বাংলাদেশের রেফারিদের অসহায় অবস্থা: বেতন নেই, হচ্ছে হামলাও

হামজা চৌধুরী এবং শমিত সোমের মতো হাই-প্রোফাইল খেলোয়াড়দের বাংলাদেশের ফুটবলে নিয়ে আসায় একদিকে যেখানে একটা নবজাগরণের জোয়ার উঠেছে, অন্যদিকেই সেই আলোর নিচেই যেন অন্ধকার। ঘরোয়া ফুটবল অঙ্গন মাঠের বিশৃঙ্খলা ও রেফারিদের ওপর হামলার তৈরি করেছে নেতিবাচক আবহ।
দেশের ফুটবলে গত এক মাসে বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে যেখানে ক্লাব কর্মকর্তা, খেলোয়াড় এবং সমর্থকরা মাঠের সিদ্ধান্তের জেরে রেফারিদের ওপর হামলা করেছে। এমন দৃশ্য দেখা গেছে শীর্ষ স্তরের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ এবং দ্বিতীয় স্তরের বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ দুই জায়গাতেই।
এই ঘটনাগুলোর মধ্যে সর্বশেষটি হয় রোববার। জলশিরীর ফটিস গ্রাউন্ডে বিসিএল-এর ম্যাচে সিটি ক্লাবের বিপক্ষে বাফুফে এলিট একাডেমির ১-১ গোলে ড্রয়ের পর সাবেক ফিফা রেফারি জিএম চৌধুরী নয়নের ওপর ক্লাব কর্মকর্তা ও সমর্থকরা প্রকাশ্যে হামলা চালায়। ঘটনার ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, বেশ কয়েকজন লোক নয়নকে মারধর করছে, এই সময় অন্যান্য ম্যাচ কর্মকর্তা এবং এমনকি সিটি ক্লাবের কিছু সদস্য তাদের থামানোর চেষ্টা করেন।
দীর্ঘদিনের বাফুফের এই রেফারি জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি ও তার সহকর্মীরা অসহায় বোধ করছেন, কারণ তাদের এই ধরনের ঝামেলা থেকে বাঁচানোর জন্য খুব সামান্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
সোমবার চট্টগ্রামস্থ নিজ বাড়ি থেকে নয়ন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার ১৮ বছরের ক্যারিয়ারে এমন অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি। তবে স্থানীয় ফুটবলে এটি ক্রমশ সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।'
পুরো ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে নয়ন অনিরাপদ ভেন্যুগুলোকেই রেফারিদের ওপর ক্রমবর্ধমান হামলার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। কমলাপুর স্টেডিয়ামের সংস্কার কাজ চলায় বিসিএল বর্তমানে তিনটি ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে: ফটিস গ্রাউন্ড, বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনার অনুশীলন মাঠ এবং গাজীপুরের শহীদ বরকত স্টেডিয়াম।
নয়ন অভিযোগ করেন, 'ম্যাচগুলো খোলা ও অরক্ষিত মাঠে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং রবিবারের ম্যাচে মাত্র দুজন পুলিশ সদস্য ছিলেন। আমাদের সহকর্মী জসিমকেও সম্প্রতি একই ভেন্যুতে হেনস্তা করা হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে গাজীপুরে নাজমুলকে মারধর করা হয়েছে।'
সম্প্রতি বসুন্ধরা কিংস ও আবাহনীর মধ্যকার একটি উত্তেজনাপূর্ণ বিপিএল ম্যাচের পর জাতীয় দলের এক খেলোয়াড়ের ম্যাচ কমিশনারকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনা বিপিএল ম্যাচগুলোর শৃঙ্খলাহীনতার ওপর আলোকপাত করে। যদিও বিপিএল-এর ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাকে বহিষ্কার ও আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে, তবে দ্বিতীয় স্তরের ঘটনাগুলো অগোচরেই থেকে যাচ্ছে।
তবে রেফারিদের দুর্দশার একটি দিক কেবল শারীরিক নির্যাতনই নয়। পাওনা টাকাও পাচ্ছেন না তারা। আগের কমিটি ও বর্তমান কমিটির সময় ধরে বাফুফের কাছে রেফারিদের অনেক টাকা বকেয়া থাকার বিষয়টি রেফারিদের কষ্ট আরও অসহনীয় করে তুলেছে। রেফারিরা সম্প্রতি বাফুফের বিপিএল ম্যাচ বয়কটের হুমকি দিয়েছিলেন, পরে কিছু অর্থ পরিশোধ করে তাদের মাঠে নামানো হয়।
কিন্তু নতুন পরিচালনা পর্ষদের অধীনে রেফারি কমিটি গঠনের কোনো লক্ষণ না দেখা যাওয়ায় এবং বাংলাদেশ ফুটবল রেফারি অ্যাসোসিয়েশন আপাতদৃষ্টিতে নীরব থাকায় রেফারিরা তাদের অভিযোগ ন্যায্যভাবে সমাধানের খুব কমই আশা দেখছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিনিয়র ফিফা রেফারি এই পরিস্থিতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, 'বর্তমানে রেফারি হওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ। রেফারিদের নিজেদের পকেট থেকে খরচ করে ম্যাচ পরিচালনা করতে হয়, এবং তারপর তারা আক্রান্ত হন। এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক এবং আমাদের ফুটবলের জন্য একটি উদ্বেগজনক লক্ষণ।'
ব্যাপকভাবে সম্মানিত এই রেফারি চলমান পরিস্থিতিকে 'ক্রমবর্ধমান জাতীয় অসহিষ্ণুতা'র লক্ষণ হিসেবেও অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, 'আমি মনে করি এটি একটি জাতীয় প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে – নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়া।'
'মানুষ আইনের প্রতি সম্মান দেখায় না, এবং তারা এই জঘন্য কার্যকলাপের মাধ্যমে পেশী শক্তি ও রাজনৈতিক প্রভাব দেখাতে চেষ্টা করে।'
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বারবার চেষ্টা করেও সংশ্লিষ্ট বিএফএফ কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
Comments