিবর্তনের যে ব্যাপক জনদাবি, বিএনপি কি সেটা উপেক্ষা করতে পারে? এটা কি তাদের জন্য বুদ্ধিমত্তার কাজ হবে?
ইতোমধ্যেই কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিত দেওয়ার জন্য আমরা তারেক রহমান ও বিএনপিকে সাধুবাদ জানাই। তার বক্তব্যগুলো আমার কাছে যুক্তিসঙ্গত ও পরিণত মনে হয়েছে। 'অত্যাচারকারীর ওপর প্রতিশোধ নয়, সংস্কার চাই' বলে গত বুধবার তিনি যে ভাষণ দিয়েছেন, তা অত্যন্ত প্রশংসাযোগ্য। যুক্তরাজ্যে বাধ্যতামূলক নির্বাসনের সময়টা তিনি যথাযথভাবে কাজে লাগিয়েছেন বলেই মনে হয়। ভাষার ব্যবহারে তিনি ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুজনই যে সংযম দেখিয়েছেন, তা প্রশংসার যোগ্য। আওয়ামী লীগ ও ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনা তাদের প্রতি যে অপমান ও অবিচার করেছেন, তা সহজেই প্রতিহিংসামূলক ভাষার জন্ম দিতে পারত। কিন্তু তারা তা করেননি এবং রাজনৈতিক আলোচনা ও বিতর্ককে একটি নতুন মর্যাদা দিয়ে চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর জন্য টানা সর্বোচ্চ দুই মেয়াদ এবং একবার বিরতি দিয়ে পুনরায় নির্বাচনের সুযোগ রাখার যে প্রস্তাব তারেক রহমান দিয়েছেন, তা বর্তমান পরিস্থিতির চেয়ে ভালো। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমিয়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধির যে চিন্তা তিনি প্রকাশ করেছেন, সেটাও ইতিবাচক। একটি উচ্চকক্ষ গঠনের ধারণাও অত্যন্ত ইতিবাচক। কিন্তু, এর সদস্যপদ যদি যথাযথ অনুপাতে নির্ধারিত না হয়, তাহলে সেটাও নিম্নকক্ষের মতোই হয়ে যাবে এবং সরকারকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার কাজটিও বাধাগ্রস্ত হবে।
আর এর সবই লোক দেখানো পরিবর্তন হয়ে থাকবে, যদি প্রকৃত ক্ষমতায় পরিবর্তন না আসে।
আর সেই জন্যই প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান এবং সংসদ নেতা এই তিনটি পদ একজনের হাতে থাকা উচিত না। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা একই ব্যক্তি হলেও প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান অবশ্যই আলাদা হওয়া উচিত। দল পরিচালনা ও সরকার পরিচালনার ক্ষমতা দুটি ভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে হওয়া উচিত। এতে নেতৃত্ব বিকাশে সহায়তা হয়, প্রধানমন্ত্রীকে অন্য মতামতের সামনে দাঁড় করায় এবং তাকে দলীয় ভাবনার প্রতি সংবেদনশীল করে তোলে। তা না হলে সবকিছু একক প্রদর্শনীতে পরিণত হয়, যার ফলে ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহার হয়। এমনকি অনেক সময় অতি ক্ষমতাবান হয়ে ওঠা সেই ব্যক্তি নিজেও এই পরিস্থিতি বুঝতে পারেন না।
তারেক রহমানকে অবশ্যই তার সামনে থাকা এই বিরল সুযোগ এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জটিল চ্যালেঞ্জগুলো পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে হবে। আমাদের অনুরোধ, তিনি যেন তার হাতে থাকা দলীয় কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বাস্তবতা উপলব্ধি করেন এবং দলীয় কাঠামোর ভেতরে বিকল্প মত বা এমনকি ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি করেন—যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কোনো হুমকির মুখে না পড়ে।
অনেকে বলতে পারেন, এমন সুযোগ দিলে শৃঙ্খলাভঙ্গের ঝুঁকি তৈরি হবে। হ্যাঁ, সেটা হতে পারে। কিন্তু, এই সুযোগ না থাকলে দলে কোনো সৃজনশীলতা ও উদ্দীপনা থাকবে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে কেবল জন্ম নেবে মোসাহেব। আমরা দেখেছি এই কারণেই আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোই ধ্বংস করেননি, তিনি গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্যবাহী নিজের দলটিকেও ধ্বংস করে দিয়েছেন।
বিএনপি উচিত আওয়ামী লীগের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়া। তারেক রহমান কিছু সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন এবং এখন তার কাজের মধ্যে অন্যতম হওয়া উচিত, দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।
মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
Comments