'এই সাফল্য আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করা উচিত'

বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের ঐতিহাসিক এএফসি নারী এশিয়ান কাপের মূল পর্বে জায়গা করে নেওয়ার পর থেকেই প্রশ্ন উঠছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) কি এই মুহূর্তকে দীর্ঘমেয়াদী অগ্রগতিতে রূপ দিতে পারবে? দ্য ডেইলি স্টার-এর আনিসুর রহমানের সঙ্গে একান্ত আলাপে বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়াল নারীদের ফুটবল ঘিরে চ্যালেঞ্জ, পরিকল্পনা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন।

দ্য ডেইলি স্টার: এএফসি নারী এশিয়ান কাপে নারী দলের ঐতিহাসিক যোগ্যতা অর্জনকে বাফুফে কীভাবে দেখছে?

তাবিথ আউয়াল: প্রথমেই বলি, আমরা প্রত্যাশার বাইরে ফুটবল খেলছি না। বরং এটা আমাদের আধুনিক ও বিশ্লেষণভিত্তিক প্রস্তুতির ফল। এখন আমরা প্রতিপক্ষদের বিশ্লেষণ করি, নিজেদের খেলোয়াড়দের দক্ষতা ও সামর্থ্য গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি। আমার মনে হয় দল এখন সে মানেই খেলছে, যা বাংলাদেশ প্রত্যাশা করতে পারে। মেয়েরা পুরো কৃতিত্ব প্রাপ্য, বিশেষ করে তারা যেভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে লড়েছে। আমরা প্রায়ই প্রতিপক্ষের ফিফা র‌্যাঙ্কিং নিয়ে মগ্ন থাকি, কিন্তু এই যোগ্যতা অর্জন কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়। এটা অনুশীলন ও কারিগরি প্রস্তুতিরই ফল।

ডেইলি স্টার: বাফুফে কীভাবে এই সুযোগ কাজে লাগাতে চায়?

তাবিথ: আমরা এই সুযোগটা দুই-তিনভাবে কাজে লাগাতে চাই। প্রথমত, আমাদের কিছু খেলোয়াড় আন্তর্জাতিক মানের এবং তাদের এশিয়া বা ইউরোপের ভালো লিগে খেলার সুযোগ পাওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, আমরা স্পন্সর ও ব্র্যান্ডিং বাড়াতে চাই এবং সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। সরকার যদি বিনিয়োগ করে, তাহলে নারীদের ফুটবলে আরও ভালো ফল সম্ভব। তৃতীয়ত, আগের মতো গুরুত্ব আমরা দেইনি, আমি নিজেও ব্যর্থতা স্বীকার করছি, বিশেষ করে নারী লিগ নিয়ে। এখনো কোনো গঠনমূলক প্রতিযোগিতা কাঠামো নেই। আমি আশাবাদী, এই যোগ্যতা অর্জন আমাদের অনুপ্রাণিত করবে এবং কাজ সহজ করে দেবে। শেষ কথা, আমাদের একটি নারী ফুটবল কমপ্লেক্স দরকার—যেখানে ইয়ুথ ট্রেনিং, এলিট ট্রেনিং ও ফিজিও সেন্টার থাকবে। বিশেষ করে এখন নারী খেলোয়াড়রা অনেক ম্যাচ খেলছে, তাদের জন্য এটা খুবই দরকার।

ডেইলি স্টার: এই অর্জন কি প্রমাণ করে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের বাইরে পা ফেলেছে?

