ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা: সুবিধার পাশাপাশি বাড়ছে উদ্বেগ?

ছবি: সংগৃহীত

আধুনিক হাসপাতালের আলোকিত করিডোর থেকে শুরু করে গ্রামের নিঃশব্দ কোণায়, বাংলাদেশে এক নীরব স্বাস্থ্য বিপ্লব ঘটে চলেছে। ঢাকার শহুরে ক্লিনিক থেকে নেত্রকোণার গ্রামের ঘর পর্যন্ত—স্মার্টফোন এখন স্টেথোস্কোপে পরিণত হয়েছে। আর স্মার্টওয়াচের মতো পরিধেয় যন্ত্রগুলো যেন সারাক্ষণ নজরদারিতে থাকা স্বাস্থ্য পাহারাদার। অ্যাপ, ওয়্যারেবল ডিভাইস ও টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে ডিজিটাল স্বাস্থ্য প্রযুক্তি ধীরে ধীরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠছে।

স্বাস্থ্য এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। স্মার্টওয়াচ হৃৎস্পন্দন মাপছে। মোবাইল অ্যাপ বলে দিচ্ছে রক্তচাপ কেমন। আর ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া যাচ্ছে ঘরে বসেই। বাংলাদেশে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার এই উত্থান নিঃসন্দেহে বিপ্লবাত্মক। কিন্তু এই সুবিধার আড়ালে বাড়ছে না তো এক ধরনের নতুন সমস্যা? যাকে আমরা বলছি 'ডিজিটাল মেডিক্যালাইজেশন', যেখানে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার প্রতিটি ছোটখাটো অনুভূতিও 'চিকিৎসাযোগ্য সমস্যা' হিসেবে দেখা শুরু হয়, আর আমরা নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি প্রযুক্তির ওপর।

আপাত দৃষ্টিতে এসব প্রযুক্তির সুবিধা অনেক বড় ও জরুরি। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে প্রতি ১০ হাজার জনে মাত্র ৬ জন চিকিৎসক রয়েছেন, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশের তুলনায় অনেক কম। সেখানে টেলিমেডিসিন সেবা লাখ লাখ মানুষকে চিকিৎসার সুযোগ এনে দিচ্ছে। ওয়্যারেবল ডিভাইস আর ফিটনেস অ্যাপের মাধ্যমে মানুষ এখন নিজের রক্তচাপ, রক্তে চিনির মাত্রা, হার্টবিট ইত্যাদি মাপতে পারছেন। ফলে স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা অনেক বেড়েছে।

এই প্রযুক্তি স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে যেসব এলাকা চিকিৎসার দিক থেকে বঞ্চিত সেখানে আশীর্বাদ হিসেবে হাজির হয়েছে। মানুষ এখন নিজের দীর্ঘমেয়াদি রোগ নিজেই পর্যবেক্ষণ করতে পারছে। ভার্চুয়াল ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারছে। সচেতনভাবে নিতে পারছে স্বাস্থ্য বিষয়ক যেকোনো সিদ্ধান্ত। করোনা মহামারির সময় এই পরিবর্তন আরও দ্রুত হয়েছে। কারণ হাসপাতালগুলো তখন ছিল ভীষণ চাপে।

তবে এই ডিজিটাল পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে আরেকটি উদ্বেগজনক দিক—আমাদের প্রতিদিনের জীবন যেন 'চিকিৎসাকেন্দ্রিক' হয়ে উঠছে। কেননা বাংলাদেশের মতো একটি দেশে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত জ্ঞান এখনো অনেকেরই সীমিত। 
আর ইন্টারনেটে ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ে অনায়াসেই। সেখানে মানুষ যখন নিজেদের শরীর সম্পর্কে জানতে চায়, তখন অনেকেই গুগলে সার্চ করে নিজের রোগ 'নিজেই' নির্ণয় করছে। সামান্য বুক ধড়ফড় করলেই ডিভাইসের সতর্কতা দেখে সে ধরে নিচ্ছে হার্ট অ্যাটাক হতে যাচ্ছে। মাথা ধরলে মনে করছে মস্তিষ্কে টিউমার হয়েছে। এই 'সেলফ-ডায়াগনোসিস' ও স্বাস্থ্যভীতি এখন অনেকের জীবনের অংশ হয়ে যাচ্ছে।

