হাথুরুসিংহের সামনে যত চ্যালেঞ্জ
২০১৭ সালে যখন চাকরি ছেড়ে চলে যান, তখন চন্ডিকা হাথুরুসিংহের আচরণে কষ্ট পেয়েছিলেন বোর্ড কর্তারা। অনেকটা রূঢ়ভাবে বাংলাদেশকে বিদায় বলে চলে গিয়েছিলেন তিনি। স্পষ্ট জানিয়ে গিয়েছিলেন, এখানে আর দেওয়ার নেই কিছুই। সাড়ে পাঁচ বছর পর সেই একই ভূমিকায় আবার তার ফেরার অপেক্ষায় বাংলাদেশের ক্রিকেট।
আজ (সোমবার) রাত ৯টায় ঢাকায় নামবেন দ্বিতীয় দফায় প্রধান কোচের দায়িত্ব নেওয়া হাথুরুসিংহে। আগের দফায় সেরা কিছু সাফল্য আনলেও বিতর্কও তৈরি করেছেন প্রবল, শেষটাও হয়নি সুন্দর। তবু তাকে ফিরিয়ে না আনা ছাড়া যেন উপায় দেখছিল না বিসিবি।
ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের যুগে শতভাগ সময় দেওয়া, বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত একজনের উপর দায়িত্ব দেওয়ার স্বস্তি পেতে চেয়েছিল বোর্ড। ক্রিকেট অপারেশন্স চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস এই কোচের ফেরায় তাই আসন্ন ওয়ানডে বিশ্বকাপের জন্য বড় সুবিধা দেখছেন, 'আমরা সবাই জানি হাথুরুসিংহে বাংলাদেশের ক্রিকেট ও খেলোয়াড়দের চিনে, জানে ও বুঝে।'
'আসন্ন ইংল্যান্ড সিরিজে সে পর্যবেক্ষণ করবে। সে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। এখনো যেহেতু বিশ্বকাপের সাত-আট মাস বাকি আছে। আমাদের জন্য এটা একটা সুবিধা যে তার আগেই আমরা তাকে পেয়ে গেছি।'
ক্রিকেট বোর্ডের পূর্ণাঙ্গ আস্থা পেলেও লঙ্কান এই 'কড়া হেডমাস্টারকে' সামলাতে হবে কঠিন কিছু চ্যালেঞ্জ।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোচিংয়ের গ্যাপ
আগের দফার দায়িত্বে কয়েকজন খেলোয়াড়ের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হলেও তার কোচিং দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল না কারো। বিশেষ করে ট্যাকটিশিয়ান হিসেবে আলাদা একটা কদরই আছে এই লঙ্কানের। মুশকিল হলো, আর সব কিছুর মতো ক্রিকেটও প্রতিনিয়ত পাল্টাচ্ছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোচিংয়েও নিশ্চিতভাবেই এসেছে অনেক নতুনত্ব। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার পর শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব নেন হাথুরুসিংহে। ২০১৮ সালে নানাবিধ বিতর্কে তাকে চাকরীচ্যুত করে লঙ্কান বোর্ড। এরপর থেকে আর আন্তর্জাতিক কোচিংয়ে ছিলেন না তিনি।
গত বছর চারেক ধরে অস্ট্রেলিয়ার রাজ্য দল নিউ সাউথ ওয়েলসের সহকারি কোচের ভূমিকা পালন করেছেন হাথুরুসিংহে। বাংলাদেশে ফেরার আগ পর্যন্ত সেটাই ছিল তার ভূমিকা। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চার বছরের একটা গ্যাপ পড়ে গেছে এই কোচের। ঘাটতিটা তিনি কীভাবে পূরণ করতে পারেন তা হবে প্রথম চ্যালেঞ্জ।
ক্রিকেটারদের সঙ্গে সম্পর্ক
২০১৭ সালে তার না চাওয়াতেই মাশরাফি বিন মর্তুজা এগিয়ে নিতে পারেননি টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার। শ্রীলঙ্কা সফরে মাশরাফির আকস্মিক অবসরে পরোক্ষ ভূমিকা ছিল হাথুরুসিংহের। এরপর থেকে সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতির খবর পাওয়া যায়। তখনই তিনি মুশফিককে বাদ দিতে চেয়েছিলেন টি-টোয়েন্টি থেকে, মাহমুদউল্লাহকে রাখতে চাননি টেস্টে। অবশ্য এই ক'বছর পর কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে নেই পাঁচ সিনিয়রের চারজনই। দিনের পর দিন পারফরম্যান্স প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় এক পর্যায়ে গিয়ে তারা কেউ কেউ স্বেচ্ছায় থেমেছেন, কাউকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিসিবির উচ্চ পর্যায়ের কর্তাদের অনেকেরই মত, হাথুরুসিংহে তখনই আগামী দেখতে পেয়েছিলেন।