তাবিথ: আমি মনে করি, অনেকেই বাস্তবতা না বুঝেই আত্মবিশ্বাসী মন্তব্য করেন। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দলগুলোও খুব একটা পিছিয়ে নেই। আমরা এখনো কৌশলগত কারণে সেরা দল, আমরাই সাফ চ্যাম্পিয়ন। ভারতও এশিয়ান কাপে খেলছে, নেপাল হেরেছে শুধু পেনাল্টিতে। নেপালি ফরোয়ার্ডরা সবচেয়ে বেশি গোল করেছে, ভুটানও ভালো করছে। তাই আমাদের বুঝতে হবে, সব দলই উন্নতি করছে। অতীতে যেটা কাজ করেছে, ভবিষ্যতে সেটি আর হয়তো ফল দেবে না। উন্নতির জন্য আমাদের নতুনভাবে ও ভিন্নভাবে কাজ করতে হবে।

ডেইলি স্টার: বাফুফের জন্য সারাবছর নারী দলের অনুশীলন চালিয়ে যাওয়া কতটা কঠিন?

তাবিথ: আমি বলব, পুরো কৃতিত্ব খেলোয়াড়দের, কারণ তারা কঠিন পরিবেশে থেকেও দারুণভাবে নিবেদন দেখাচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের ট্রেনিং পদ্ধতি অনেকটা উত্তর কোরিয়ার মতো হয়ে গেছে, একটি সামরিক ক্যাম্পের মতো। এটা ফল দেয়, কিন্তু টেকসই নয়। টেকসই করতে হলে আমাদের লিগভিত্তিক কাঠামোয় যেতে হবে, এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। এখন যেহেতু আমরা এশিয়ান কাপে খেলছি, যা বিশ্বকাপ ও অলিম্পিকের কোয়ালিফায়ার হিসেবেও কাজ করবে, তাই ক্যাম্পই সবচেয়ে ভালো প্রস্তুতির মাধ্যম। তবে এশিয়ান কাপের পর আমাদের অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় যেতে হবে—একজন কোচ, একটি ভবন আর কয়েকজন খেলোয়াড়ের ওপর নির্ভর করে নয়।

ডেইলি স্টার: নারীদের ফুটবলের জন্য বাফুফের টেকসই পরিকল্পনা কী?

তাবিথ: আমি আগেই বলেছি, আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ নারী ফুটবল লিগ আয়োজন করব। পাশাপাশি, বিএকেএসপিকে বিভিন্ন শাখায় নারীদের ফুটবল কার্যক্রম বাড়াতে সহায়তা করব। আমরা দুটি নারী ক্যাডেট কলেজকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছি এবং সেনাবাহিনী, পুলিশ ও অন্যান্য সেবাদানকারী সংস্থাগুলোকে নারী ফুটবল দল গঠনে সহায়তা করছি। এর মাধ্যমে শক্তিশালী পাইপলাইন গড়া সম্ভব এবং খেলার মাঠে প্রবেশাধিকারের সুযোগও বাড়বে।

ডেইলি স্টার: সাফ জয়ের পর দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না কেন?

তাবিথ: অনেক অদৃশ্য বিষয় পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলে, যেগুলো নিয়ে আমরা সচরাচর আলোচনা করি না। প্রথমত, আমরা নারীদের সরঞ্জামে গুরুত্ব দিয়েছি—বুট, জার্সি ইত্যাদি, যা পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলে। দ্বিতীয়ত, আমরা কিছু প্রীতি ম্যাচ আয়োজন করেছি, যা মেয়েদের আত্মবিশ্বাস দিয়েছে ও কৌশলগত উন্নয়ন ঘটিয়েছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আবাসন। এখন সময় হয়েছে ভালো অফ-ফিল্ড পরিবেশ দেওয়ার, যেটা সরাসরি পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলে। উচ্চতর লক্ষ্য অর্জন করতে চাইলে বাফুফেকে ভালো আবাসন, পুষ্টিকর খাবার ও একটি সজ্জিত জিম নিশ্চিত করতে হবে, সবকিছু নারী খেলোয়াড়দের প্রয়োজন অনুযায়ী।

ডেইলি স্টার: এশিয়ান কাপের আগে খেলোয়াড়দের চাহিদা কীভাবে পূরণ করবে বাফুফে?