আরও চিন্তার বিষয় হলো—সুস্থতা আর অসুস্থতার মাঝে যে সীমারেখা ছিল। কিন্তু তা ক্রমেই আবছা বা নাই হয়ে যাচ্ছে। অনেক ফিটনেস অ্যাপ স্কোর দেখিয়ে ব্যবহারকারীদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, তাদের শরীর যেন ঠিক নেই। ফলে মানুষের মধ্যে শরীর নিয়ে অযথা চিন্তা ও হীনমন্যতা তৈরি হচ্ছে। আগে মানুষ ডাক্তারকে ভরসা করত। এখন তারা 'অ্যাপের' কথা বেশি গুরুত্ব দেয়। এতে করে আমরা প্রযুক্তির ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। মানবিক ও সংবেদনশীল চিকিৎসাবোধ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। কেননা গুগলে উপসর্গ লিখলেই হাজারো রোগের নাম চলে আসে! হাতের ঘড়ি দেখাল হৃৎস্পন্দন একটু বেড়েছে, অ্যাপ বলল রক্তচাপ কম। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় আসে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ভয়।

মনোবিজ্ঞান বলে, মানুষের মস্তিষ্ক সহজাতভাবে নেতিবাচক তথ্যের দিকে বেশি আকৃষ্ট হয়। সামান্য অস্বস্তিকে গুরুতর রোগের লক্ষণ ভেবে ফেলি আমরা। বিশেষ করে যাদের মধ্যে স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত উদ্বেগ বা হাইপোকন্ড্রিয়ার প্রবণতা আছে, তাদের জন্য এই সতর্কবার্তা এবং ইন্টারনেটের অসংখ্য তথ্য বিষবাষ্পের মতো কাজ করে। তারা নিজেরাই রোগ নির্ণয় করে ফেলেন, ভুল চিকিৎসা নেন বা অপ্রয়োজনে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন, যা স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে।

এই অ্যাপ ও ডিভাইসগুলো আমাদের ক্রমাগত নিজের শরীরের ডেটা পর্যবেক্ষণ করতে উৎসাহিত করে। আচরণগত বিজ্ঞান আমাদের শেখায়, এই প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ নিজের প্রতি অতিমাত্রায় সচেতনতা তৈরি করে। প্রতিদিন হৃৎস্পন্দন, ঘুমের মান, ক্যালোরি খরচ দেখা—স্বাভাবিক ওঠানামাকেও অস্বাভাবিক মনে হতে থাকে। এই অ্যাপগুলো প্রায়শই ডিজাইন করা হয় ব্যবহারকারীকে যত বেশি সম্ভব সময় সেখানে রাখার জন্য। ফলাফল? আমাদের মস্তিষ্কে বারবার ভেসে ওঠে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত চিন্তা, বাড়ে উদ্বেগ। একটি বাণিজ্যিক স্বার্থও কাজ করে—যত বেশি মানুষ নিজেকে 'অসুস্থ' ভাববে, তত বেশি তারা স্বাস্থ্য পণ্য ও সেবা কিনবে।

এই ডিজিটাল স্বাস্থ্য-আসক্তির কারণে মানুষের মানসিক ও স্নায়বিক ক্ষতি হতে পারে। যখন মস্তিষ্ক বারবার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সতর্কতা পায়, তখন সেটা অতিরিক্ত সতর্ক হয়ে যায়—যা দীর্ঘমেয়াদে উদ্বেগ বা অ্যাংজাইটি তৈরি করে। বাংলাদেশের শিশু ও কিশোররা এখন ছোট থেকেই স্বাস্থ্য অ্যাপ ও ট্র্যাকারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে—যার ফলাফল ভবিষ্যতে আরও গভীর হতে পারে: শরীর নিয়ে দুশ্চিন্তা, বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি এবং অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেই চিকিৎসার মতো পরিচয় গড়ে উঠছে।