টি-টোয়েন্টিতে না থাকলেও ওয়ানডেতে চারজনকে এবারও পাবেন তিনি। চলতি বছর আছে ওয়ানডে বিশ্বকাপ, দ্বি-পাক্ষিক ওয়ানডেও আছে প্রচুর। আগামী ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর চার সিনিয়রের অনেকের ক্যারিয়ারের সমাপ্তিও ঘটতে পারে তার নতুন মেয়াদে। তাদের সঙ্গে হাথুরুসিংহের সম্পর্ক কেমন হতে যাচ্ছে, সেটাও একটা কৌতূহলের বিষয়।
আরও একবার দর্শকপ্রিয় এসব ক্রিকেটারদের সামলানোর একটা চ্যালেঞ্জের সামনে পড়তে যাচ্ছেন তিনি। অভিজ্ঞতা, পারফরম্যান্স, বয়স, আর আগামী পরিকল্পনার অনেকগুলো প্যারামিটার মাথায় নিয়ে কঠিন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে তাকে। সেটা তিনি কীভাবে নেন, কতটা শক্ত অবস্থায় থাকেন তা দেখার বিষয়।
হাথুরুসিংহে পুরো অথরিটি নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন, দল নির্বাচনেও তাই প্রত্যক্ষ ভূমিকায় দেখা গেছে তাকে। বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন আবার তাকে এমন ক্ষমতা দেন কিনা, কিংবা তিনি সেটা আদায় করেন কিনা তা জানতে আগ্রহী ক্রিকেটাররাও।
সাকিব-তামিম 'ইস্যু'
শীর্ষ তারকা সাকিব আল হাসানের সঙ্গে পারফরম্যান্স নিয়ে কোন সমস্যা কারোরই হওয়ার কথা না, হাথুরুসিংহেরও ছিল না। তবে শৃঙ্খলতাজনিত কারণে সাকিবের আচরণ নিয়ে তিনি বিরক্ত ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ সিরিজে তার খেলা, না খেলা নিয়েই এখনো তৈরি হয় সংশয়। কড়া 'টাস্কমাস্টার' হাথুরুসিংহে নতুন মেয়াদে এসে এই জায়গায় সেই সংশয় দূর করতে পারেন কিনা দেখার বিষয়।
আগেরবার দায়িত্বে থাকাকালীন পাঁচ সিনিয়র ক্রিকেটারের মধ্যে তামিম ইকবালের সঙ্গেই হাথুরুসিংহের সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো ছিল বলে শোনা যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রায়ই নানান রকম চোটে খেলার বাইরে থাকা হচ্ছে তামিমের। বিশেষ করে গত চার বছরে তিনি টেস্ট খেলেছেন হাতেগোনা। সর্বশেষ ঘরের মাঠে ভারতের বিপক্ষে কুঁচকির চোটে টেস্ট, ওয়ানডে গোটা সিরিজই মিস করেন তামিম। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার নেতৃত্বেই কদিন পর নামবে বাংলাদেশ। আগামী দুই বছরে বিশেষ করে টেস্টে হাথুরুসিংহের অধীনে তামিম নিয়মিত হন কিনা তাও দেখতে মুখিয়ে থাকবেন সমর্থকরা।
ওয়ানডে বিশ্বকাপ
হাথুরুসিংহের আগের দফাতেই ওয়ানডেতে বড় দল হওয়া শুরু হয় বাংলাদেশের। ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকাকে সিরিজ হারানো। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালও খেলে তার আমলে। সেই ধারাবাহিকতা ধরে এখন দেশের বাইরেও এসেছে কিছু সাফল্য।
কিন্তু বিশ্বকাপে বাংলাদেশ এখনো সেই তিন ম্যাচের বেশি জিততে পারেনি। চলতি বছর আছে ওয়ানডে বিশ্বকাপে। ভারতে হতে যাওয়া এই আসর নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখছেন সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবালরা। কন্ডিশন সহায়ক থাকায় অন্তত সেমিফাইনালে উঠার কথা জোর দিয়ে বলা শুরু করেছেন ক্রিকেটাররা, ফাইনালে উঠে কাপ জিতে নেওয়ার বিশাল ইচ্ছাও জানাতে পিছপা হচ্ছেন না তারা।