তাবিথ: আমরা বর্তমান ও আগের সরকার, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে একাধিকবার অনুরোধ করেছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত কেবল প্রতিশ্রুতি ছাড়া কিছুই পাইনি। অর্থ সাহায্য, আলাদা মাঠ, বা আবাসনের কোনো ব্যবস্থা এখনো পাইনি। সরকার যদি ৬৪টি জেলা স্টেডিয়ামের যেকোনো একটি বরাদ্দ দেয়, সেটাই অনেক। এমনকি পর্যটন করপোরেশনের গেস্ট হাউস বা অন্য সরকারি সংস্থার বাড়িও নারী ফুটবলারের আবাসন হিসেবে ব্যবহার করা যেত। আমরা ফিফা ও স্পন্সরদের কাছ থেকে যে অর্থ পাই, তার বড় অংশই টুর্নামেন্টে ব্যয় হয়। ফলে নারী ফুটবলের দৈনন্দিন খরচ চালানোই এখন চ্যালেঞ্জ। এ খরচ না মেটাতে পারলে গুণগত মানে আপস করতে হয়। তাই সরকারের সহায়তা জরুরি।

ডেইলি স্টার: বাফুফে কি সরকারকে লিখিত কোনো প্রস্তাব দিয়েছে?

তাবিথ: হ্যাঁ, আমরা লিখিতভাবে আমাদের প্রয়োজনীয়তা জানিয়েছি। নারী দলের বিমান ভাড়ার জন্য সাহায্য চেয়েছিলাম, কিন্তু কিছুই পাইনি। নিজেদের টাকায় খরচ চালাতে হয়েছে। সাফজয়ী দলের সদস্যরাও মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানে চিঠি দিয়েছিলেন, কিন্তু এখনো কোনো বাস্তব ফল দেখিনি। তবুও আমরা আশা ছাড়িনি, তবে সময় দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে। সবাইকে খেলোয়াড়দের প্রয়োজনের দিকে নজর দিতে হবে।

ডেইলি স্টার: বেসরকারি স্পন্সরদের সাড়া কেমন?

তাবিথ: ঢাকা ব্যাংক আমাদের বড় সহায়তা দিচ্ছে। তাদের বাইরে কিছু করপোরেট হাউস স্বল্পমেয়াদে এগিয়ে এসেছে—যেমন ট্রাভেল, প্রীতি ম্যাচ, সরঞ্জাম, টেকনিক্যাল স্টাফের উন্নয়ন ও খেলোয়াড়দের বেতন দিতে। তবে এসব সহায়তা টেকসই নয়। তাই আমাদের সরকার থেকে দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই সহায়তা দরকার।

ডেইলি স্টার: 'মিশন অস্ট্রেলিয়া' বলতে কী বোঝাচ্ছেন?

তাবিথ: 'মিশন অস্ট্রেলিয়া'র বার্তা খুব সহজ। প্রথমত, পুরো জাতিকে নারী ফুটবল দলের পেছনে একতাবদ্ধ করা, যাতে অস্ট্রেলিয়ায় এএফসি নারী এশিয়ান কাপে ভালো কিছু অর্জন সম্ভব হয়। দ্বিতীয়ত, যারা সহযোগিতা করতে চান—এটাই সময়, এটাই মঞ্চ। ইতোমধ্যে কিছু অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী আর্থিক সহায়তা দেওয়ার আগ্রহ জানিয়েছেন। এখন থেকে প্রতিটি কাজ—প্রীতি ম্যাচ, অনুশীলন, টেকনিক্যাল উন্নয়ন কিংবা বেতন বৃদ্ধি, সবই 'মিশন অস্ট্রেলিয়া' লক্ষ্যেই হবে।

ডেইলি স্টার: শক্তিশালী ও নিয়মিত নারী লিগ গঠনে বাফুফের পরিকল্পনা কী?