চিকিৎসা শুধু ল্যাব রিপোর্ট বা ডেটা পয়েন্টের সমষ্টি নয়। এটি একটি গভীর মানবিক প্রক্রিয়া। একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার শুধু উপসর্গই দেখেন না, দেখেন রোগীর চোখের ভাষা, কণ্ঠের ভঙ্গি, জীবনযাত্রার গল্প, সামাজিক প্রেক্ষাপট। টেলিমেডিসিন বা অ্যাপ এই সূক্ষ্ম মানবিক যোগাযোগের জায়গাটি পুরোপুরি ধরতে পারে না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের মানবিক দিক আমাদের মনে করিয়ে দেয়, রোগীর সঙ্গে আস্থা, সহানুভূতি এবং গভীর বোঝাপড়ার সম্পর্ক গড়ে তোলা অপরিহার্য। প্রযুক্তির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা এই মূল্যবান সম্পর্ককে দুর্বল করে দিতে পারে। আমরা ভুলে যেতে পারি যে সুস্থ থাকা মানে শুধু ডিজিটাল স্ক্রিনে সবুজ আলো জ্বলা নয়, বরং সামগ্রিকভাবে ভালো থাকা।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের মাঝে ডিজিটাল সাক্ষরতার ঘাটতি আছে। ফলে অনেক ব্যবহারকারী অ্যাপ বা ডিভাইস থেকে পাওয়া তথ্য সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন না বা ভুল তথ্য চিনতে পারেন না। অন্যদিকে সব হেলথ অ্যাপ বা টেলিমেডিসিন প্ল্যাটফর্মের মান এক নয়। কারো কারো চিকিৎসাগত ভিত্তি দুর্বল। এছাড়া আমাদের সংস্কৃতিতে আরোগ্য বা রোগ নিরাময়ের প্রশ্নে 'ভালো ডাক্তার'-এর ওপর ব্যক্তিগত আস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তি এই সম্পর্ককে সহায়তা করবে, নাকি প্রতিস্থাপন করবে? এটি একটি মৌলিক ও জরুরি প্রশ্ন। এছাড়া ইতোমধ্যেই চাপে থাকা স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়, ডিজিটাল মাধ্যম থেকে আসা ভুল তথ্যের ভিত্তিতে উদ্বিগ্ন রোগীদের ঢল পরিষেবার মানের ওপর বাড়তি চাপ ফেলতে পারে।

কাজেই ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার সুবিধাকে অস্বীকার করার প্রশ্নই ওঠে না। তবে এর ব্যবহার হতে হবে সচেতন ও ভারসাম্যপূর্ণ। এজন্য জরুরি হলো শিক্ষা ও সচেতনতা বাড়ানো, স্বাস্থ্য অ্যাপের গুণমান নিশ্চিত করা, ডিজিটাল স্বাস্থ্য সাক্ষরতা বাড়ানো, মানবিক স্পর্শকে অগ্রাধিকার দেওয়া, হেলথ অ্যাপ নিয়ন্ত্রণ, ডিজিটাল স্বাস্থ্য সহায়ক প্রশিক্ষণ, ডাক্তার ও প্রযুক্তির সমন্বয় এবং সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ।