হাথুরুসিংহের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের নাম হবে এই বিশ্বকাপ। ওয়ানডেতে বাংলাদেশ ভালো দল। গড়পড়তা সাফল্য প্রায়ই আসে। কিন্তু গড়পড়তা ছাপিয়ে দুর্দান্ত কিছু করে দেখাতে না পারলে তা ব্যর্থতা হিসেবেই গণ্য হবে। ভারতের মাঠগুলোতে বিশ্বকাপে হতে পারে বড় রানের। সাড়ে তিনশোর মতন রান করা বা সেরকম লক্ষ্য তাড়া করার পথ খুঁজতে হবে বাংলাদেশকে। আগ্রাসী ক্রিকেটের নতুন বার্তা তিনি কীভাবে ছড়িয়ে দিতে পারেন দলের ভেতর তা দেখতে হবে।
টি-টোয়েন্টি ও টেস্টের নড়বড়ে ভিত
টি-টোয়েন্টিতে এখনো বাংলাদেশ আদর্শ সমন্বয়ই খুঁজে পায়নি। কুড়ি ওভারের ক্রিকেটের ফরমুলা প্রায়ই অচেনা ঠেকে সাকিবদের দলের কাছে। চলতি বছর এই সংস্করণে খুব বেশি খেলা না থাকলেও পরের বছর আছে আরেকটি বিশ্বকাপ। চুক্তি ঠিক থাকলে হাথুরুসিংহের থাকার কথা সেখানেও। টি-টোয়েন্টির সুর ধরে দলকে একটা থিতু জায়গায় নিতে অনেক কাজ করার আছে কোচের।
টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার ২৩ বছরে পা দিলেও এখনো সবচেয়ে অভিজাত সংস্করণে ধুঁকছে বাংলাদেশ। ঘরে-বাইরে একের পর এক হার, লড়াই করতে না পারা, টেস্টের মেজাজ বুঝতে না পারার সেই পুরনো আক্ষেপগুলোই চলছে। আগের মেয়াদে দায়িত্বে থাকার সময় শর্টকাটে কিছু সাফল্যের উপায় বানিয়েছিলেন হাথুরুসিংহে। ঘরের মাঠে র্যাঙ্ক টার্নার উইকেট বানিয়ে ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেওয়া গিয়েছিল। কিন্তু সেই টার্নিং উইকেটে খেলার মুন্সিয়ানা পরে নিজেরাই ঠিকমতো আত্মস্থ করতে পারেনি বাংলাদেশ। তার ফরমুলা ধরে খেলতে গিয়ে খর্ব শক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ঘরের মাঠে হতে হয়েছে হোয়াইটওয়াশড।
সাদা পোশাকের ক্রিকেটের ভিত শক্ত করতে তার ভূমিকা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি চাইলে সেই পথে অগ্রসর হতে পারেন, নতুবা শর্টকাটে সাফল্য আনার নেশার চক্রে ঘুরপাক খেতে পারেন আবার।
আগামীর কাণ্ডারিদের সঙ্গে বোঝাপড়া
মাশরাফি মর্তুজার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার থেমেছে তিন বছর আগে। টি-টোয়েন্টি ছেড়েছেন মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবাল। টেস্টের পথচলা থেমেছে মাহমুদউল্লাহ, বাদ পড়েছেন টি-টোয়েন্টি থেকেও। বাংলাদেশের ক্রিকেটের আলোচিত পাঁচ তারকার মধ্যে কেবল সাকিব আল হাসানই খেলে যাচ্ছেন সব সংস্করণ। এরা প্রত্যেকেই আছেন ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে।
তাদের পরে বাংলাদেশের ক্রিকেটের হাল ধরে যারা এগিয়ে নিবেন সেই তারকারা কিন্তু প্রস্তুত। লিটন দাস, মেহেদী হাসান মিরাজ, তাসকিন আহমেদ, মোস্তাফিজুর রহমান এমনকি নাজমুল হোসেন শান্তও এখন অনেকটা শক্ত ভিত পাচ্ছেন পায়ের নিচে। ২০২৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপ মাথায় নিয়ে পরিকল্পনা হলে এই তারকারাই হবেন দলের কাণ্ডারি। তাদের সঙ্গে তাই হাথুরুসিংহের বোঝাপড়া ভীষণ জরুরি। এক্ষেত্রে বাড়তি কিছু সুবিধা পেতে পারেন তিনি। লিটন, মোস্তাফিজ, মিরাজ, শান্তরা তো তার হাত ধরেই পা রাখেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। তাসকিনের অভিষেক খানিকটা আগে হলেও তার উত্থান পর্বে জড়িয়ে আছেন হাথুরুসিংহে।
সব মিলিয়ে আগামী দুই বছর বাংলাদেশের ক্রিকেট সাক্ষী হতে পারে বড় পালাবদলের। সেখানে মুখ্য ভূমিকায় দেখা যেতে পারে হাথুরুসিংহেকে। মাঠে ও মাঠের বাইরের উত্তাপ বেশ ভালোভাবেই টের পাওয়ার কথা তার। হয়ত এই সময়ে অনেক রকমের খবরের রসদও যোগাবেন তিনি।
Comments