তাবিথ: আমাদের এমন পৃষ্ঠপোষকদের খুঁজে বের করতে হবে, যারা ক্লাবগুলো টেকসইভাবে পরিচালনা করতে পারে, স্বল্পমেয়াদী ভিত্তিতে নয়। যেসব প্রতিষ্ঠান আবাসিক ক্যাম্প পরিচালনা করতে পারে, তাদের চিহ্নিত করে বাফুফে সহায়তা করবে। তবে ক্লাবগুলোকেই নিজেদের আর্থিক সক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের লক্ষ্য ৬ থেকে ১০টি দল নিয়ে নারী লিগ করা এবং ৪ থেকে ৬ মাস সময় জুড়ে ম্যাচ সংখ্যা বাড়ানো। আমাদের উদ্ভাবনী হতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় বা আবাসিক স্কুলগুলোও লিগের অংশ হতে পারে। বাফুফে সবদিক থেকে ক্লাবগুলোকে সহযোগিতা করবে।

ডেইলি স্টার: এশিয়ান কাপের আগে জাতীয় দলের প্রস্তুতি নিয়ে কী পরিকল্পনা রয়েছে?

তাবিথ: পিটার বাটলার কিছু চাহিদা ও প্রস্তাব দিয়েছেন। নারী উইং একটি পরিকল্পনা খসড়া করেছে, এবং আমাদের গবেষণা টিম অন্যান্য সদস্য দেশের প্রস্তুতির তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে একটি হোয়াইট পেপার তৈরি করেছে। খেলোয়াড়রাও নিজেদের মতামত ও চাহিদা জানিয়েছে। এই তিনটি একত্র করে আমরা চূড়ান্ত পরিকল্পনা করব। আপাতত অপেক্ষায় আছি, আমরা কোন গ্রুপে পড়ি, তারপর চূড়ান্ত পরিকল্পনা ঘোষণা করা হবে।

ডেইলি স্টার: বাফুফে সময়মতো বেতন দিতে ব্যর্থ হয় কেন? বেতন বাড়ানো হবে?

তাবিথ: আমরা দুটি উপায়ে বেতন বাড়ানোর পরিকল্পনা করছি। প্রথমত, পারফরম্যান্সভিত্তিক বোনাস চালু করে—যাতে ভালো পারফরম্যান্স ও শৃঙ্খলার জন্য খেলোয়াড়রা অতিরিক্ত আয় করতে পারে। দ্বিতীয়ত, করপোরেট স্পন্সরশিপে সহযোগিতা করতে চাই, যেমন আফেইদা খান রবি থেকে পেয়েছেন। বেতন অনিয়মিত হওয়াটা দুঃখজনক, কিন্তু এটা পুরোনো দেনার কারণে হয়েছে। আমরা নভেম্বর মাসে দায়িত্ব নিই, তখন আগস্টের বেতন বাকি ছিল। তখন থেকে আমরা সেই বোঝা বইছি—আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে। আশা করি, আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।

ডেইলি স্টার: ভুটানের লিগে থাকা পাঁচজন খেলোয়াড়কে কি জাতীয় দলে বিবেচনা করা হবে?

তাবিথ: সত্যি বলতে, আমরা ফেব্রুয়ারির ঘটনাকে পেছনে ফেলে এসেছি। আমরা কাউকেই 'বিদ্রোহী খেলোয়াড়' হিসেবে দেখি না। বাফুফের ৫৪ জন চুক্তিভুক্ত খেলোয়াড় রয়েছে—সবাই যেকোনো সময় জাতীয় দলের জন্য বিবেচ্য। আমরা সবসময় শৃঙ্খলা, ফিটনেস ও ফর্ম বিবেচনায় সেরা একাদশ খেলাতে চাই। কে খেলছে না, সেটা বিষয় নয়, মূল কথা হলো ৫৪ জন সবাই যেন ডাক পেলে খেলার জন্য প্রস্তুত থাকে।

Comments

The Daily Star  | English

Nahid calls for preparations for another mass uprising if ‘old game’ doesn’t end

He made these remarks during a street rally at Chashara intersection, Narayangaj

24m ago