প্রথমেই মানুষকে শেখাতে হবে যে এই ডিভাইস ও অ্যাপগুলো শুধুমাত্র তথ্যদাতা, নির্ণায়ক বা চিকিৎসক নয়। তাদের সীমাবদ্ধতা বুঝতে হবে। সরকারকে স্বাস্থ্য অ্যাপ ও টেলিমেডিসিন প্ল্যাটফর্মের জন্য স্পষ্ট মানদণ্ড ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো তৈরি করতে হবে। কীভাবে নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্য তথ্য চিনতে হয়, কীভাবে ডিজিটাল ডেটাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে হয়—সেই শিক্ষা প্রচার করতে হবে। প্রযুক্তিকে ডাক্তার-রোগী সম্পর্ককে শক্তিশালী করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে, প্রতিস্থাপনকারী হিসেবে নয়। মুখোমুখি সাক্ষাতের গুরুত্ব কমবে না। স্বাস্থ্য শুধু ডেটা বা অ্যাপ নয়। পুষ্টিকর খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম, মানসিক সুস্থতা এবং সামাজিক সংযোগ—এসবের গুরুত্বও সমান।

অনেক অ্যাপ দেশে যাচাই না করেই ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশের মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল এবং আইসিটি বিভাগ মিলে এই অ্যাপগুলোর মান নিয়ন্ত্রণে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে। গ্রামের কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কারদের ডিজিটাল প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করতে হবে, যাতে তারা সাধারণ মানুষকে এসব অ্যাপ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে শেখাতে পারেন। এমন মডেল চালু করতে হবে যেখানে টেলিমেডিসিন এবং সরাসরি চিকিৎসা একসঙ্গে চলে। রোগী যেন বুঝতে পারেন, অ্যাপ শুধুই সহায়ক—ডাক্তারই মূল সিদ্ধান্তদাতা।

বাস্তবতা হলো—ডিজিটাল স্বাস্থ্যপ্রযুক্তি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশের সুযোগ বাড়িয়েছে। কিন্তু এর আলো আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিলে চলবে না। আমাদের বুঝতে হবে, এই প্রযুক্তির আড়ালে লুকিয়ে থাকা মনস্তাত্ত্বিক ফাঁদ, সামাজিক প্রভাব এবং মানবিক সম্পর্কের ক্ষতির সম্ভাবনা। প্রযুক্তিকে আমাদের দাস বানানো চলবে না। বরং আমরা হবো এর সচেতন ব্যবহারকারী। কেননা প্রযুক্তি নিজে ভালো বা খারাপ নয়। আমরা যেভাবে ব্যবহার করি, সেটাই ঠিক করে এর প্রভাব। কাজেই আমরা যেন মানুষ হিসেবে নিজেদের অনুভব, সম্পর্ক, আর যত্নকে ভুলে না যাই।

আমাদের মনে রাখতে হবে স্বাস্থ্য মানে শুধু সংখ্যা নয়। বরং স্বাস্থ্য মানে বেঁচে থাকার অর্থময়তা, অন্যের সঙ্গে সংযোগ, আর সহানুভূতি। একটি জরুরি ডায়ালগ শুরু করার সময় এসেছে—কীভাবে আমরা ডিজিটাল স্বাস্থ্যকরণের ঝুঁকি মোকাবিলা করে প্রযুক্তির সুবিধাকে সর্বোচ্চ কাজে লাগিয়ে সবাইকে নিয়ে একটি সত্যিকারের সুস্থ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রযুক্তির সাহায্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানো, স্বাস্থ্য উদ্বেগ নয়। সামাজিক আলোচনা শুরু হোক। আসুন, প্রযুক্তিকে এমনভাবে ব্যবহার করি, যাতে সেটা আমাদের সেবা করে, আমাদের নিয়ন্ত্রণ না করে।

মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম: জনস্বাস্থ্য ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের সিনিয়র লেকচারার।

Comments

The Daily Star  | English

Money laundering: NBR traces Tk 40,000cr in assets abroad

The National Board of Revenue has identified overseas assets worth nearly Tk 40,000 crore, accumulated with money laundered abroad from Bangladesh, according to the Chief Adviser’s Office.

30m ago